আরেকটি বাংলা বছর চলে গেল। আর কয়েকদিন পরেই বাংলা নববর্ষ। ১৪২৪ বঙ্গাব্দ কড়া নাড়ছে আমাদের দরজায়। কবিগুরু বলেছেন- এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ/ তাপস নিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/ যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি,/ অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।/ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা/ রসের আবেশ রাশি শুষ্ক করি দাও আসি,/ আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ/ মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক। হ্যাঁ- আমরা একটি অগ্নিস্নান চাই। চাই শুচি হোক ধরা। বৈশাখ বাঙালির উৎসব। মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালির উৎসব। সেই উৎসবকে বন্ধ করার হুমকি দেয়া হয়েছে। বর্ষবরণের নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের বিরোধিতা করেছে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। শোভাযাত্রাকে অনৈসলামিক আখ্যায়িত করেছে তারা। মঙ্গল শোভাযাত্রা বাতিল না করলে আন্দোলন করার হুমকি দিয়েছে দলটি।
সরকারের উদ্দেশে তারা বলেছে, বর্ষবরণের নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রার আদেশ বাতিল করা না হলে ঈমানদার জনতা ময়দানে নেমে আসতে বাধ্য হবে। মঙ্গল শোভাযাত্রা ইসলামবিরোধী। আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারো কাছে মঙ্গল প্রার্থনা করা ইসলামে নিষিদ্ধ। ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত মঙ্গল শোভাযাত্রা সাম্প্রদায়িক। মঙ্গল শোভাযাত্রা কোনোক্রমেই বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের জীবনধারার সঙ্গে যুক্ত নয়। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো কর্মসূচি প্রত্যাহার করা না হলে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। এখানে আমার একটি প্রশ্ন আছে। মঙ্গল শোভাযাত্রার কোথাও কি বলা হয়েছে, মানুষ অন্য কোনো শক্তির কাছে মঙ্গল চাইছে? তাহলে হঠাৎ করে ধর্মের দোহাই দিয়ে দাঙ্গা বাঁধাবার চেষ্টা করা হচ্ছে কেন? পহেলা বৈশাখ মঙ্গল শোভাযাত্রায় তুলে ধরা হয় বাঙালি সংস্কৃতির নানা দিক। তা ফুটিয়ে তোলা হয় চিত্র, মুখোশ আর প্রতীকে। প্রতি বছরই এই মঙ্গল শোভাযাত্রার একটি মূলভাব থাকে।
এই মঙ্গল শোভাযাত্রার দিকে ফিরে তাকানো যাক। এই মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রথম শুরু হয়েছিল ১৯৮৫ সালের পয়লা বৈশাখে যশোরে। তখন ছিল দেশে সামরিক স্বৈরশাসন। উদ্দেশ্য ছিল দেশের লোকজ সংস্কৃতি উপস্থাপনের মাধ্যমে সব মানুষকে এক করা। এক যাত্রায় নিয়ে আসা। আর সেই শোভাযাত্রায় অশুভের বিনাশ কামনা করে শুভ শক্তির আগমনের প্রার্থনা করা। এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন চারুশিল্পী মাহবুব জামাল শামিম। তিনি ঢাকার চারুকলা থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে যশোরেই ‘চারুপিঠ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন তখন। তিনি মিডিয়াকে জানিয়েছিলেন, পহেলা বৈশাখে এই মঙ্গল শোভাযাত্রার উদ্দেশ্য ছিল দুটি। দেশের লোকজ সংস্কৃতিকে তুলে ধরা। আর তার মাধ্যমে সবাইকে সত্য এবং সুন্দরের পথে আহ্বান করা। তাই তাদের শোভাযাত্রায় স্থান পায় নানা ধরনের চিত্র, হাতে বানানো পাখা, ঘোড়া, হাতি, ঢোল, বাঁশি প্রভৃতি। শোভাযাত্রাটি থাকে নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ। এই শোভাযাত্রার মূলভাব প্রতিবাদের, ভালোবাসার এবং দ্রোহের। সেখানে অশুভের বিনাশ কামনা করা হয়। প্রার্থনা করা হয় সত্য এবং সুন্দরের জন্য। আনন্দের কথা হচ্ছে, এখন সারা দেশেই এই মঙ্গল শোভাযাত্রা ছড়িয়ে পড়েছে। পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রা একটি প্রধান অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সারা দেশে একই সময় পহেলা বৈশাখ সকাল ১০টায় এই মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়। এই আলো ছড়িয়ে পড়েছে বিদেশেও। লন্ডন, নিউইয়র্ক, সিডনি, টরেন্টো, টোকিও, ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডাসহ অনেক দেশেই এখন বের হয় এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকায় এই মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে চারুকলা ইনস্টিটিউট। এই শোভাযাত্রার আয়োজনে নানা ধরনের চিত্র, প্রতিকৃতি, মুখোশ তৈরি করেন চারুকলার ছাত্র এবং শিক্ষকরা। প্রাণের টানে, স্বেচ্ছা শ্রমে এগিয়ে আসেন হাজার হাজার তরুণ-তরুণী।
