১.
যুবক ছাত্র হতাশ হয়ে কান্নার স্বরে চিৎকার করে বলছে “একটি লাল গোলাপ যদি উপহার দেই, আমার সাথে নাচবে তবে সে কিন্তু কপাল আমার মন্দ! লাল গোলাপ নেই বাগানে।”
কৃষ্ণচূড়া গাছের লাল, কমলা ফুল হলুদে আঁকা এবং সবুজ পাতা অন্যরকম দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। ওখানে এক পাপিয়া বসে অবাক হয়ে দেখলো, কৃষ্ণচূড়ার তলে হতাশ হয়ে কাঁদছে যুবক, জল চোখের কোনে ফোটায় ফোটা। বলছে, ‘সুখ কতটা সরল! জ্ঞানের কথা যা বইয়ে লেখা নিয়েছি পড়ে। অথচ সামান্য লাল গোলাপ আমার জীবনটা বেহুদা করে তুলছে।’
পাপিয়া বললো, ‘অবশেষে এক সত্যিকারের প্রেমিক পাওয়া গেল। রাতের পর রাত আমি তার গান গাই, যদিও তাকে দেখনি আমি কোনদিন। রাতের পর রাত তারার কাছে যার গল্প বলে যাই, আজ পেলাম তাহার দেখা। চুল তার কুচকুচে কালো, কুঁকড়ানো আর ঠোঁটটি লাল যেন লাল গোলাপ। অথচ চেহারা মলিন, কপাল কুঞ্চিত।’
‘আগামীকাল সন্ধ্যায় শুরু চলবে ভোর পর্যন্ত জন্ম দিনের উৎসব!’ যুবক ছাত্র পাগলের মত চলল বলে- ‘দিয়াছে কথা আমায়, যদি গোলাপ পারি দিতে উপহার তবে সে সকাল পর্যন্ত আমাকে সময় দিবে। রাখবে হাত আমার হাতে, জড়িয়ে নিবে বাহুতে আমাকে, বাহুতে আমার রাখবে মাথা। আমার বাগানে লাল গোলাপ নেই। আমি সারারাত অপার হয়ে রইব বসে একাকী, সামনে দিয়ে চলে যাবে ভালোবাসা, তাকে ছুয়ে দেখার অনুমতি মিলবে না। সে আমার দিকে ফিরেও তাকাবে না, হৃদয় ভেঙ্গে যাবে আমার।’
২.
‘এখানে বাস্তবিক সত্যিকারের প্রেমিক!’ পাপিয়া পিউ পিউ বলে চলল,’ ভালোবাসা সত্যি এক আশ্চর্যজনক অনুভূতি। মনিমুক্তার চেয়ে অমূল্য, পান্নার চেয়ে প্রিয়। কোন কিছু দিয়ে যায় না তারে কিনা, আর না বেচে কেউ তারে হাটে বন্দর শহরে। বড় সওদাগর না পারে সওদা করতে তারে, স্বর্ণের ওজনে যায় না তারে মাপা।’
‘মিউজিক চলবে, নামীদামী ক্লাসিক বাদকের দল’ বলে চলছে যুবক ছাত্র- ‘তালের সেই সূর মূর্ছনায় নাচবে আমার ভালোবাসা। সেই কি নৃত্য! মাটি ছুঁবে না তার পা, ঘিরে থাকবে নানান বর্ণের পোশাক সজ্জিত সহচর-সহচরী। কিন্তু একটু নজর দিবে না সে আমার দিকে, আমার নাই লাল গোলাপ।’ অনন্ত বিলাপ ! যুবক কেঁদে উঠল ফুঁপিয়ে।
পাপিয়ার পিউ পিউ ডাক নকল করে কমলা পেট পাতা বুলবুলি যাকে আমরা অন্য পাখির স্বর নকল করে ডাকতে পারে তাই কমলা পেট হরবোলা বলি, বলল,’ কাঁদছে কেন ছেলেটা?’
রঙিন ডানা মেলে রবিকরে উড়াউড়ি করছিল একটা রঙিন প্রজাপতি। ‘কেন কাঁদছে, কি কারণে, আহারে’ ব্যথিত হয়ে জানতে চাইল।
‘কেন কাঁদছে’ পাশে বাতাসে দুলতে থাকা ফুলের গাছটি মোলায়েম স্বরে চাইল জানতে। পাপিয়া বলল, ‘বুঝবে কেবা, একটা লাল গোলাপে জন্য কাঁদছে প্রেমিক যুবা।’
‘একটা গোলাপের জন্য কাঁদছে! কি হাস্যকর!’ বলে ছেলেটার কান্না নকল করে কমলা পেট পাতা বুলবুলি হরবোলা হাসাহাসি শুরু করে দিল। একটা ব্যপক আমোদ ছড়িয়ে পড়ল বাগানে।
কিন্তু পাপিয়া ছাত্রটির দুঃখের কারণটা অনুধাবন করছে। চুপ করে রইল। সে ভালোবাসার রহস্য খোঁজার চেষ্টা করছে।
৩.
