গোয়াল ঘরে যখন আগুন লাগল তখন সোহেল তার মায়ের সাথে তর্ক করছিল।
গফুর আর সোহেলের চিন্তা ভাবনায় অনেক মিল থাকলেও মায়ের সাথে সোহেলের প্রায়ই তর্ক বেধে যায়। গফুরের মা যখন বলল, তগো ঢং দেইখ্খা আর বাচি না। বলি গফুর কি একলাই বাপ অইব নাকি? দুইন্না জুইরা আর মানইষের কি আর পোলাপান অয় না। কয়দিন পর পর অই ডাক্তার হেই ডাক্তার, কই, টাহাডা আহে কই তন?
সোহেল বলে- দ্যোখ মা বেশি কতা কইবা না কইয়া দিলাম। কয়েকদিনে মধ্যে ভাবীর বাচ্চা অইব, অহন কি আর টাহার দিহে চাইয়া থাকলে অইব নাহি?
: কেন অইব না? তোরা কি অছ নাই? তগো কি আমি পেটে ধরি নাই নাহি?
: তোমাগ দিন গেছে গা, এহন সরকারী হাসপাতাল অইছে, ডাক্তাররা কত চিকিস্যা করে। কত সুন্দর সুন্দর কতা কয়।
: তা তরা সুন্দর কতা হাজার শুনগা, কিন্তুক মহাজনী টাকা ধার লইয়া তরা যে বাহাদুরি দেখাইতছ তা ভালা অইব না বইল্লা দিলাম। টাহা শুধাবি কেমনে? জানি না কি অলক্ষীই না ঘরে আইতাছে! পথের ফকির বানাইয়া ছাড়ব।
সোহেল আর কোন কথা বলল না। বর্ষার পানি নামতে শুরু করেছে। পুটি মাছের ‘মাইর’ পড়ছে। গত কয়েক দিনে পলো ভরে ভরে মাছ নিয়ে আসছে গফুর। অন্যসব মানুষেরা যেখানে অভাবে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে গত কয়েক মাসে গফুরের আয় বেশ ভালই হচ্ছিল। সোহেল ভাবে হয়ত নতুন কেউ আসছে বলেই তাদের দিন বদলাতে শুরু করেছে। পুটি মাছগুলো রোদ্রে দিয়ে শুটকি করছে তারা। তার মা শুটকিগুলোর দিকেই যাচ্ছিল। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, অ গফুর রে … অ সোহেল রে … এদিকে আয় রে … আগুন আগুন … আগুন…
মুহুর্তের মধ্যে সোহেল দৌড়ে গেল গোয়াল ঘরের দিকে। গোয়াল ঘরের পিছন দিকে নাড়া আর কুটার স্তুপের মধ্যে আগুল লেগেছে। ধাউ ধাউ করে জ্বলে উঠছে আগুনের লেলিহান শিখা। কোথা থেকে বাতাস বইতে শুরু করল। সোহেল লক্ষ্য করেছে যখনই কখনো কোথাও আগুল লেগে যায় তখন একটা বাতাস বইতে শুরু করে। মুরব্বীরা বলেন অশরীরী বাতাস । বাতাসের প্রবাহ বেড়ে গেলে সে আগুল গোয়াল ঘরের পাটকাঠিতে তৈরী বেড়াতে লেগে যায়। কিছু ক্ষনের মধ্যে একটা হুলস্থুল কান্ড ঘটে গেল। যুবক, যুবতী, বালক, বৃদ্ধ সকলে আগুন নিভানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সমস্ত উঠান জুড়ে মানুষের ছুটাছুটি। ছাগলগুলো দৌড়ে পালাল, মুরগীগুলো কক কক করে ছুটে গেল কিন্তু একটি গরুর হাম্বা হাম্বা করে গগন বিদারী চিৎকার করে যাচ্ছে সেদিকে কারোরই খেয়াল রইল না।
কয়েক দিন যাবৎ তারামনের শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। শরীর ভারী হয়ে গেছে। হাত পা ফুলে উঠেছে। পেটের আকার এতটা বড় হয়ে উঠেছে যে নড়তেই বেশ বেগ পেতে হয় তার। শুয়ে ছিল তারামন। হঠাৎ আগুন আগুন চিৎকারে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম ভাঙ্গতেই তুমুল হৈ চৈ-এ দিশেহারা হয়ে গেল তারামন। কিন্তু এইসব চিৎকার চেচামেচি ছাড়িয়ে তার গরুর হাম্বা হাম্বা চিৎকারটা কানে ধাক্কা দিতে থাকল। ঘর থেকে বেরিয়ে গোয়াল ঘরের দিকে চোখ যেতেই দেখতে পেল গায়ের মধ্যে আগুন নিয়ে তাদের গরুটি এলোপাথাড়ি লাফাচ্ছে। তারামন তার নিজের কথা ভুলে গেল। প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে এলো, চিৎকার করে বলল- অ সোহেল রে তোর ভাই গেল কইরে? গরুডারে বাচারে! গরুডার গায়েতো আগুন লাইগা গেছে রে।