বাঙালি জাতির জন্য এটা খুবই আনন্দের কথা, বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক এই সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে এই স্বীকৃতির কথা জানিয়েছে। ইউনেস্কো তার ওয়েবসাইটে মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে বলেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে এই শোভাযাত্রা বের হয়। ১৯৮৯ সালে সামরিক স্বৈরশাসনের হতাশার দিনগুলোতে তরুণেরা এটা শুরু করেছিল। শিক্ষার্থীরা অমঙ্গলকে দূর করার জন্য বাঙালির নানা ধরনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক, প্রাণির প্রতিকৃতি ও মুখোশ নিয়ে শোভাযাত্রা করে। মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার আরো যে কয়েকটি কারণ ইউনেস্কো উল্লেখ করেছে তা হচ্ছে, এই শোভাযাত্রা অশুভকে দূর করা, সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতীক। এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাঙালির ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতিগত সব ধরনের বৈশিষ্ট্য এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হয়। আমি মনে করি, বাঙালি জাতি ১৯৭১ সাল থেকেই তাদের নবউদ্যমে যাত্রা শুরু করেছে। বিজয়ী জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বিশ্বে। তাহলে আজ সাড়ে চার যুগ পরে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে টুঁটি চেপে ধরার পাঁয়তারা করা হচ্ছে কেন? কারা এটি করছে? তাদের অতীত পরিচয় কি?
আমরা সংবাদমাধ্যমে দেখছি, এবারের শোভাযাত্রাকে ঘিরে জয়নুল গ্যালারির সামনেই তৈরি হচ্ছে বৃহৎ আকারের নানা মুখোশ। বাঁশ- বেত দিয়ে তৈরি হচ্ছে পাখি। তৈরি হচ্ছে বিশাল আকৃতির নানা শিল্প-কাঠামো। তার জন্য আনা হচ্ছে বাঁশ, বেত ও অন্যান্য সরঞ্জাম। আয়োজকরা জানিয়েছেন, অন্ধকারের বিরুদ্ধে এবার থাকছে নানা মোটিভ, থাকছে নানা শৈল্পিক প্রতিবাদ। শোভাযাত্রায় অন্যান্য অনুষঙ্গের সঙ্গে থাকছে সূর্যের মুখের কাঠামো। অন্ধকার তাড়াতে যেন আলোয় ভরে ওঠে পৃথিবী। বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবী বলেছেন, ‘যেহেতু মঙ্গল শোভাযাত্রা বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে তাই এবারের আয়োজনে ভিন্ন মাত্রা যোগ করার প্রচেষ্টা থাকবে। আশা করছি, এবারের শোভাযাত্রাটি আরো বর্ণাঢ্য ও বিস্তৃত হবে। সর্বসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত‚র্ত অংশগ্রহণও বাড়বে। অর্থনৈতিক দিক থেকে আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তারপরও নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে অতিক্রমের চেষ্টা রয়েছে।’
অন্যদিকে একটি মৌলবাদী মহল এই শোভাযাত্রা বন্ধ করার হুমকি দিচ্ছে। তারা বলছে, এই দেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের। তাহলে কি দেশটি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের নয়? ১৯৭১ সালে তো সবাই মিলেই মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ক্রমশ ছড়াচ্ছে দেশে-দেশে। মনে পড়ছে, বাঙালির উন্নত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, খাদ্য, সঙ্গীত, চিত্রকর্ম এবং সাহিত্য আমেরিকানদেরও সমৃদ্ধ করেছে বলে মন্তব্য করেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। সারা বিশ্বের বাঙালিদের বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে ১৪২৩ এর পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে তিনি এ কথা বলেছিলেন। ওবামা বলেছিলেন, বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর গৌরবময় ইতিহাস এবং সংস্কৃতির এই উৎসবে যুক্তরাষ্ট্রও সঙ্গে রয়েছে। বাংলা উচ্চারণে ‘শুভ নববর্ষ’ জানিয়ে প্রেসিডেন্ট ওবামা বাঙালিদের উদ্দেশে আরো বলেছিলেন, ‘পরিবার ও বন্ধুদের নিয়ে আপনারা যখন এই বর্ষবরণে একত্রিত হবেন, তখন আপনাদের বন্ধু এবং এই আনন্দের অংশীদার হয়ে যুক্তরাষ্ট্র আপনাদের পাশে রয়েছে।’
