গৃহপালিত শিক্ষক

গৃহপালিত শিক্ষক

আকাশ কালো মেঘে ডাকা। কয়েক দিন যাবত বর্ষণ চলছে। জলের ধারা বইছে অবিরল ধারায়। বাংলার বর্ষা এমন ঋতু সৌন্দর্য যার স্পষ্ট হয়ে উঠে সকলের কাছে। এ যেন যৌবনের সৌন্দর্য। ঝটপট গোসল করে নাও জলের ধারায়, উদ্দম গতিতে ছুটে চলো যেখানে মৃত্যু এসে হানা দিয়েছে নানা রূপে তাকে ভিজিয়ে দাও, সৃষ্টিশীলতার উদ্দমতা দেখতে পাও। এই তো বর্ষা, এইতো যৌবন। এখানে রূপের চর্চা করতে হয় না কৌটা কৌটা কুয়াশার প্রসাধনে।

সদ্য ভিজা প্রকৃতির মতো লাবন্যতা আফসানার ত্বকে, রঙটা শ্যামলা, উজ্জল শ্যাম যাকে বলা যায়। কৃশকায় মেয়েরা প্রসাদনের প্রলেপে নিজেকে যেভাবে পন্যের বিজ্ঞাপনের মডেলদের মতো বানিজ্যিক আবয়বে গড়ে তুলে আফসানা সেভাবে সাজে না কখনো, একটু মোটা বলা যায়, গোলগাল, হাসলে চমৎকার টোল পরে গালে। একটু আগে পরিচ্ছন্ন হয়েছে, কোন প্রসাদনী মাখেনি চেহারায়, যেন ভিজা কচু পাতার টলটলে পবিত্রতা ফুটে উঠেছে সারা অঙ্গ জুড়ে। লম্বা ঘন কালো চুলে ফিতার বন্ধনের শৃঙ্খলা টেনে দেয়নি, চিরুনীর আচড়ে পরিপাটি করে ছেড়ে দিয়েছে পিঠের উপর। বাইরের প্রকৃতির এক অনবদ্য সংস্করণ হয়ে বসে আছে স্থির। বাইরে যে কেউ দেখলে হয়ত ভাববে একটানা বর্ষনের পর সৌম্য প্রকৃতির মতো শান্ত সে কিন্তু তার হৃদয়ে বয়ে চলছে অস্থিরতা। সন্ধ্যার পর এই সময়টাতে এই অস্থিরতা তাকে পেয়ে বসে। দেয়াল ঘড়িটার দিকে কিছুক্ষণ পর পর তাকায় যেন সেকেন্ডের কাটাটা মিনিটের কাটা হয়ে যায়। ঠিক সাতটয় স্যার আসবেন, সময় যায় সে তো আর আসে না।

ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল জ্যামিতি পাঠ নিতে গিয়ে। জ্যামিতির সম্পাদ্য আকার সময় একটু ছুয়ে যায় হাত স্যারের হাতে, একটা বিদ্যুত তরঙ্গ বয়ে চলে, সরিয়ে নেয় না আফসানা। আর স্যারটাও হঠাৎ সম্পাদ্য শিখানোর ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠে প্রবল ভাবে। একদিন এমনি ছল করে হাত ছুতে ছুতে ধরে রাখে আফসানার হাত।

এক শীত সন্ধ্যায় ঘটে এমনি ক্ষুদ্র আর একটি ঘটনা। ফ্লোরটা ঠান্ডা ছিল। পা দু’টি কোথায় রাখবে খুজে পায় না আফসানা। টেবিলের নিচে আর একজোড়া পা ছিল স্থির। পা দুটি রাখতে রাখতে সেই পায়ের উপর গিয়ে পড়ে, গরম, শীত প্রতিরোধক। সরিয়ে নেয় না পা গরম পা দুটি। এভাবে দুটি দেহের প্রধান কিছু অংশ পরস্পরকে উত্তাপ দিতে থাকে।

ন্ধদয় কি কিছু হয়েছিল বিনিময়? আফসানা জানে না। শুধু এক একটা দুপুর আসে কখনও, আব্বু অফিসে যান, আর আম্মু থাকেন আহার পরবর্তী নিদ্রায় আর ছোট ভাইটা থাকে কোন মাঠে খেলায় মগ্ন , সেই সব নিরব সময়ে তার রবীন্দ্র সংগীত বড় ভালো লাগে আর তার স্যারকে বড় দেখতে ইচ্ছা করে, বড় দেখতে ইচ্ছা করে। এইসব ভালো লাগা আর হৃদয়ের অস্থিরতাগুলো সযতনে লুকিয়ে রাখে আফসানা। কিন্তু সেই কোন দুরে সমুদ্রে বয় লঘু চাপ আর তার প্রভাবে ঝড়ের তান্ডবে মেতে উঠে সমস্ত তীরাঞ্চল তেমনি আফসানার হৃদয়ের অবস্থাটা লুকিয়ে রাখতে পারে না কামরুন আন্টির কাছে। ঠিক টের পেয়ে যান।

