সাম্যের কবি নজরুল

আমি মায়ের মুখে প্রথম শুনি ‘ভোর হোল দোর খোলো খুকুমণি ওঠ রে’। ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসতে হত।
তারপর স্কুলে ‘বাবুদের তালপুকুরে হাবুদের ডাল কুকুরে’ এবং ‘কাঠবিড়ালী কাঠবিড়ালী পিয়ারা তুমি খাও’ শুনে মনটা একেবারে ফ্রেস হয়ে যেত।
এরপর উঁচু ক্লাসে একদিন স্যার বললেন – তোমাকে ‘কুলিমজুর’ কবিতাটি কাল সকালে প্রার্থনা শেষে আবৃত্তি করে শোনাতে হবে। গ্রীষ্মকালে সকালের স্কুলে হত। সেখানে প্রার্থনা শেষে ছাত্রছাত্রীদের যে কোন একজনকে গান কবিতা প্রবন্ধ ইত্যাদি শোনাতে হত।
সবার সামনে আমার সেই প্রথম নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করা আর কবি নজরুলকে বুঝতে শেখা। স্কুলের বইয়ে ছিল ‘ একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান’। কবিতাটির সরলার্থ বোঝাতে কেঁদে ফেলেছিলেন বাংলার শিক্ষক গগনবাবু।
একটা কবিতা জাতপাতের ঊর্ধ্বে কিভাবে মানুষকে একত্র করতে পারে তা এ কবিতা আত্মস্থ করতে না পারেল বোঝা যাবে না। অনেকেই বুঝতে চায় নি নজরুলের সেই হৃদয়ের বাণী। তাই গগনবাবু নজরুলের ভাষায় আমাদের ক্লাসে বলেছিলেন ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোনজন? কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!’
সেদিন যতটা না আত্মস্থ করতে পেরেছি বর্তমান পরিস্থিতিতে তা আরও বেশি করে অনুভব করি। নজরুলের মত, আমাদের বাংলার স্যার গগনবাবুর মত, হয়তো বা আমার ক্ষুদ্র অনুভবের মত অনেকেই কাঁদছে।
আমার সেই নজরুল ভাবনায় নিজে যখন নিজের কাছে পরাজিত হয়ে যাই, জীবন পথের রাস্তা খুঁজে না পাই তখন একবার মনে মনে কিংবা একা ঘরে কিংবা খোলা ফাঁকা মাঠে উদ্দাত্ত কণ্ঠে বলি
বল বীর –
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর –
কিংবা
চল চল চল
ঊর্ধ্ব গগনে বাজে
নিম্নে উতলা ধরণীতল
চল চল চল।
এর চেয়ে প্রাণোচ্ছল ভাষা আর কি হতে পারে? নিজেকে নিজে জাগিয়ে তোলার মন্ত্র আমি বুকের মাঝে বারবার ঝংকার দিয়ে জেগে উঠি। নিজেকে বাঁচার ‘বিদ্রোহ’, অন্যকে বাঁচিয়ে তোলার ‘বিদ্রোহ’ সুন্দরের প্রতিষ্ঠার ‘বিদ্রোহ’ এই ভাষা।
দুঃখু মিঞার দুঃখ জীবনী পার করে ‘বিদ্রোহী কবি’ নজরুল হয়ে ওঠা অধ্যায়ে নানান দিক উন্মোচিত। এই জীবনীতে মানুষকে জাগিয়ে তোলার সাহিত্য এবং বাংলা ভাষা সবার চেতনায় অমোঘ স্থান করে নিয়েছে।
এখন অনুভব করি এ শুধু লেখার জন্য লেখা হয় নি। হৃদয় মথিত এসব বাঙালি জীবনের সম্পদ।
‘শুকনো পাতার নুপূর পায়ে’ আমি তো গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠি। ‘রাঙামাটির পথে লো মাদল বাজে, বাজে বাঁশের বাঁশি’ যেন মাটির কথা বলে যায়। আর ধর্মকে এত কাছ থেকে বিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলাম দেখেছেন যে তাকে বুকে ধারণ করে হৃদয় উৎসারিত বাণী কবিতা গানে উজাড় করে দিয়েছেন।
কবি নজরুল তাঁর লেখনী মানুষ হিসেবে, মানুষের কর্তব্য হিসেবে বার বার প্রতিভাত করেছেন। তাই ‘সাম্যের গান’ গেয়ে গেছেন হৃদয় নিকড়ে।
তিনি কোন জাতি ধর্ম দেশকে আলাদা দেখেন নি। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখেছেন। বাঙালীর সত্ত্বাকে হৃদয়ঙ্গম করেছেন।
তাই কবি অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন ‘
ভুল হয়ে গেছে বিলকুল
সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয়নিকো নজরুল।
এই ভুলটুকু বেঁচে থাক
বাঙালি বলতে একজন আছে
দুর্গতি তাঁর ঘুচে যাক।
দুই বাংলায় পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে বিদ্রোহী কবি নজরুল তাই আজও রবীন্দ্রনাথের সাথে সমান মর্যাদায় উচ্চারিত।
যে কোন ভাষার প্রাণ ভ্রমরা ও ধারক সেই ভাষার সাহিত্য। সেই সাহিত্যের অন্যতম হল কবিতা। বাংলা ভাষায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এত প্রাচুর্য দিয়ে গেছেন যা বাংলা ভাষার অনন্য দিক চিহ্ন। প্রাণ থেকে উৎসারিত হয়ে পড়ে। বাংলা ভাষা খুঁজে পায় আপন মহিমান্বিত মর্যাদা। যা অসীম কাল অক্ষয় হয়ে থাকবে।
তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। মানুষের হয়ে কথা বলা। তাই তো তিনি সহজেই বলতে পারেন
“আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম বেদনা, বিষ জ্বালা, চির লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের।”
নেতৃত্বকে তিনি হুঁশিয়ারী দিয়েছেন ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার”। যা বর্তমান সময় প্রেক্ষিতে খুব প্রয়োজন। দিশেহারা দেশ কাল জাতির প্রয়োজনে তাই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে শুধু স্মরণ জন্মজয়ন্তী পালনে কিছু হবে না।
নজরুলকে বুঝতে হবে, হৃদয়ঙ্গম করতে হবে, সাম্যের গান মানুষের মধ্যে একাত্ম করে দিতে হবে তবেই বিদ্রোহী কবির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি পরিপূর্ণ হবে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৪ টি মন্তব্য (লেখকের ২টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২৪-০৫-২০১৮ | ২০:৪৩ |

    ভুল হয়ে গেছে বিলকুল
    সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে
    ভাগ হয়নিকো নজরুল।
    এই ভুলটুকু বেঁচে থাক
    বাঙালি বলতে একজন আছে
    দুর্গতি তাঁর ঘুচে যাক।

    দুই বাংলায় বিদ্রোহী কবি নজরুল আজও রবীন্দ্রনাথের সাথে সমান মর্যাদায় উচ্চারিত। কবি নজরুলের জন্মদিনে আমাদের শুভেচ্ছা। ধন্যবাদ আপনাকে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
  2. রিয়া রিয়া : ২৫-০৫-২০১৮ | ২৩:১০ |

    অসাধারণ কবি দা

    GD Star Rating
    loading...