শাসন

স্কুলে বেত থাকবে না তা কখনও হয়। স্কুল হচ্ছে মানুষ তৈরির কারিগর। শাসন ছাড়া কেউ কখনও মানুষ হয়? বেত হাতে টহল দিতেন আমাদের প্রধান শিক্ষক মহাশয়। আমরা সবাই ভয়ে কাঁপতাম।
ভয়ে কাঁপতাম তিনি মারবেন বলে নয়, ভয়ে কাঁপতাম পড়া জিজ্ঞেস করলে পারব না তাই। ক্লাস চলাকালীন দুষ্টুমি করলে ঠিক চোখে পড়বে তাই। নিয়মিত স্কুলে আসি না তাই। মিথ্যে বাহানা ঠিক ধরে ফেলতেন তাই। পড়া বলা শুরু করলেই ঠিক বুঝতে পারতেন দায়সারা পড়া পড়ে এসেছি তাই।
যারা সত্যিকারের ছাত্রছাত্রী। পড়া করত। পড়া বুঝত। নিয়মিত পড়ত। তাদের কাছে বেতের কোন ভয় ছিল না। কিংবা বেতের জন্য আমরা অনেকেই ছাত্রছাত্রী হয়ে গিয়েছিলাম।
সুশীলবাবু গৌরবাবু অনিলবাবু সতীশবাবু মন্মথবাবু বিষ্ণুবাবু যার হাতে বেত থাক না কেন সবাই চিনতেন কে ছাত্রছাত্রী আর কে ছাত্রছাত্রী নয়। তৃতীয় নয়ন দিয়ে ঠিক চিনতেন কে কে ‘ছাত্রানাং অধ্যয়ন তপ’ হিসেবে স্কুলে আসছে আর কে আসছে না।
তুমি স্কুলে আসবে আর ওই তো একটু আধটু পড়লেই হল কিংবা না পড়লেই হল অথবা ছাড় তো পড়ে আর কি হবে এবং কত আর পড়ব পাশ করলেই হল বা ঠিক স্টেজে মেকাপ দিয়ে দেব কিংবা পড়ার জ্বালায় জীবনে আর থাকল কি এ রকম ভাবলে কিংবা মানলে চলবে না। জীবনের এই সময়টা শেখার সময় তাই স্কুলে এসে পড়তেই হবে। ‘ছাত্রানাং অধ্যয়ন তপ’ হতেই হবে। এই ব্যাপারটা আমাদের শিক্ষক মহাশয় বেত হাতেই বুঝিয়ে দিতেন।
শিক্ষক হিসেবে স্কুলের বেতের সাথে সাথে সেই ভাবনাটিও পোষণ করতেন। তাই আমাদের কাছে বেত বা শাসন ছিল মানুষ হওয়ার অবস্থান। আমরা বেতের দু চার ঘা খেলে বাড়িতে বলতেই পারতাম না। কিংবা বললে আরো দু চার ঘা খেতে হত।
একদিন দুদিন পড়া না করে গেলেই যে তুমি বেতের মার খাবে তা কিন্তু নয়, পড়া করে গেলে কিন্তু তোমার বুদ্ধিতে অত ভাল পড়া বলতে পারলে না তার জন্য যে শাস্তি পাবে তা কিন্তু নয়, পড়াশুনার সাথে সাথে যদি তুমি দুষ্টুমি কর তাহলে দুষ্টুমির জন্য তুমি শাস্তি পাবে তা কিন্তু নয়।
কোন শিক্ষা সে পারিবারিক হোক বা সামাজিক হোক কিংবা বোধ বুদ্ধির অথবা খেলাধূলার সেখানে শাসন থাকা খুব জরুরী। মনে আছে ‘দঙ্গল’ ছবির কথা। বাবা যখন মেয়েদের চুল কেটে দিচ্ছে, মেয়েদের ভোর পাঁচটার সময় ঘুম থেকে তুলছে, ছেলেদের সাথে কুস্তি করাচ্ছে তখন কিন্তু সেই বাবা জানত না তার মেয়ে দেশের হয়ে সোনার মেডেল আনবে। যদি মেয়েরা মেডেল আনতে না পারত তা হলে ঐ বাবা নিষ্ঠুর প্রমানিত হত। শুরুতে সবাই তাই বলেছিল। বাঘা যতীন যখন একবার পুকুরের ঝাঁঝিতে পায়ে আটকে গিয়েছিল তখন পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে তার বাবা বলেছিল – তোমাকে নিজেকেই বিপদ কাটিয়ে উঠে আসতে হবে। বাঘা যতীন উঠে এসেছিল।
তবেই না তাঁরা বরেণ্য।
আমাদের ক্লাসে অলক ফার্স্ট হত। কিন্তু স্যাররা তিন চার সাত আট রোল নম্বরের পার্থ নিমাই কিংবা সুরেশকে পছন্দ করত। কেন না স্যাররা জানতেন কার মধ্যে কি আছে। এবং সত্যি সত্যি পরবর্তীতে অলক কেবল ক্লার্ক। কিন্তু পার্থ নিমাই অরূপ সাধন এরা কেউ বিজ্ঞানী কেউ ডাক্তার কেউ আধিকারিক। এই উপলব্ধি স্যারেদের মধ্যে ছিল বলেই না বেত নিয়ে ক্লাসে এলেও স্যারেদের খুব মানাত।
সেইসব দিন পেরিয়ে এসে, সেই সব বেত দেখে ভয়ে ভয়ে কেঁপে ওঠা একজন শিক্ষার্থীও বলবে না যে সেদিনের সেই বেত, স্কুলের বেত, বেত হাতে ক্লাসে প্রবেশ করা স্যার ভুল ছিল।
শাস্তি নয় শাসন। শাসন থাকা খুব জরুরী। শাসন না থাকলে শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না।
আমাদের ক্লাসে বিনয় একেবারেই পড়া পারত না। অঙ্ক টুকটাক পারত কিন্তু ইংরেজীতে একেব্বারে কাঁচা। স্যার বলতেন – তোর বাড়িতে ইংরেজীর চাষ হয় যে নিজের মত ইংরেজী বলছিস?
তো সেই বিনয়কে কোন স্যার মারত না। বরং স্কুলের সব কাজে স্যারেরা বিনয়কে ডাকত। স্কুলের কোন অনুষ্ঠানে চেয়ার বেঞ্চি বয়ে দেওয়া খাওয়ার এনে দেওয়া তদারকি করা সব কাজে বিনয়। এমন কি বেত এনে দেওয়াটাও বিনয় করে দিত। সেই বিনয় এখন বড় হোলসেল বিজনেস করে। আমাদের গ্রামের বেশ বর্ধিষ্ণু নাগরিক। বকাটে উচ্ছন্নের দলে নাম লেখায় নি। স্কুল থেকে বেত উঠে গেল। বেতের সেই চোখ চলে গেল। কত ভাল স্কুলে দিয়ে টাকা পয়সা খরচ করেও ফটাফট ইংরেজী বলা বিনয়ের ছেলে মেয়ে বকাটের দলে উচ্ছন্নের দলে ভিড়ে গেল। বিনয় দুঃখ করে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৬ টি মন্তব্য (লেখকের ৩টি) | ৩ জন মন্তব্যকারী