এতক্ষন আগুন নিভাতে যেয়ে কেউ খেয়াল করছিল না গরুটার দিকে। তারামনের চিৎকারে সকলে তাকিয়ে দেখল এক বিভষৎ দৃশ্য। গরুটা সারা গা ঝলসে গেছে। পুরা মাংসগুলো দেখা যাচ্ছে।
তারামন প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে আসতে গিয়ে টের পেল তার পেটে ভিষন ব্যাথা হচ্ছে। বসে পড়ল । ব্যাথা ক্রমে বেড়ে উঠায় উঠানে মধ্যে শুয়ে পড়ল সে।
তারামনের শাশুড়ি দৌড়ে এলো, বলল- এই শরীর নিয়া দৌড় দিলি কেনরে। এখন কি হইব রে … অ সোহেল রে… অ গফুর রে….
আগুনের খবর পেয়ে এসেছে মাষ্টার সাব, এসেছেন মসজিদের ঈমাম, মাতবর, মেম্বার আরো অনেকে। এসেছে বয়সের ভারে প্রায় নুয়ে পড়া জরিমুনের মা। বিশ-বাইশ বছর যাবৎ এই গ্রাম সেই গ্রামে দাইয়ের কাজ করেছে জরিমুনের মা। এখন আর লোকে তাকে তেমন ডাকে না। সকলে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দৌঁড়ায়। সামন্য সমস্যা হলেই স্বাস্থ্য কর্মীর মেয়েটাকে লোকে খবর দেয়। জরিমুনের মা দেখলেন তারামন শুয়ে আছে উঠানে আর ব্যাথায় কোকড়ে কোকড়ে যাচ্ছে। জরিমুনের মা দৌড়ে এল। এখন তার দিন নেই অথচ কি দিন গেছে তার। তিন গ্রাম দুর থেকে লোক এসে তাকে নিয়ে যেত। বাচ্চা হলে টাকা আর নতুন কাপড় দিত। কখনও যে অঘটন ঘটেনি তা নয়। তখন সকলের অগোচরে বেরিয়ে আসতো । লোকে জিজ্ঞাসা করলে জরিমুনের মা বলতো, সব আল্লার ইচ্ছা। আমরা কি পারি? সকলে মেনে নিত তার কথা। কিন্তু এখন আর শুধু উপরওয়ালার ইচ্ছার দিকে বসে থাকে না। সকলেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দিকে দৌড়ায়, তাকে কেউ ডাকে না ।
একটা মানসিক জটিলতায় ভুগতে থাকে জরিমুনের মা। সে কি যাবে এই পোয়াতি মেয়েটার দিকে? না কি অপেক্ষা করবে, কেউ ডাকে কিনা তার অপেক্ষা করবে। কিন্তু দীর্ঘ দিনে অভিজ্ঞতায় দাই বুঝতে পারে এখন অভিমানের সময় না। ব্যাথা উঠে গেছে আর দেরি করা যায় না। তাড়াতাড়ি তারামনের কাছে যেতেই সে টের পেল যে, পানি ভেঙ্গে গেছে। যে আবরনের ভিতর মানব শিশু পরম নিশ্চিন্তে বেড়ে উঠছিল তার অবসান হয়ে গেছে। ভেঙ্গে গেছে নিরাপত্তা বেষ্টনী। এখন দ্রুততম সময়ের মধ্যে যদি বাচ্চার আগমন পথ তৈরী করে দেয়া না যায় তবে ঘটে যাবে অঘটন।
সকলে ধরাধরি করে তারামনকে ভিতরে নিয়ে গেল।
গফুর বিলে গিয়েছিল মাছ ধরতে । পানি নেমে যাচ্ছে দ্রুত। এখন খালগুলি দিয়ে মাছের ঝাকেরা নেমে যাচ্ছে নিম্নমুখী স্রোতের দিকে। এখন পলো দিয়ে কাড়িকাড়ি মাছ ধরা যায়। যাবার সময় বারবার জিজ্ঞাসা করেছে সে তারামনকে কোন খারাপ লাগছে কিনা। তারামন তাকে নিশ্চিন্তে যেতে দিয়েছে আর ডাক্তাররা ডেলিভারীর যে তারিখ দিয়েছে তার আরো এক সপ্তাহ বাকি। অনেক মাছ পেয়েছে সে আজ। গত কয়েক মাসে সে যত মাছ পেয়েছে সারা জীবনেও তা পায় নাই। বেশ খুশি মনে বাড়ি ফিরছিল গফুর। কিন্তু পাড়ায় ঢুকার পথে দোকানটার সামনে আসতেই লোকেরা জানাল যে, তার বাড়িতে আগুন লেগেছে। প্রায় দৌড়ে বাড়ি ফিরছিল সে। পথে সোহেলের সাথে দেখা।
: কি রে সোহেল কি হইছে?