এই আন্টি পান খেয়ে ঠোট লাল করে রাখেন না, বয়সের প্রভেদটাও আফসানার চেয়ে খুব বেশী নয়, আফসানার বান্ধবী সমতুল্য, বুঝতে পারে আফসানা একটা অস্থিরতার ভিতর দিয়ে সময় কাটাচ্ছে। তিনি টের পান একটা হৃদয় ঘটিত কুয়াশা তাকে ঢেকে রেখেছে, তিনি ভুমিকা নেন সুর্য্যের তাপের। হায় সূর্য্য! কখনো কখনো তুমি নাও খল নায়কের ভুমিকা। কুয়াশার মায়ায় যখন সারা প্রকৃতি মোহাচ্ছন্ন তখন তোমার তাপে কেটে দাও সেই সব মোহগ্রস্থতা।

একদিন আকাশে চাঁদ উঠেছে বাহারী। আর বাতাস বইছিল মৃদুমন্দ। আন্টি আফসানকে নিয়ে যান ছাদে। বলেন: ভালোবাসিস কাউকে? আমাকে লুকাবি কি? বলে রাখি পস্তাবি বহুত। এইসব গৃহ পালিত শিক্ষকদের তো চিনি, টিউশনি করতে এসে পটিয়ে ফেলে ছাত্রীকে, তারপর ! তারপর ? বল, তোর বাপকি রাজি হবে, হবে না । পালিয়ে যাবি? কোন দিন কি সে দিতে পারবে তোর মতো মেয়ের যথার্থ মর্যদা। পরবে না। কোন দিন পারবে না।
আফসানা কোন উত্তর দেয় নি, আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাসভাবে শুধু বলেছিল- কেন তার জীবনটা এমন হলো? একজন গৃহপালিত শিক্ষক যে মুখ ফুটে কথা বলতে পারে না, মিশতে পারে না, জোর করে দখল নিতে পারে না তার জন্য কেন সে এতটা কান্না কাঁদবে। কিছু না শুধু একবার হাত ধরতে চয়েছিল সে, আফসানা সরিয়ে নিয়েছিল। কি বুঝেছিল, এর পর আর একটি বারের জন্য আসেনি পড়াতে। বাসায় গিয়ে খোঁজ নিয়েছিল আফসানা , জানতে পায় সে চলে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে, কোন যোগাযোগ আর রাখলো না।

এক একবার মনে হয় হলে গিয়ে উঠবে সে, কি অবাক হবে, হাত বাড়িয়ে বলবে , ধরো হাত হে আমার গৃহপালিত শিক্ষক, সারাজীবনের জন্য ধরে রেখো, পারবে তো? পরক্ষনে আবার ভাবে থাক না হৃদয়ের ভিতর কিছু ক্ষত আজন্মের, মাঝে মাঝে খুটিয়ে খুটিয়ে বেদনা জাগিয়ে তুলবে আর প্রাণ ভরে কাঁদবে একাকী নিভৃতে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৯ টি মন্তব্য (লেখকের ৪টি) | ৪ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৮-০৩-২০১৭ | ১৪:৩৫ |

    স্বতন্ত্র ধারার গল্পটি পড়লাম প্রিয় গল্পকার ফকির আব্দুল মালেক। ভালো। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
  2. আনু আনোয়ার : ১৮-০৩-২০১৭ | ১৬:২৫ |

    সুন্দর লেগেছে। বেশ সুন্দর। কিছু জিনিসের উল্লেখ না করলে মন্তব্য অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, যেমনঃ ভিজা কচু পাতার টলটলে পবিত্রতা

    শুভেচ্ছা নিবেন স্যার।

    GD Star Rating
    loading...
    • ফকির আবদুল মালেক : ১৮-০৩-২০১৭ | ১৯:১৮ |

      এই লেখাটায় গল্পতো কিছু নেই তবে এর বর্ণনা সুন্দর। ধন্যবাদ।

      GD Star Rating
      loading...
  3. নীল সঞ্চিতা : ১৮-০৩-২০১৭ | ১৭:১৯ |

    https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_cool.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • নীল সঞ্চিতা : ১৮-০৩-২০১৭ | ১৭:২১ |

      যা হয়েছে ভালই হয়েছে। গৃহপালিত শিক্ষকের জন্য এত মায়া ভাল না!

      GD Star Rating
      loading...
  4. মোঃ খালিদ উমর : ১৮-০৩-২০১৭ | ২২:৩৯ |

    কান্নার জন্যেও একটু কারণ চাই, শুধু শুধু কি আর কান্না করা যায়? চোখের জল খুব সহজেই বয়ে যায় বলে কি আর সহজে পাওয়া যায়? যায় না। অন্তত গৃহপালিত শিক্ষকের জন্য এটুক তোলা থাক।

    GD Star Rating
    loading...
    • ফকির আবদুল মালেক : ১৯-০৩-২০১৭ | ৮:১৯ |

      আসলে কে যে কখন কি কারণে নিভৃতে কাদে কেউ বলতে পারে না।

      আহারে মানুষের জীবন কত অপূর্ণতা দিয়ে সাজানো।

      ভাল থাকবেন।

      GD Star Rating
      loading...