আরেক পূর্ণিমা
১.
রহিম শেখর ব্যবসাটা পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া। সম্প্রসারিত ব্যবসার কর্ণধার হয়ে ওঠা বংশানুক্রমিকভাবে। যখন লাভজনক, মহা আনন্দ। ইয়ার বন্ধুদের আড্ডায় সময় কাটানো, জুয়া খেলায় প্রচন্ড ঝুকি নেয়া। গাজা আর মদের নেশার সাথে মেয়ে মানুষের দোষও আছে তার। কিন্তু এখন খারাপ সময়! পাঁচটা ইটের খোলায় উৎপাদিত ইটে বিশাল লোকসানের আশংকা দেখা দিয়েছে। ইটের কোয়ালিটির কারণে যে সব পার্টি থেকে সে এডভান্স নিয়েছে তারাও ইটের ডেলিভারী নিতে চাইছে না। একটি বিশাল লোকসানের আশংকায় রহিম শেখ অস্থির হয়ে আছে।
পীর ফকিরের দোয়া সে কম নেয় নি। পানি পড়া, তাবিজ কবজ দিয়েছে বহুত। আজকে সে ফকির বাবার কাছে এসেছে একটা হেস্ত নেস্ত করতে । রহিম শেখ কোন ধর্মীয় বা আত্মাতিকতার খুজে এখানে আসে না, এখানে আসে বৈষয়িক লাভের আশায়। কিন্তু আজকে ফকির বাবা যা বললেন তাতে রহিম শেখ কেঁপে উঠল। সে সিগারেটের প্যাকেটে হাত দিল। আছে, সিগারেটের সাথে একটাঁ বোঁচা সিগারেটও আছে। সিগারেটের ছুক্কায় গাজা মিশিয়ে খালি ঠোসের ভিতর ভরে রাখে। তারই একটি বের করে কষে দুটি টান দিল সে। আরো কয়েকটি। মাথাটা পরিস্কার হয়ে গেল।
সস্তা নেশা গাজা। মদ, ফেনসিডিলের নেশা করলেও গাজাকে সে ত্যাগ করতে পারেনি। আরো কয়েকটি জোড়ে টান দিল। ফকিরের আখড়া থেকে বের হয়ে তার গাড়ীর দিকে যেতে যেতে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল শেষ চেষ্টাটা সে করবেই।
পুরানো মডেলের গাড়ীটি সে বদলাতে পারে নি। কতদিন সে ভেবেছে এই মওসুমটা শেষ হলেই নতুন মডেলের গাড়ি কিনবে কিন্তু দিন যায়, গাড়ী পুরানো হয়, নতুন মডেল আর আসে না। এবার হবে, পীর বাবার শেষ চেষ্টায় এবার হবে। সে হাটতে হাটতে গাড়ীতে উঠল।
ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করল ’’ কোন দিকে যাব, স্যার”
রহিম শেখ শুধু বলল- জাহান্নামে…
স্যারের এই গতিবিধি ড্রাইভারের চেনা। সে গাড়ীতে ষ্ট্রাট দিল।
২.
একটা ঘুঘু একটানা ডেকে যাচ্ছে হিজল গাছটার ডালে। হাম্বা হাম্বা স্বরে গরু যাচ্ছে মাঠে কৃষাণের পাজনের তাগাদায়। স্বামীর ঘরহারা এক মেয়ে নিচু জমিটাতে রঙিন সুতা শুকাচ্ছে। এটা তাতী এলাকা। বান্ডিল বান্ডিল সুতা এখানে হাতে রঙ করা হয়, তারপর বাঁশের তৈরি মাচায় বিছিয়ে দেয়া হয় রোদে শুকানোর জন্য।
নিচু জমিটার পাশ দিয়েই চলে গেছে উচু মাটির রাস্তা, রাস্তার পাশেই মুদির দোকান। গ্রামের সমস্ত আড্ডার কেন্দ্র বিন্দু এই মুদির দোকানটি। আর এই দোকানটিই হচ্ছে এই গ্রামের রাজনীতির মুল আড্ডা। মসজিদ কমিটির লোকদের প্রতি পদে পদে যে দোষগুলো ভেসে ওঠে তা দৃশ্যমান হয় এই আড্ডা থেকে। গ্রামে কোন মেয়ে কার সাথে শুইল আর ধরা খেয়ে নাজেহাল হলো সব খবর পাওয়া যাবে এখানে এলে।
এইসব চর্চার বাইরে তোতা মিয়া তাদের এক বিনোদন। ছেলেটি শরীরে বৃদ্ধি পেলেও মানসিক ভাবে বৃদ্ধি পায়নি। তার শিশু সলুভ কথাবার্তা সকলে উপভোগ করে। রহিম শেখের পৈত্রিক ভিটা বাড়িটা এই গ্রামে। তোতা মিয়ার বাবা এই বাড়িটি দেখাশোনা করে।
অন্যান্য দিনের মতো দিনটি শুরু হলেও এখন বইয়ে চলছে আনন্দ হিল্লোল। তিনটি হিজড়ার আগমন গ্রামখানিকে হাসিতে আলোকিত করে তুলছে। সকলেই মগ্ন ছিল চা পানে আর প্রতি দিনকার চর্চায়। হঠাৎ একজন এসে তোতা মিয়া পাশে বসে পড়লো, হাতে তালি দিয়ে, পুরুষ কন্ঠের নারী সলুভ ভঙ্গিতে বলল-ওরে আমার নাগর রে, বলনা কি নাম?
