নিউ পোষ্ট

কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি, হাইকোর্ট প্রাঙ্গনে গ্রিক দেবি থেমিসের মূর্তি স্থাপন আর পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা ইত্যাদি নিয়ে গত এক সপ্তাহব্যাপী রাজনীতির ময়দান, সোশ্যাল মিডিয়া কিছুটা উত্তপ্ত ছিল। ভারত থেকে আসার পরের দিনেই গণভবনে গিয়ে হেফাজত প্রধান আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে একদল কওমি আলেম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের দাবির সঙ্গে ঐক্যমত পোষণ করে কওমি মাদ্রাসার দাওয়ারে-ই-হাদিসকে এমএ সনদের সমমূল্যের নির্ধারণ করতে সম্মত হয়েছেন। কওমি মাদ্রাসার বোধ উদয় হওয়ার জন্য তাদেরকে মোবারকবাদ জানাতে হয়।
গত শতাব্দীর ষাটদশকেও সরকার কওমি শিক্ষাকে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিলেন এবং ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহকে হাটহাজারী মাদ্রাসায় পাঠিয়ে ছিলেন এ বিষয়ে আলোচনা করার জন্য। তিনি তখন হাটহাজারী মাদ্রাসার মোহতামীম হযরত মওলানা আব্দুল ওহাব ও পটিয়া মাদ্রাসার মোহতামীম হযরত মওলানা হাজী ইউনুস-এর সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। কিন্তু তারা উভয়ে সরকারের প্রস্তাব মানেননি। হাটহাজারী মাদ্রাসাকে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি করারও প্রস্তাব দিয়েছিলেন ড. শহিদুল্লাহ্। তাও তারা মানেননি। তারা কখনও সরকারি সনদেরও পরোয়া করেননি আর সরকারি সাহায্যেরও মুখাপেক্ষী ছিলেন না। শিক্ষার্থীদেরকে দিয়ে মুষ্টি ভিক্ষাকে সম্বল করেই দেওবন্দী ওলামারা এ উপ-মহাদেশে কওমি ক্যারিকুলামের বিরাট এক ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থার পত্তন করেছিলেন।
কওমি ওলামারা ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তি। বালাকোর্টে, থানাবনে তারা ব্রিটিশের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। ব্রিটিশকে তারা কখনও ভারতের বৈধ শাসক বলে স্বীকার করেননি। সর্বাবস্থায় তারা ব্রিটিশের সঙ্গে অসহযোগের নীতি অবলম্বন করে চলেছিলেন। ব্রিটিশেরা ৫০ হাজারেরও বেশি কওমি আলেমকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন। হযরত মওলানা এমদাদুল্লাহ্, মওলানা কাসেম নানুতুবী, মওলানা রসিদ আহাম্মদ গাঙ্গাগোহা, শহীদ হাফেজ জামাল, মওলানা ফিরিঙ্গী মহল্লী, মওলানা জাফর আহাম্মদ থানেশ্বরী, মওলানা ফজলে হক করবাদী, মওলানা আব্দুল মজিদ সিন্দী প্রমুখরা ছিলেন কওমিদের নেতা। এ উপ-মহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কওমি ওলামাদেরও বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা ছিল।

আমি ব্রিটিশ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে মওলানাদের অবদানের কথা লিখলাম এজন্য যে, তারা অপদার্থ ছিল না তা বুঝাবার জন্য। কারণ কিছু তথাকথিত প্রগতিশীল আছেন তারা মনে করেন মওলানারা শুধু অপদার্থ।

প্রধানমন্ত্রী যে তাদেরকে স্বীকৃতি দিয়ে ধীরে ধীরে কাছে টানার চেষ্টা করছেন, তাদেরকে রাষ্ট্রের মূল স্রোতে আনার চেষ্টা করছেন তা হচ্ছে উত্তম সিদ্ধান্ত। প্রধানমন্ত্রী কওমি ক্যারিকুলামে হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সনদের স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু কওমি মাদ্রাসাগুলোতে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটানো যে দরকার যে বিষয়ে তাদেরকে বুঝানো উচিৎ। মওলানা হোসেন আহাম্মদ মাদানী তার শেষ জীবনে এসে কওমি ক্যারিকুলাম বদলানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। নিশ্চয়ই এ বিষয়টি আহমদ শফী সাহেব জানেন। কারণ তিনি হোসেন আহাম্মদ মাদানীর শিষ্য।

বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসাগুলোর কোনও এক কেন্দ্রীক শিক্ষা বোর্ড নেই। দুই চারটা মাদ্রাসা মিলে এক একটা বোর্ড করার প্রবণতা আছে। এটার কারণ হলো তাদের মাঝে অনৈক্য বেশি। সুতরাং আমরা আহামদ শফী সাহেবকে অনুরোধ করবো বাংলাদেশের সব কওমি মাদ্রাসাগুলোকে নিয়ে যেন একটা গ্রহণযোগ্য শিক্ষা বোর্ড গঠন করা হয়। বর্তমানে তাদের যে শিক্ষা বোর্ড আছে সেটি পূর্ণাঙ্গ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। ধীরে ধীরে সব মাদ্রাসাগুলোকে একটা কেন্দ্রীয় কাঠামোর মাঝে নিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রয়োজনে এ বিষয়ে আইনের সহায়তা দরকার হলে সরকারের সঙ্গে আলোচনাও করা যেতে পারে। সারা দেশে ১৩ হাজার ৯০২টি কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। এতো বড় সংখ্যক শিক্ষার্থীদের মূল স্রোতের বাইরে রেখে একটি সুস্থ সমাজ এগুতে পারে না।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কওমিদের শীর্ষ ব্যক্তি ছিলেন হযরত হাফেজজী হুজর। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে বলেছিলেন জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই। কওমিরা ঈমান আকিদার কথা বলে, রাজনীতি আসলে তাদের কাছে মূখ্য নয়। হেফজাতও কোনও রাজনৈতিক দল নয়। এ কথাটা তারা নিজেরাই বলে। তবে ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা অবরোধের মাধ্যমে যে তাণ্ডব তারা করেছে সেটা কোনও অংশে রাজনীতি বিবর্জিত ছিল না। ধর্মের লেবাসে তারা স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ক্রীড়ানক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলো। ইন্ধনদাতা ছিল মাহমুদুর রহমানের মতো কিছু লোক। ১৩ দফা নামের হিংসাত্মক, উদ্ভট কিছু দাবিকে সামনে নিয়ে এসেছে তারা। বায়তুল মোকারমের মতো পবিত্রস্থান তারা বা তাদের ব্যানারে আশ্রয় নিয়ে অন্যরা অপবিত্র করেছে, পুড়িয়েছে।

হেফাজতের দাবির স্বীকৃতিতে আমাদের সব বামপন্থীরা সমস্বরে রেগে গেলেন কেন বুঝা মুশকিল। একসময়ে এ উপ-মহাদেশে বামপন্থীদের বেশ বড় সড় উপস্থিতি ছিল। এখন ক্ষীণকায় স্রোতধারার মতো হয়ে বিলুপ্তির পথে। এর জন্য আন্তর্জাতিক পরিসরে তাদের পতন মূখ্য কারণ হলেও আরও কিছু কারণ স্থানীয়ভাবেও রয়েছে। আর তা হচ্ছে এ উপমহাদেশে বামপন্থীরা ধর্মওয়ালাদের সঙ্গে বৈরি আরচণ করে।

তবলীগও কওমিদের একটা শাখা। তবলীগের টঙ্গী সমাবেশ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের লোক এসে যোগদান করে। অনেকটা বিশ্বায়িত ব্যবস্থা। এরা ঈমান-আকিদার কথা বলে বেড়ায়। এত বড় একটা শক্তিকে বৈরি করে তোলা তো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ধর্মচর্চা এখানে বলতে গেলেতো মায়ের গর্ভ থেকেইতো শুরু হয়। মায়ের গর্ভে থাকতে মুসলমানের সন্তানেরা মায়ের কোরাআন পড়ার আওয়াজ শুনে ভূমিষ্ঠ হয়। সহজে তো মুসলমান মায়ের সন্তানকে ধর্মবিমুখ করা যাবে না। এ বাস্তবতাকে ভুলে যাওয়া বাস্তবতাকে অস্বীকারের সামিল। এতে কারও কোনও লাভ হবে না।

২.

