প্রথাগত সুন্দর আর আকাশের বেগুনী মলাট ছিঁড়ে উড়ে যাচ্ছে
একটুকরো মেঘ। উড়ে যাচ্ছে পূর্বে। পশ্চিমের সকল পুঁজি বহন
করে যে ভিক্ষুক রাস্তায় নেমেছিল, সেও চেয়ে দেখছে তার পায়ের
নিচের মাটি সরে যাচ্ছে ক্রমশ।
‘আরও রক্ত চাই’-এমন হুংকার শুনে হেসে উঠছে শিশুরা।
যারা আকাশে ঘুড়ি উড়াবার জন্য মাঠে নেমেছিল, তারাও
ভাঙা নাটাই হাতে নিয়ে, ফিরছে ঘরে। পেরেক বিষয়ক প্রবন্ধ
লিখার জন্য কিছু তথ্য সংগ্রহে গুগল সার্চ সেরে নিচ্ছে ঘরবন্দী
পিতাদের দল।
বন্দিদশা মানুষের আজন্ম নিয়তি ! এই তথ্যগুলো সামনে ভেসে
উঠার সাথে সাথে কেউ কেউ সারমর্মগুলোর প্রিন্টও নিতে চাইছে
কালো কাগজে। শাদা দুঃখগুলো নির্বাসিত হবার পর এই নগরে
আর কেউ সফেদ কাগজে কলম ঘষে না। শিল্পীরাও কালির বদলে
ব্যবহার করেন তাজা রক্তের ফোঁটা।
রাতগুলো দীর্ঘ ছিল এই নগরের। আর দিনগুলো, বোমা এবং
বৈধব্যের স্থিরচিত্র ধারণ করে ক্রমশই লিখে যাচ্ছিল দাসত্বের ইতিহাস।
‘আজ এই দাসপ্রথার প্রথম পর্বের সমাপ্তি হবে’। একজন জেনারেল
সগর্বে এই ঘোষণাটি দেবার পর, বাগদাদের মরুভূমি থেকে
ছুটে আসেন একজন বেদুইন।
‘আপনি সত্যি চলে যাচ্ছেন প্রিয় জেনারেল !
সত্যিই নামিয়ে নিচ্ছেন আপনাদের লাল নীল পতাকা !
আমাদের বিদীর্ণ আকাশ থেকে সত্যি খসে পড়ছে
আপনাদের পঞ্চাশটি তারকা !’
বলতে বলতে দুহাত তুলে দাঁড়ান বৃদ্ধ বেদুইন।
আপনাকে আমি খুব ভালোবাসি প্রিয় জেনারেল !
খুব ভালোবাসি আপনার হাতের আগ্নেয়াস্ত্র ! কারণ এই
অস্ত্রই আমাকে পিতৃহীন করেছে। আমাকে করেছে ভিটেসূত্রহীন।
হারানোর বেদনা আমার পাঁজরে জমিয়েছে অজস্র পলিকণা। উর্বর
হতে হতে আমি জেনে গেছি যুদ্ধই জীবনের পরিণত পরিণাম।
আপনি চলে যাচ্ছেন প্রিয় জেনারেল ! সাথে নিয়ে যাচ্ছেন আপনার
রক্তাক্ত চোখ। যে চোখে জমে আছে অগণিত নবজাতের রক্ত।
একটি মানব-ভ্রূণ ধারণ করার চার সপ্তাহ পর আপনাদের বোমার
আঘাতে আবু গারিব শহরের উপকূলে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল যে
তরুণী, জানি তার রক্তের দাগও লেগেছিল আপনার উর্দিতে।
সুখ্যাতি(!)র স্টারগুলো সামলাতে সামলাতে আপনি শুধুই বলেছিলেন-
‘উই উইল উইন দ্যা ওয়ার’।
নিরীহদের হত্যা করতে করতে হায়েনারা এভাবেই যুদ্ধ জয় করে,
প্রিয় জেনারেল ! এভাবেই বনেদি বেনিয়ারা আমাদের চারপাশে
সেরে নেয় রক্ত এবং তেলের মিশ্রণ। খনিজসম্পদে চোখ বুলাতে
বুলাতে ভ্রমণ করে লক্ষ মরুমাইল। কখনও গোপন মাইন পোঁতে,
সনাক্ত করে সম্পদের উৎস।
‘বোমার বিনিময়ে বাণিজ্য চাই’-এমন মিশন সেরে আপনি সত্যি
চলে যাচ্ছেন প্রিয় জেনারেল ! ৩১ ডিসেম্বর ২০১১ এর আগেই
আরেকটি কারবালার হাহাকার তৈরি করে সদলবলে আপনি
চলে যাচ্ছেন। রেখে যাচ্ছেন আমাদের জন্য গণতন্ত্রের ধনুক।
তীরটা সাথে করেই নিয়ে যাচ্ছেন। যাতে প্রয়োজনে আবার কাজে
লাগাতে পারেন।
চতুর শিকারিরা এভাবেই, ভিন্ন জনপদে রেখে যায় তাদের গৃহপোষা
ঈগল। কখনও রেখে যায় বিষধর সাপও। নির্দেশ পেলেই যাতে নগরে
মনুষ্যকুলকে ছোবল দিতে পারে।
আমার খুব কষ্ট হচ্ছে প্রিয় জেনারেল! আপনি এই নগর ছেড়ে চলে
যাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু আপনাদের রক্তদৃষ্টি, বজ্রবৃষ্টির মতোই দখল করতে
চাইবে নতুন কোনো জনপদ। আপনার সাবমেরিন খুঁজতে চাইবে নতুন
কোনো গন্তব্য। একদিন পেন্টাগনের কপাট ছুঁয়ে আপনি যে শপথ
নিয়েছিলেন, তা ছিল মানবতা রক্ষার অঙ্গীকার। অথচ আমরা দেখলাম,
ভোগের কাছেই পরাজিত হলো রক্তাক্ত মানবতা। ছটপট করতে করতেই
মৃত্যুবরণ করলো ডানাহীন অসংখ্য পাখি।
বিষণ্ন নির্জনতা জাগিয়ে দিয়ে আপনি চলে যাচ্ছেন, প্রিয় জেনারেল !
মাঝে মাঝে এভাবেই চলে যেতে হয়। নামিয়ে নিতে হয় দখলের পতাকা।
এই মরুরৌদ্রে বসে আমার উত্তরসূরিরা নিশ্চয়ই একদিন পরখ করবে
অতীতের লগ্নকাল। সবগুলো চন্দ্রগ্রাস অস্বীকার করে তারা লিখবে
নতুন ইতিহাস। যে ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, গোটা বিশ্ব থেকেই কীভাবে
সরে যাবে তিনরঙা রাহুগ্রহ। কীভাবে নেমে যাবে শোষণের উড্ডীন পতাকা।
প্রিয় জেনারেল, আপনি আমাদেরকে ঘুরে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন। এই
মরুমাটিতে, আপনার পদধূলি না-পড়লে আমাদের কোনোদিনই চেনা হতো না,
বিদগ্ধ যুদ্ধের এইসব বিপরীত সম্মোহন। কিছু মুখোশের অভিন্ন ছলাকলা।
loading...
loading...
অসাধারণ একটি কবিতা। ভীষণ ভালো লাগলো প্রিয় ইলিয়াস ভাই।
loading...