হঠাৎ তার খয়েরী রঙের ডানা বাতাসে মেলে দিল। সে ঘন পল্লবে ঘেরা ছোট গ্রামের উপর দিয়ে ছায়ার মতো উড়ে গেল। সে ছায়ার মতো উড়ে গেল নানা বীথিকা ঘেরা নয়নাভিরাম বাগানের উপর দিয়ে। এই বাগানে একটি গোলাপের গাছ দেখতে পেল। সে গাছে এসে পাখা ঝাপটিয়ে ডালের উপর বসল।
পাপিয়া কাকুতিমিনতি সূরে গাছকে বলল,’আমাকে একটা লাল গোলাপ দাও, আমি তোমাকে আমার সবচেয়ে মিষ্টি গানটি শোনাব।’
গোলাপ গাছ বলল, ‘কিন্তু আমার গোলাপ সাদা। আমার গোলাপ এতটাই সাদা যে মনে হবে সমুদ্রের ফেনা। আর এক জায়গায় পাবে তুমি এমন সাদা যখন বরফে ঢেকে যায় পাহাড়, এক অলৌকিক পবিত্রতায় আর সাদায় উজ্জ্বল হয়ে থাকে। যদি তেমন সাদা গোলাপ চাও তবে নিয়ে নাও। আর যদি তা না চাও তবে ঐ বনে ধারে যাও চলে, সেখানে আমার এক ভাই বসবাস করে, তার কাছে পেতে পারো তুমি যা চাও।’
পাপিয়া বনের ধারে এসে কাকুতিমিনতি সূরে গোলাপ গাছকে বলল, ‘আমাকে একটা লাল গোলাপ দাও, আমি তোমাকে আমার সবচেয়ে মিষ্টি গানটি শোনাব।’
গাছ বলল, ‘আমার গোলাপ হলুদ। মৎস্যকন্যার চুলের মতো হলুদ যা ট্রাফিক সিগনালের মধ্যের বাতিতে উঠে জ্বলে। যদি তুমি তেমন হলুদ গোলাপ চাও তবে নিয়ে নাও। কিন্তু লাল গোলাপ পাবে তুমি ঐ যে প্রফেসরের নিকট ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য পড়াশুনা করছে যে ছাত্রটি তার জানালার পাশে থাকে গোলাপ গাছটিতে। তুমি সেখানে চলে যাও।’
৪.
অবশেষে পাপিয়া প্রেমিক ছাত্রটির জানালার পাশে গোলাপ গাছের ডালে এসে বসল। বলল,’আমাকে একটা লাল গোলাপ দাও, আমি আমার সবচেয়ে মধুরতম গান তোমাকে শুনাব।’
গাছ জানানো, তার গোলাপ লাল। এমন লাল যেন লাল লেজ মৌটুসীর লেজের মত লাল। এমন লাল যা দেখা যায় সমুদ্রের জলে ভেসে বেড়ানো লাল প্রবালের প্রাঞ্জলতায়। তারপর দুঃখের সাথে বলল, ‘কিন্তু এই শীতের ভয়াবহ ঠান্ডায় আমার শিরা মরে গেছে, আমার কুড়ি ঝরে গেছে, আর ঝড়ে ভেঙে গেছে আমার ডাল। হয়ত সারা বছরে ফুল ফুটবে না।’
পাপিয়া অস্থির হয়ে উঠল। বলল, ‘অন্তত একটা লাল ফুল দাও। এটা আমার খুবই দরকার।’
গাছ জানাল, ‘একটা উপায় আছে প্রিয় সহযোগী পাপিয়া। কিন্তু সেটা তোমাকে বলতে মন চাইছে না।’
‘বল আমাকে। কি সেই উপায়। বল তুমি দ্বিধাহীনভাবে।’
‘তবে বলি তোমায় সেই উপায়। একমাত্র তুমি পারো লাল গোলাপ ফোটাতে। তোমাকে গানের শৈল্পিকতা আনতে হবে চন্দ্রকিরণ হতে। আমাতে তা প্রবাহিত করতে হবে তোমার হৃদয়ের রক্ত মিশিয়ে। আমার প্রতি গাইবে তুমি কণ্ঠের চেয়ে হৃদয়ের স্পষ্ট স্পন্দনে। তোমার জীবন রক্ত প্রবাহিত করতে হবে আমার শিরা উপশিরায়।’