হেফাজতে ইসলাম সুপ্রিম কোর্টের সামনে গ্রিক দেবীর মূর্তি স্থাপনের বিষয়টি উত্থাপন করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তা অপসারণের দাবি তুলেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তিনি নিজেও এ মূর্তি স্থাপনের পক্ষে নন। তিনি সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে বিষয়টি উপস্থাপন করে শেষ করার আশ্বাস দিয়েছেন। সর্বশেষ খবরে দেখলাম প্রধান বিচারপতির সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে দেখা হলে তিনি মূর্তি সরাতে বলেছেন বা এমনভাবে রাখতে বলেছেন যাতে ঈদগাহের মুসল্লিদের চোখে না পড়ে।

সুপ্রিম কোর্টের এ ভবন তৈরি হয়েছে ৫০/৬০ বছর হতে চলেছে। তার মূল গম্বুজের নিচে ন্যায়ের প্রতীক দাঁড়িপাল্লা ছিল। ভারতের বিভিন্ন হাইকোর্টেও দাঁড়িপাল্লা আছে কোনখানে গ্রিক দেবীর মূর্তি দেখিনি। তবে পৃথিবীর নানা দেশেই এই মূর্তি আছে। এখানে এ মূর্তিটি স্থাপন করে এ বির্তকের সূত্রপাত করলেন কে? যারা এ মুর্তিটি স্থাপনের হুকুম দিয়েছেন তারা কি ভুলে গিয়েছিলেন যে এদেশের সাধারণ মানুষ ভাস্কর্য আর মূর্তির তফাত বুঝে না। যা ভাস্কর্য তাই তাদের কাছে মূর্তি। তবে এটাও ঠিক বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত ভাস্কর্যগুলো রক্ষার জন্য আবার তাদের মধ্যেই লোক আছে জীবন দিতে পারে।

দেখা যাচ্ছে ভাস্কর্য নিয়ে প্রগতিশীলদের মধ্যেও বিরোধ। বিষয়টিকে অনেকে হেফাজত বনাম গ্রিক ভাস্কর্য-এর পর্যায়ে নিতে গেছেন। ভাস্কর্যটির প্রযোজনীয়তা, নান্দনিকতার চেয়ে তাদের কাছে হেফাজতকে ঠেকাও মূখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। সুপ্রিমকোর্টের ভাস্কর্য-এর নামে আবর্জনাটি প্রগতির ঝাণ্ডা হয়ে দেখা দিয়েছে। কৌশলে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে এখানে ট্যাগ করে দিচ্ছেন অনেকে। শুরু করেছেন মোল্লাদের জুজুর ভয়। এটা কেউ বিবেচনা করছি না যে, যেখানে যা এতো বছর ছিল না সেখানে রাতারাতি তা স্থাপনের মতো আনপ্রোডাক্টটিভ বিষয় নিয়ে জাতিকে বিভক্ত করছি আমরা। হানাহানিও উসকিয়ে দিতে চাচ্ছি।

চরমোনাইর পীর বলেছেন ২০ তারিখের মাঝে মূর্তি না সরালে তিনি ২১ তারিখ মহাসমাবেশ করবেন সোহরাওয়ার্দীতে। যারা মূর্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন তারা কোনও মিটিং মিছিল সমাবেশ করবেন না। তাদের দাবি তাদের হয়ে সব কাজ করতে হবে সরকারকে। আমি জানি না সরকারের কোন ঠ্যাকা পড়েছে তা করার। এটাতো কালী মন্দির নয় যে সরকার এটাকে রক্ষা করার জন্য পুলিশ পাহারা মোতায়েম করবে। যারা এ মূর্তি বসিয়েছেন আর যারা এ মূর্তি রাখার পক্ষে তাদের উচিৎ হানাহানি সৃষ্টির আগেই মূর্তিটা সরিয়ে ফেলা।

আমার মনে হয় সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে পারে। এ বার যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারা তো সবাই বিএনপির লোক। আমরা শুনেছি যখন এ মূর্তিটি বসানো হয় তখন বারের সেক্রেটারি ও বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মাহাবুব উদ্দীন খোকনের নাকি সমর্থন ছিল। কথাটা সত্যি কিনা জানি না তবে এখন বার এসোসিয়েশনের উচিৎ বিষয়টা নিষ্পত্তি করার উদ্যোগী হওয়া এবং মূর্তিটা সরানোর বিষয় নিয়ে কোনও রাজনীতি না করা। মানুষের প্রগতিশীলতার নিদর্শন দেখানোর বহু ক্ষেত্র আছে। যেহেতু মূর্তি সাধারণ মানুষের মন মেজাজের সঙ্গে সাংঘর্ষিক তা পরিহার করে চলাই তো উত্তম। এই মানুষদের কেউ কেউ হয়তো হৃদয়ের অন্ধত্ব নিয়ে রাতের অন্ধকারে হিন্দুদের প্রতিমা ভাঙে কিন্তু তারা কেউ ঢাকেশ্বরী মন্দিরের মূর্তি সরাতে বলতে শুনিনি। সে ধরনের কারও খায়েস, ধৃষ্টতা অন্য মানুষ, রাষ্ট্রও সহ্য করবে না।

৩.