বাঙালির ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক চেতনা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে একই সূত্রে গাঁথা। একাত্তরে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সবাই দেশমাতৃকার মুক্তিপণে অগ্রবর্তী বাহিনীর ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের অনেকেই এখনো আছেন এই বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক বটবৃক্ষ হয়ে। আজ তাদের সামনেই মৌলবাদীরা নানা ধরনের হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। দেশে যখন জঙ্গিবাদী আস্তানার খোঁজে সরকার মরিয়া, তখন এমন হুমকি মূলত বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনার ওপর আঘাত। তারা সাধারণ মানুষকে গোটা জাতির মূলধারার বিপক্ষে দাঁড় করাবার অপচেষ্টা করছে। এ অবস্থা রুখে দিতে প্রজন্মকে সাহস নিয়ে এগোতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই দেশে জাতীয় সঙ্গীতের বিরুদ্ধে কারা বিষোদগার করেছে- তা আমাদের অজানা নয়। কারা এখনো বাঙালি জাতীয়তাবাদকে স্বীকার করে না, তা আমাদের অজানা নয়।
গত বছর বাংলা নববর্ষের প্রাক্কালে দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেছিলেন- ‘আবহমান বাঙালির এ উৎসবে নতুন মাত্রা দিতে আমরা দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখে উৎসবভাতা প্রবর্তন করেছি। বাঙালির শাশ্বত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর। বাংলা নববর্ষ আমাদের জাতীয়তাবোধ ও চেতনাকে শাণিত করে। বর্ষবরণের উৎসবে এ চেতনাকে নস্যাৎ করার জন্য স্বাধীনতার আগে ও পরে বহু ষড়যন্ত্র হয়েছে। আঘাত করা হয়েছে বারবার। বোমা মেরে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক শক্তির কোনো অপচেষ্টাই সফল হয়নি। বাঙালি জাতি নববর্ষকে ধারণ করেছে তাদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হিসেবে। আমি আশা করি, পহেলা বৈশাখে বাঙালি সংস্কৃতির এ চর্চা আমাদের জাতিসত্তাকে আরো বিকশিত করবে। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তি জোগাবে। রাজনীতির নামে সন্ত্রাস, আগুনে পুড়িয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা ও দেশের সম্পদ ধ্বংসকারী অপশক্তির বিরুদ্ধে আমাদের আরো ঐক্যবদ্ধ করবে।’ হ্যাঁ- সেই ঐক্যের পথেই এগিয়ে যেতে চায় বাংলাদেশ। দেশের মানুষ শান্তি চায়। তাই কতিপয় ধর্মীয় উন্মাদের হাতে আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জিম্মি থাকতে পারে না।
__________________________________
দৈনিক ভোরের কাগজ। ঢাকা। রবিবার, ৯ এপ্রিল ২০১৭
loading...
loading...
বাঙালি জাতি নববর্ষকে ধারণ করেছে তাদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হিসেবে। বাঙালির শাশ্বত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর।
বাংলা নববর্ষ আমাদের জাতীয়তাবোধ ও চেতনাকে শাণিত করে।
শুভ বাংলা নববর্ষ প্রিয় ইলিয়াস ভাই।
loading...
পয়লা বৈশাখ বাঙালের সার্বজনীন উৎসব ছিলো না। পয়লা বৈশাখ ছিলো বাঙালের দায়মুক্তির প্রহসন। রাজা, জমিদারদের খাজনা পরিশোধ আর মওকুফের মাধ্যমে নতুন দাসত্বের সূচনার জন্য পয়লা বৈশাখের জন্ম। পয়লা বৈশাখকে পয়দা করার ক্ষেত্রে বাঙালের ঐতিহ্য প্রাধান্য পায়নি, প্রাধান্য পেয়েছে সম্রাট আকবরের খাজনা আদায়ের সুযোগসুবিধার হিসাব নিকাশ।
এ বক্তব্য ও তথ্য যেমন ঐতিহাসিক সত্যি,
অন্যদিকে এ তথ্যও সত্যি—-