: আগুন লাগছিল গোয়াইল ঘরে। গরুডা বাচব না ভাই। গরুডা বাচব না। তয় হেইডা বড় কতা নয়, বড় কতা হইল ভাবীর ব্যাথা উইঠা গেছে। আমি যাইতাছি স্বাস্থ্য কর্মীকে খবর দিতে। তুমি বাইত যাও।
গফুর প্রায় ছুটে আসল। অনেক মানুষের জটলা। সকলে দাড়িয়ে বিভৎষ গরুটাকে দেখতে লাগল। মেম্বারকে দেখে গফুর থমকে দাড়াল।
মেম্বার তাকে দেখে বলল: গফুর আইছো। আহো আহো। গরুডা বড় কষ্ট পাইতাছে। এহন কি করা যায়। কেউ কেউ কইতাছে গরুডারে জবাহ দিয়া দিতে। আমি কি কই জানো, পশু চিকিৎসককে খবর দেই। একটা চিকিস্যা অবশ্যই আছে।
গফুরের হৃদয়খানি কেপে উঠল। হু হু করে তার বুক। হাউ মাউ করে কেদে দিলো সে। বোবা জানোয়ারটার কষ্ট তাকে বেদনা বিহ্বল করে তুলল। গরুটা যেন গফুরের পথের দিকে তাকিয়ে ছিল। এখন তার চিৎকার করা শক্তি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। পা দুটি ভাজ করে সে মাটিতে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। গফুর একটা কাঁথা ভিজিয়ে নিয়ে এলো। তারপর ঝলসে যাওয়া জানোয়ারটার গায় জড়িয়ে দিল। এতে বোধ হয় গরুটা আরাম পেল কিছুটা। মাঝে মাঝে এটা উঠে দাড়াতে চেষ্টা করল।
গফুর দৌড়ে গেল বাড়ির ভিতর। এখানে মেয়েদের ভিড়। গফুরকে দেখে তার মা বেরিয়ে এলো। গফুর আর্তনাদ করে উঠল: কি হইছে মা?