মানুষ প্রতি বছর নববর্ষ উৎসব করে। ইরানে নওরোজ পালন তো রীতিমতো শিহরণ জাগানো ব্যাপার। ইসলাম ধর্ম যখন ইরানে তার জায়গা করে নেয় তখন কিন্তু নওরোজকে বাতেল করেনি। আরবে আনন্দ প্রকাশের জন্য উলু ধ্বনি প্রদান করে থাকে। ইসলাম ধর্ম আরবের ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এ প্রথা বাতিল করেনি। এখনও সন্তানের জন্ম হলে তারা উলুধ্বনি প্রদান করে। সুতরাং ওলামাদের উচিৎ সংস্কৃতি নিয়ে বাড়াবাড়িতে জড়িত না হওয়া। এটি মূর্তিও নয় অর্চনাও নয়, একটা সংস্কৃতি। আপনার ভালো না লাগলে পালন না করেন কেউ বাধা দিচ্ছে না, আপনাকে বাধ্য করছে না।

ইউনেস্কোর স্বীকৃতির পর সরকার এবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রার করা নির্দেশ দিয়েছিল। সেটি কোনও কোনও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি পালন করতে না চায় আমার মতে সেখানে চাপাচাপি না করাই ভালো। তবে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক করতে হবে। এর সঙ্গে কোনও আপস চলবে না। হেফাজতি, মারফতি সে যেই হোক- এর সঙ্গে বিরোধে এলে রাষ্ট্র থেকে বহিস্কার করতে হবে। কঠোর সাজা দিতে হবে। এরা মৌলবাদী নয় শুধু এদের অন্তরে পাকিস্তান।

মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রশ্নে আরও বলবো, সংস্কৃতি এক চলমান নদীর স্রোতধারার মতো, এর স্বচ্ছতা থাকলে সবাই সেটা গ্রহণ করবে। দেশ কাল এখানে বিষয় না। পহেলা বৈশাখ, মঙ্গল শোভাযাত্রার সে স্বচ্ছতা এবং শক্তি রয়েছে বলে সেটি আগামীতে ছড়িয়ে যাবে অন্য দেশেও। কিছু কাঠ মোল্লা এবং মৌলবাদী মানসিকতার মানুষের বোমাবাজি করা ছাড়া অন্য কোনও শক্তি নেই একে দমন করার। এমনকি বোমাবাজি করেও সম্ভব নয়- এটাও প্রমাণিত। রমনা বটমূলে ৫০ বছর ধরে পালিত হচ্ছে ছায়ানটের গানের উৎসব। অনাগতকালেও পালিত হবে বৈশাখী উৎসব আর সেখানে বোমা নিক্ষেপকারী মুফতি হান্নানরা গলায় রশি নিয়ে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলবে। সারা দেশ বৈশাখের মতো সার্বজনীন উৎসবে অতীতের তুলনায় আজ শতগুণ মাতোয়ারা থাকে। তখন চট্টগ্রামের চারুকলার কোন দেয়ালে কোন দুর্বৃত্ত রাতের আঁধারে কালি দিল কিছু আসে যায় না।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