চৈত্রসংক্রান্তি হিন্দুদের ‘চৈত্র সংক্রান্তি পূজা’ থেকে নেওয়া হয়েছে। হিন্দুরা যুগ যুগ ধরে চৈত্র মাসের শেষ দিন এটি উদযাপন করে আসছে ।
এ ছাড়া বাংলা পিডিয়াতে আরো বলা হয়েছে, “চৈত্রসংক্রান্তির দিন বাংলায় শিব কেন্দ্রিক একটি বিশেষ উৎসব পালিত হয়। এটি “চড়ক পূজা” নামে পরিচিত।
চড়ক পূজা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকোৎসব। চৈত্রের শেষ দিন এ পূজা অনুষ্ঠিত হয় এবং বৈশাখের প্রথম দু-তিন দিনব্যাপী চড়ক পূজার উৎসব চলে।”
“চড়কপূজা উপলক্ষ্যে, আগের দিন চড়ক গাছকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়। তারপর এতে জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ রাখা হয় যা পূজারীদের কাছে “বুড়োশিব” নামে পরিচিত। পতিত ব্রাক্ষণ এ পূজার পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করে। পূজার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হল, কুমিরের পূজা, জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুঁড়ির উপর লাফানো, শিবের বিয়ে, অগ্নি নৃত্য, চড়কগাছে দোলা ইত্যাদি। এইসব পূজার মূলে রয়েছে ভূতপ্রেত ও পুনর্জন্মবাদের উপর বিশ্বাস। এর অনুষ্ঠানাবলী প্রাচীন কৌম সমাজে প্রচলিত নরবলির অনুরূপ। এই উৎসবকে কেন্দ্র করেই দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে যা “চড়ক সংক্রান্তি” বা “চৈত্র সংক্রান্তির মেলা” নামে পরিচিত।”
হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের এসব ঐতিহাসিক তথ্য যেমন সত্যি তেমনি এও সত্যি বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখের উৎসব নিজের মত করে গুছিয়ে নিয়েছে।
এ উপলক্ষে কিছু কিছু বাড়াবাড়ি রয়ে গেছে অবশ্যই। শুধু বাড়াবাড়ি না, কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গেছে।
যে আয়োজন চারদিকে দেখা যাচ্ছে তাতে পহেলা বৈশাখ সার্বজনীন উৎসব এর বদলে বিত্তবানদের উৎসবে পরিনত হচ্ছে ধীরে ধীরে।
গত বিশ বছর আগেও শহুরে মধ্যবিত্ত বাংলা নববর্ষ তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখতো না আর উচ্চবিত্তরাতো নাই ই। বাংলা সন ছিলো গ্রামের মানুষের (চাষাভূষার) সন। তাদের মহাজনের সাথে ঋনের হিসাব করা – ব্যবসায়ীদের হালখাতা করা আর কৃষকদের খাজনা দেওয়ার জন্যে অবশ্যই এই দিনটি তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ন ছিলো।
ছায়ানট মুলত একে টেনে এনেছে শহরে – রবীন্দ্রনাথকে ভর করে মধ্যবিত্তের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছে এই নববর্ষ। ১৯৬৭ সালে প্রথম ছায়ানট রমনার বটমুলে গানের আসর করে – স্বাধীর হওয়ার পর থেকে এর পরিধি বাড়ছে। আর মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয় ১৯৮৯ সাল থেকে – এর উদ্যোক্তার এইটাকে সার্বজনীন ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব হিসাবে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
গ্রামের “বছর পয়লা” শহরে এসে পহেলা বৈশাখ হওয়ার সাথে সাথে নতুন একটা উপসর্গ এসে জড়িয়ে গেছে – তা হলো পান্তা-ইলিশ। বিত্তবানদের ইলিশ কেনার প্রতিযোগীতা আর তার ছবি ফেইসবুকে দেওয়ার রেওয়াজটা যে হাজার বছরের সংস্কৃতি না এইটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিত্তবানদের সম্পদের প্রদর্শনী শুধু যে পহেলা বৈশাখেই হয় তা না -হয় ধর্মীয় উৎসবেও। যাদের অনেক আছে তারা দেখাবে – আর যাদের নাই তারা দেখবে – এইটা অবশ্য হাজার বছরের ঐতিহ্য।
রমজান, ঈদ আর শবেবরাতে এর চেয়ে অনেক বেশী অনিয়ম হয় – যা ইসলামের দৃষ্টিতে কঠিন অন্যায় – আমার মনে হয় যারা ইসলাম নিয়ে ভাবেন – তারা আগে নিজের ঘর সাফ করা উচিত।
পহেলা বৈশাখ ধর্মীয় উৎসব না – সেখানে ধর্ম পালন করতে কেউ যায় না। তার বিষয়ে ফতোয়া দেওয়া মানেই হলো সীমার বাইরে যাওয়া।
বাংলাদেশের নাস্তিকে ইসলামধর্মের প্রতি এতোটাই অসহিষ্ণু যে – অনুষ্টানের আগে এরা নিশ্চিত করে এই ধর্মের অনুসারীরা যথেষ্ঠ বিরক্ত হয়েছে কিনা! এটা খুবই দুঃখজনক আর চরম বাড়াবাড়িও বটে। আর প্রতিটি বাড়াবাড়ি নিয়ে আসে বেদনাদায়ক ঘটনা।
loading...