‘যেহেতু চাও লাল গোলাপ’, বলল গাছ, ‘চন্দালোকের সংগীতে তা তোমাকে গড়ে তুলতে হবে, তার সাথে মিশাতে হবে তোমার হৃদয়ের লও। কণ্ঠের বিপরীতে বুকের গহীন থেকে গাইতে হবে গান। সারারাত আমার প্রতি নিবেদিত হতে হবে সেই গান। তোমার জীবন রক্ত আমার শিরায় বইতে হবে, হতে হবে আমার।’
‘একটা লাল গোলাপের মূল্য চুকাতে হবে জীবন দিয়ে’ আর্তনাদ করে উঠল পাপিয়া, ‘জীবন সবচেয়ে আপন সকলের কাছে। সবুজ গাছে বসা, স্বর্ণের রথে চড়ে আসা সূর্যের আলো, মুক্তার ঝলমলে আলোর বাহনে আসা চাঁদের কিরণ- কতইনা প্রিয়। এইসব জীবনের তরঙ্গ মধুরতম, তারচেয়েও মধুর ভালোবাসা। ভালোবাসা জীবনের চেয়েও ভালো। মানুষের হৃদয় কি পাখির হৃদয়ের মতো নয়?’
৫.
পাখিটি তার খয়েরী রঙের ডানা মেলে উড়াল দিল এবং বাতাসে সাঁতার কাটলো। সে বাগানের উপর দিয়ে উড়ালপথে চলল কিছু সময়, সে ঘন বনের উপরে কয়েক চক্কর দিল।
ছাত্রটি তখনও ঘাসের উপর শুয়ে আছে যেখানে তার সাথে তার সর্বশেষ কথা হয়েছে। এখনও তার চোখের জল অনবরত ঝরছে।
‘সুখী হও, ‘পাপিয়া বলল,’সুখী হও। তুমি পাবে তোমার কাঙ্খিত লাল গোলাপ। চাদের আলোর মায়াবী কম্পনজাত সংগীতে আমি তাকে জাগিয়ে তুলব আর মিশিয়ে দিব আমার বুকের তাজা রক্তে। এসব এ কারণে করব কারণ তুমি একজন সত্যিকারের প্রেমিক পুরুষ। মনে রেখো ভালোবাসা ফিলোসোফির চেয়ে জ্ঞানী, রাজার চেয়ে ক্ষমতাবান। আগুনের শিখার মতো গায়ের রঙ তার, সেই বর্ণ প্রকাশিত হয় প্রেমিকের দেহে যা আমি খোঁজে পেয়েছি তোমার দেহে।’
যুবক ঘাসে চিৎ হয়ে শুয়ে শুনছিল পাপিয়ার কথা, কিছুই বুঝল না। সে কেবল ফিলোসোফি বইয়ের ভাষাই বুঝতে পারে।
কিন্তু ঐ যে হিজল, তমাল, মহুয়া গাছেরা, তারা বুঝেছিল সেই ভাষা। তারা চুপি চুপি বলে যায় পাপিয়া যেন তার শেষ সময়ের গানটি শুনিয়ে যায়।
হিজল গাছটি ঝিরিঝিরি করে বলে গেল,’যখন তুমি চলে যাবে বড় একা হয়ে যাব। তোমার গান শুনিয়ে যাও আমায়।’
পাপিয়া গেয়ে গেল গান, তার কণ্ঠে যেন অনন্তকালের অনন্য সংগীত বেজে উঠলো।
যুবক চলে গেল তার কামড়াতে।
রাত নেমে এলো চরাচরে। নেমে এলো চাঁদের স্বর্গীয় আলো। পাপিয়ে উড়ে এসে বসল গোলাপ গাছে।
সারারাত ব্যাপী পাপিয়া ডেকে চলল তার হৃদয় ছেড়া গান। রাত বাড়তে থাকলে গভীর থেকে গভীর হলো হৃদয়ের প্রতিধ্বনি, টুকরো টুকরো হয়ে যেতে থাকল পাপিয়ার বুক। যখন স্বর উঠলো চরমে একটা অলৌকিক ফুল ফোটল গোলাপ গাছটায়। গাছ বলে চললো আরও জোরে জোরে গাও, আরও দ্রুত, আরও ঘন। হয়ত নেমে আসবে ভোর, তখনও ফোটবে না পুরো ফুল। পাপিয়া গেয়ে উঠলো আরও আরও জোরে, তন্ময় হয়ে, বুকে তার একটা ব্যাথা জেগে উঠলো, আরও ব্যাথা আরও। তার জীবনের রক্ত বইয়ে গেলো গোলাপ গাছের শিরা উপশিরায়। একটা অফুরন্ত সৌন্দর্যমাখা লাল গোলাপ জেগে উঠলো গাছ জুড়ে। গাছ চিৎকার করে উঠলো, ‘দেখো কি অসাধারণ লাল গোলাপ!’ কিন্তু পাপিয়া নিথর।
৬.