– তোতা..
– আরে আমার তোতা পাখি, বল না, তোরে কি নামে ডাকি, উড়াল দিবি নাতো।
মুহুর্তের মধ্যে এক আনন্দের শোরগোল পড়ে গেল। আজকের এই দিনটাতে সমস্ত গ্রাম থেকে কোন্দল উঠে গেল, কোন মেয়ে কার সাথে লটর পটর করল তার আলোচনা স্থগিত হয়ে পড়ল, ঐ যে বৃদ্ধা বসুর মা লাঠিতে বর করে হাটে, সেও এসে ফোকলাপ দাতে কয়-
– এই ছিনালরা তগো লাজ শরম নাই, বেহাইয়া যত…
– ওলো বুড়ি , আমার জান, ও মোরে প্রাণ… বলে বুকে হাত রেখে বলে- সবগুলো বুক দেখতাছ বুড়ি , সবগুলা কাগজের ফুল। আমাগো কাহিল নাই, সাইট নাই , বাড়া বানবো কইলো সই….
বলে তোতা মিয়াকে জড়িয়ে ধরে। একটা অট্টহাসির হিল্লোল বয়ে চলে। এই দলটি যেখানেই যায় তোতা মিয়াকে সাথে নিয়ে যায় আর ছড়িয়ে দিতে থাকে হাসির ফোয়ারা।
হঠাৎ তোতা মিয়া খেয়াল করল সে গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছে। জনহীন প্রান্তরে যে দিকটায় রহিম শেখের ইটের খোলা সে দিকে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা নেমে এলো প্রায়। তোতা মিয়ার কোন পরিবর্তন খেয়াল করা গেল না সে হেসে এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু হিজড়া তিনটির প্রকৃতি বদলে গেল, তারা বেশ চঞ্চল হয়ে পরস্পর কথা বলতে লাগল।
৩.
রাত্রি দ্বিপ্রহর। পুর্ণিমার চাঁদ মধ্য গগনে আকাশের একটা চোখ হয়ে জ্বল জ্বল করে জ্বলতে থাকলো। সাঁই সাঁই শব্দে বাদুর উড়ে গেল। আরো দুরের গোরস্থান থেকে শিয়ালের হুক্কা হুয়া ভেসে আসছে।
তোতা মিয়ার হাত-পা বাঁধা। চিৎ হয়ে আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে মাটিতে। মনে হচ্ছে যুগ যুগ ধরে এখানে পড়ে আছে সে। মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে … মা , মাগো…।
দুচোখ বেয়ে জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে অনবরত। ওরা তিনজন যখন তোতাকে বেধে ফেলেছিল তখন সে বার বার অবাক বিস্ময়ে বলছিল- আমারে বানছেন কেন্ ? আমারে কোরবানীর গরুর মতো বানছেন কেন্?
একজন বলল- তোকে কোরবানী দেয়া হবে, আল্লা খোদার নাম নে। আর আমাগো মাপ করে দিস…
ভয়ে থরো থরো কাঁপছে তোতা মিয়া। মাঝে মাঝে শুধু বলছে… মা, মাগো…
আকাশে পূর্নিমার চাঁদখানি চামৎকার হাসছিল। হঠাৎ একটি রক্তের ফিনকি এসে পড়ল ুনাকি তার শরীরে ? অবাক বিস্ময়ে আর আহত দৃষ্টি নিয়ে সে তাকিয়ে আছে খোলা এই প্রান্তরটি দিকে। এক টুকরা মেঘ ভেসে গেল তার উপর দিয়ে । নিচ থেকে দেখলে মনে হতে পারে চাঁদখানি থরো থরো কাঁপছে।
৪.
গত মওসুমটা শেষ পর্যন্ত বেশ ভালো গেল রহিম শেখের। হঠাৎ ইটের দাম বেড়ে গেল। তার যে ইট জমা পড়ে ছিল, বিক্রি করতে পারছিল না তা-ই শেষ পর্যন্ত তার হাতে প্রচুর টাকা এনে দিল।
ড্রাইভার ইটের খোলার পাশে এসে গাড়ীটা থামাল। পুরানো মডলের গাড়ি। নতুন গাড়ি কবে হবে কে জানে!