: বউ দৌড় দিছিল অর পরই তার ব্যাথা শুরু হইছে।
: এহন আমি কি করুম।
: আল্লা আল্লা কর। জরিমুনের মা দেখতাছে।
: ডাক জরিমুনের মারে। সোহেল গেছে ডাক্তার আনতে।
: আন বাবা তাড়াতাড়ি কর। নাইলে বউডারে বাচানো যাইবো না। পানি ভাইঙ্গা গেছে।
গফুরের মা জরিমুনের মারে ভিতর থেকে ডেকে আনল। জরিমুনের মা যা বলল তা হলো জরাযুর মুখ খুলে গেছে। বাচ্চাটার মাথাটা দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় তাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া অনেক রিক্স। যদি অনুমতি দেয়া হয় তবে এই দাই-ই বাচ্চা ডেলিভারীর চেষ্টা করতে পারে। গফুরের মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠল। ঘটনার নাটকীয়তা সে বিহ্বল হয়ে গেল। এমন সময় সোহেল এলো স্বাস্থ্যকর্মী মেয়েটিকে নিয়ে । তারা ভিতরে ঢুকে গেল। গফুর আল্লা আল্লা করতে লাগল।
মেয়েটি বেরিয়ে এসে বলল: সময় নেই গফুর ভাই। এ অবস্থায় কোথাও নেয়া যাবে না। এখানেই চেষ্টা করতে হবে। আমি দাইয়ের সাথে কথা বলেছি। আমরা দুজনই চেষ্টা করব। আল্লাহর উপর ভরসা রাখেন।
সন্ধ্যা প্রায় সমাগত। পাখিরা নীড়ে ফিরে যাচ্ছে উড়ে উড়ে। একঝাক সাদা বক উড়ে গেল হিজল গাছটার উপর দিয়ে । তারই ফাক দিয়ে অস্তগামী লাল সুর্যটা দেখা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে বাড়িটা প্রায় ফাকা হয়ে গেল। মেম্বার এসে একবার গফুরের মাথায় হাত বুলিয়ে গেল। ঈমাম সাহেব মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। গরুটা আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে আসছে। তার দুচোখ বুজে যাচ্ছে মৃত্যুর অবসাদে।
একসময় তার মনে পড়ল তারামনের কথা। বুকের ভিতর ঝির ঝির একটা ব্যাথা অনুভব করল গফুর। বেহুশ নেশাগ্রস্থ মানুষের মত টলতে টলতে এগিয়ে গেল সে। এখানে এক ভয়াবহ নিরবতা বিরাজ করছে, সকলের চোখে মুখে আতংকের ছাপ। কিছুই বুঝতে পারল না গফুর। তার মাথাটা ঠিক কাজ করছে না। টলতে টলতে এগিয়ে গেল সে, বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগল- ব্যাপার কি?
কেউ কোন জবাব দিল না। সকলে চোখে মুখে ভয় আর বিস্ময় নিয়ে দাড়িয়ে আছে। এতো লোক তবুও কোথাও কোন শব্দ নেই। গফুর ভাবল- বউটিও মারা গেল কি?
বুড়ি দাই-কে দেখা গেল থর থর করে কাঁপছে।
-ও খালা কি অইছে ? আমারে কেউ কিছু কও না ক্যান ? কি হইছে?
-আমি কইতে পারুম না। তুই ভিতরে গিয়া দ্যাখ।
ভিতরে ঢুকল গফুর। না, বউ জীবিত-ই আছে। জ্বল জ্বল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তারপর তার চোখ গেল পাশে রাখা ছোট বাচ্চাটার দিকে। কাঁথার উপর বাচ্চাটি কাঁদছে না এক ফোঁটাও। কিন্তু হাত দুটি নাড়ছে। নিচের দিকে চোখ যেতেই থমকে গেল সে। বাচ্চাটার নিচের দিকে দুটি পা ঠিকই নড়ছে। তার পাশেই আরও দুটি পা, দুটি হাত সামান্য ঝুলছে।
ব্যাপারটা একসাথে খেয়াল করল গফুর। বউ তার বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মরে যায়নি, ভীষন ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। উঠান ভর্তি মানুষ, বাচ্চাটি জীবিত কিন্তু কাঁদছে না এক ফোঁটাও। উপরের দিকে স্বাভাবিক এক মেয়ের অবয়ব। কিন্তু নীচের দিকে কিম্ভুতকিমাকার এক প্রাণীবিশেষ।
স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে।
চলবে….
loading...
loading...
গল্পের ধারাবাহিকতা অপেক্ষা করতে বাধ্য করছে প্রিয় লেখক।
loading...
ধন্যবাদ ভাই।
loading...
মিনি উপন্যাসের সাথে চলবো আশা করবো। এই পর্ব পড়া থাকলো কবি।
loading...
আপনাকে পাব এ আশাতো করতেই পারি। ধন্যবাদ।
loading...
থ্রিলিং বেশ । চলতে থাকুক মালেক ভাই । শুভকামনা জানবেন ।
loading...
প্র্থম পর্বটি তাহলে ভালই হয়েছে, কি বলেন? দেখা যাক এই আকর্ষণ ধরে রাখা যায় কিনা। ধন্যবাদ আপনাকে।
loading...
মুগ্ধতার আবেশে জড়িয়ে যাই আপনার গল্পের বাঁকে বাঁকে…
সালাম ও প্রীতি জানালাম প্রিয় মালেক ভাই।
loading...
loading...
শুরু পড়লাম কবি দা। শুভেচ্ছা নিন।
loading...
শুভ কামনা আপনার জন্য।
loading...
অনিন্দ্যরূপ লেখা, অপরূপ ও অনিন্দিত।
loading...