দুপুরে ছাত্রটি জানালা খুলে বাইরে তাকাল। সে চিৎকার করে উঠলো,’ কি আশ্চর্য! কি সৌভাগ্য আমার! এখানে একটি লাল গোলাপ, আমার সারা জীবনে এমন অসাধারণ গোলাপ দেখিনি আমি।’ সে ফুলটি ছিড়ে নিয়ে প্রফেসরের বাসায় হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছল।
প্রফেসরের কন্যা নীল রঙের মখমলের শাড়ি পরে বসে আছে। যুবক বলল, ’তুমি আমায় বলেছিলে যদি লাল গোলাপ এনে দেই, তবে তুমি আমার সাথে নাচবে। দেখো পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ লাল গোলাপ তোমাকে নিবেদন করছি। এটা খোঁপায় পড়ে নাও, এটাই তোমাকে বলে দিবে কতটা ভালোবাসি তোমায়।’
কন্যা বলল, ’আজ আমি যে রঙের শাড়ি পড়েছি, এ ফুলটি তার সাথে ম্যাচিং করবে না, দেখো আমার শাড়ির রঙটি, দেখো।‘
যুবক রেগে গেল,’ তুমি আমাকে বলোনি লাল গোলাপ এনে দিলে তুমি আমাকে ভালোবাসবে। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর লাল গোলাপ এনেছি, আনিনি?’
‘হা বলেছি। তুমি খুবই বিরক্ত করছিলে, পাগলের মতো করছিলে। তাই বলেছি। দেখো, তুমি এখন যাও, বাবার কামড়ায় বসে আছে তার পছন্দের এক ছাত্র , সে এনেছে আমার জন্য মুক্তোর নেকলেস। সে এখন সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আর তুমি এনেছো সামান্য গোলাপ। তুমি কি? তুমি একজন সাধারণত ছাত্র মাত্র।’
ছাত্রটি লাল গোলাপ ছুড়ে ফেললো রাস্তায়, একটা বাচ্চা ছেলের সাইকেলের চাকার নিচে পড়ে থেতলে গেল।
ছাত্রটি হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো। মনে মনে বলছে, ‘প্রেম কত বিরক্তিকর জিনিস। এর অর্ধেকটাও যুক্তি যুক্ত নয়। এটা কিচ্ছু প্রমাণ করে না। সব সময় এমন কথা বলে যা কখনো ঘটে না। এটা এমন কথা বলে যা সত্যি নয়। এটা একেবারে অবাস্তব। আমাকে প্রতিটি ব্যাপারে বাস্তবমূখী হতে হবে। আমি আমার ফিলোসোফি আর মেটাফিজিক্সে ফিরে যাব।’
বাড়ি ফিরে যুবক ধুলোমাখা বইগুলো টেনে নিল আবার পড়া শুরু করল।
সমাপ্ত।
loading...
loading...
অসাধারণ উপস্থাপন
ভাল লাগছে
loading...
শুভ সকাল। ধারাবাহিকের প্রথম পর্বের লিখাটি পড়লাম মি. ফকির আবদুল মালেক।
যেটা মনে হয়েছে … শীর্ষক লিখার এখানে কবিমনের সাথে কবিজনের একান্ত কথোপকথন। প্রকৃতি আর চরিত্রদের সাথে অনুভব গুলোন যেন অনন্ত গভীরে মিশে গেছে।
loading...
অপূর্ব প্রকাশ পেয়েছে গল্প খানি।।।।
শুভকামনা রইল।
loading...
ঈদের শুভেচ্ছা জানবেন মালেক ভাই।
loading...
খুব ভালো লাগলো। আগাম ঈদুল আজহা’র শুভেচ্ছা রইলো।
loading...
অসাধারণ মনোমুগ্ধকর লেখা
অসামান্য সৃজন_______♥♥
loading...