  1. নিতাই বাবু : ১০-০৯-২০২০ | ২১:১০ |

    বর্তমানে বিনয় বাবুর মতো এমন দুঃখ অনেকেই করে থাকে, শ্রদ্ধেয় লেখক দাদা। ছোটবেলা আমাদের সাথে পড়া ক্লাসমেট সবসময়ের জন্য রোল নং-১ মানে ক্লাস কেপ্টেন ছিলো এমন ছাত্রের ছেলেরা এখন হিরোইন খোর। যা নিয়ে দেখা হলেই দুঃখ করে সময় সময়। অথচ তিনি একজন ব্যাংকের ক্যাশিয়ার। বুঝুন ব্যাপার! শুভকামনা থাকলো শ্রদ্ধেয় দাদা।               

    GD Star Rating
    loading...
    • দীপঙ্কর বেরা : ১১-০৯-২০২০ | ২০:৪৭ |

      তাই তো হচ্ছে। শাস্তি নয় কিন্তু শাসন দরকার। 

      ভাল থাকবেন। সুস্থ থাকবেন। 

      GD Star Rating
      loading...
  2. মুরুব্বী : ১০-০৯-২০২০ | ২১:১১ |

    শাস্তি নয় শাসন। শাসন থাকা খুব জরুরী। শাসন না থাকলে শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • দীপঙ্কর বেরা : ১১-০৯-২০২০ | ২১:০২ |

      সঠিক বলেছেন। 

      ধন্যবাদ

      ভাল থাকবেন 

      GD Star Rating
      loading...
  3. ফয়জুল মহী : ১০-০৯-২০২০ | ২১:৩৭ |

    বেশী শাসনও ভালো না বেশী ভালোবাসাও ভালো না । 

    GD Star Rating
    loading...
    • দীপঙ্কর বেরা : ১১-০৯-২০২০ | ২১:০৪ |

      বেশি তো কোন কিছুই ভাল নয়। 

      ধন্যবাদ

      ভাল থাকবেন 

      GD Star Rating
      loading...