আরেক পূর্ণিমা। থৈ থৈ জোস্নার প্লাবনে ভেসে যাচ্ছে সমস্ত প্রকৃতি। গাড়ী থেকে রহিম শেখ ও ফকির বাবা নামল।
ফকির বলছেন- এই বার এমন তাবিজ দিব আপনার সব ফাড়া দুর হইয়া যাইব।
রহিম শেখ হাসছে, তার কানে ভাসছে গত মওসুমে বলা ফকিরের কথা…
নর-বলী দাও। মানুষের রক্তে তাজা হয় অর্থ আর ক্ষমতা।
ঘোরতর বিশ্বাসে রহিম শেখ ভাবে, এবার তবে চলুক নিজ হাতে রক্তপ্লাবন।
রহিম শেখ আর ফকির এগিয়ে চলছে। বেশ দুরে তাদের পিছন পিছন আসছে ড্রাইভার। তার হাতে একটা ব্যাগ। হাঠাৎ হাত দিয়ে ড্রাইভার ব্যাগটা পরীক্ষা করল। কোরবানীর ছুরিটা আর দড়িগুলো ঠিক মতোই আছে। দূর হতে কয়েকটি খিল খিল হাসি ভেসে আসলো। দাঁড়ালো ড্রাইভার। চারিদিকে খেয়াল করল সে। না, কোথাও কেউ নেই …
loading...
loading...
সুন্দর
loading...
ধন্যবাদ
loading...
মূল ক্যারেক্টার আশেপাশে জানাশোনা নামে পরিচিত লাগায় গল্পটি হৃদয়গ্রাহী মনে হলো। আগের গল্পদ্বয় ভালো হলেও গল্প নায়কের নাম অপরিচিত হওয়ায় তেমনটা মনে হয়নি। এই লিখাটি থিম ভালো লেগেছে প্রিয় বন্ধু ফকির আব্দুল মালেক।
loading...
ধন্যবাদ মুরব্বী আপনার মতামত দেয়ার জন্য।
আপনার মতামত অন্য অনেকের মতো আমার কাছেও অনেকটাই গুরত্বপূর্ণ।
loading...
ধন্যবাদ জনাব।
loading...
গতানুগতিক কাহিনী উঠে এসেছে এক অনুপম ধারায়, নামাজ শেষ করে খেতে যাব কিন্তু এখানে আটকে গেলাম শেষ না করে উঠতে পারলাম না। বেশ গোছানো।
loading...
ধন্যবাদ খালিদ ভাই।
এই যে আপনি উঠতে পারলেন না এ যে কত বড় পাওনা—
আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি।
loading...
বেশ লাগল।
বর্ণনা চমৎকার। শুরু করে শেষ করতেই হল।
শুভেচ্ছা নিবেন, প্রিয়।
loading...
ধন্যবাদ। যখন বুঝা যায় যে কেউ পুরো লেখাটি একটানে পড়ে নিয়েছেন তখন আমি ভাবি আামার লেখাটি স্বার্থক হয়েছে।
এই অর্থে এই গল্পটি স্বার্থক।
শুভ কামনা আপনার জন্য।
loading...
আমার একটা বদঅভ্যাস আছে সেই ছোট বেলা থেকে। কোন বই হাতে পেলে আগে তার শেষের পাতা পড়ে ফেলি। শেষটা ভাল লাগলে শুরু থেকে শুরু করি।
কাজের ফাঁকে আপনার এই লেখায় ঢুকে শুরুর দুই লাইন পড়ার পর স্ক্রল করে নিচের প্যারায় চলে এসেছিলাম কি আছে দেখার জন্য। শেষটা এমন যে আমাকে আবার শুরুতে গিয়ে পুরোটা পড়ে আবার শেষে আসতে হল।
অনেক ভাল লেগেছে, কষ্টও লেগেছে তোতা মিয়ার জন্য।
loading...
আপনার এই ফর্মুলাটা আমি ইউটিউবে বাংলা ছবি দেখতে ফলো করি … কয়েক দিন আগেও বাংলা ছবি নিয়ে আমার এরকম একটা অভ্যাস ছিলো ২ ঘন্টার ছবি ৫ মিনিটে শেষ করার …।
loading...
@ নীল
আপনার পাঠের সিস্টেমে গল্পটি উত্ রে গেছে অর্থাত্ পাশ করেছে জানতে পেরে আমার গল্প লেখার আগ্রহ অনেকগুন বেড়ে গেল। ফিনিশিং টা কিন্তু অসাধারণ হতে হবে!!
@ ধন্যবাদ এখানে আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য।
(আমার পোষ্টে মন্তব্য বাড়ল একটা। ফাও পাওয়া। হা হা হা)
loading...
গল্পের পটভুমি টা কি নরসিংদী …
loading...
আমি নরসিংদী এলাকায় ( মাধবদীর কাছাকাছি) ব্যবসা করি কাপড়ের। গল্পের পরিবেশ এখন আর নেই যদিও আপনি এলাকাটি ঠিকই চিহ্ণিত করতে পেরেছেন। আপনি এই এলাকার নাকি?
loading...
আমি নরসিংদীর পাশের জেলাতে কর্মোপলক্ষে ছয় বছর ছিলাম । আমার কয়েকজন সহকর্মী ছিলো নরসিংদীর সে কারনেই …।
loading...
লিখাটি থিম ভালো
loading...
তার মানে কি ধরে নিব উপস্থাপনা ভাল নয়?
ধন্যবাদ আপনাকে গল্পটি পড়ার জন্য। আপনাকে কি দেই, কি দেই?
আচ্ছা এই নিন
loading...