হেফাজতে ইসলামের অন্যায় দাবির কাছে সরকারের নতি স্বীকার, বর্ষবরণের উৎসবে নিরাপত্তার বাড়াবাড়িতে হারিয়ে যাওয়া স্বতঃস্ফূর্ততা ইত্যাদি নানা কারণে পহেলা বৈশাখের ভোরে এবার মনটা তেমন ভালো ছিল না। সেই মন খারাপ ভাবটাকে প্রবল বিষণ্নতায় বদলে দিলো একটি খবর- ‘সুনামগঞ্জে আজ উৎসব নেই, আছে প্রতিবাদ’। পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের একমাত্র সার্বজনীন উৎসব। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে মানুষ সামিল হয় এই উৎসবে। গ্রামে গ্রামে বৈশাখী মেলা বসে। নানান আয়োজন দেশজুড়ে। আর তখন হাওরাঞ্চলে উৎসবের বদলে শোক, প্রতিবাদ। শোক আর কান্না আজ হাওরের কৃষকের ঘরে ঘরে।
অথচ হাওর মানেই যেন উৎসব। আমরা যারা শহুরে মানুষ তাদের কাছে হাওর মানেই থই থই জল, বাউল গান, পূর্ণিমার রাতে বজরায় চড়ে জ্যোৎস্না বিলাস। কিন্তু হাওরের সঙ্গে যাদের নিত্য বাস, তাদের মনে এবার রঙ নেই। অকাল বন্যা আর বাধভাঙা জোয়ারে তলিয়ে গেছে হাওর এলাকার একমাত্র ফসল বোরো ধান। এবার কৃষকেরা একমুঠো ধানও ঘরে তুলতে পারেনি। তাদের মনে তাই সুখ নেই, রঙ নেই, উৎসব নেই। কৃষকের কান্না আমাদের শহুরে মানুষের মন গলাতে পারেনি, তাদের চোখের জল হাওরের পানির উচ্চতা একটু বাড়িয়েছেই শুধু।
মার্চের শেষ দিকের অকাল বর্ষণই এবার হাওরের মানুষকে পথে বসিয়েছে। আসলে বসার মতো পথও পাবে না তারা; তাদের সব স্বপ্ন, সব আশা, সারাবছরের খোরাকি ভেসে গেছে অথই জলে। অসহায়ভাবে দেখা ছাড়া কৃষকদের আর কিছুই করার ছিল না। হাওরাঞ্চলের বেশির ভাগ জমিই এক ফসলি। বছরের এই একটি মাত্র ফসল কাটা শুরু হওয়ার আগেই তলিয়ে যাওয়ায় দেশের সাত জেলার হাওরের প্রায় ১২ লাখ কৃষক পরিবার দিশাহারা। ফসল হারানোর বেদনা সইতে না পেরে মারা গেছেন এক কৃষক। যারা বেঁচে আছেন, তাদেরও মরতে হবে তিলে তিলে।
সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া- এই সাত জেলা নিয়ে হাওরাঞ্চল। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এই সাত জেলায় এবার ৯ লাখ ৩০ হাজার ৬০৩ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছিল। এতে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৯ লাখ ৫৪ হাজার ৬৬১ মেট্রিক টন। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের মতেই এবার অকাল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে হাওরের সাত জেলায় সামগ্রিকভাবে ফসলের ক্ষতি হবে শতকরা ৩৫ ভাগের মতো। যদিও কৃষকরা বলছেন, ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। কোনও কোনও এলাকায় পুরো ফসলই তলিয়ে গেছে। তবু সরকারি হিসাব বিবেচনায় নিলেও ক্ষতির পরিমাণ চার হাজার ৬২৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।

হাওরজুড়ে এবার তাই বাউল গান নয়, কৃষকের হাহাকার। ঘরে নিজেদের খাবার নেই, এমনকি নেই গবাদি পশুর খাবারও। গবাদি পশু আসলে গ্রামের মানুষের পরিবারের সদস্যের মতো। কিন্তু গবাদি পশুকে খাওয়াতে না পেরে এবং নিজেদের খাবার জোগাতে পানির দরে বেচে দিচ্ছেন প্রিয় পশুটিকে। সুযোগ বুঝে ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিয়েছেন চালের দাম। ফলে সব দিক দিয়েই এবার মরতে বসেছেন হাওরের মানুষ।

অকাল বন্যায় প্রায় নিয়মিতই হাওরের মানুষদের ভোগায়। অন্য বছরগুলোতে বন্যা আরও পরে আসে। তাই পরিপক্ক ধান ডুবে গেলেও সেখান থেকে কিছুটা উদ্ধার করতে পারে কৃষকরা। কিন্তু এবার বন্যাটা একটু বেশি আগেই এসেছে। তাই পাকার আগেই ধান ডুবে গেছে। ফলে এবার তাদের না খেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। ফলে যে হাওর এলাকা আমাদের খাবার জোগায়, এবার তারাই খেতে পাবে না। সুনামগঞ্জের কৃষক বাবর আলী বর্ষবরণ না করার কারণ হিসেবে বলেছেন, ‘বৈশাখের পহেলা দিন নয়া ধানের চাউলের ভাত দিয়া শিরনি করি আমরা। ইটা বাপ-দাদার আমল থাকি চইলা আইছে। বাইচ্চারা কত খুশি অয়। ই-বার তো এক ছটাক ধানও কেউ তুলত পারছি না। কান্দন ছাড়া আমরার কোনও উপায় নাই।’

অতিবৃষ্টি, আগাম বন্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আর এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ওলটপালট হয়ে গেছে প্রকৃতির ছন্দও। তাই অসময়ের বৃষ্টি বা আগাম বন্যার উৎপাত আরও নিয়মিত হবে। দুর্যোগটা প্রাকৃতিক, তাই বলে প্রকৃতির ওপর দায় চাপিয়ে হাওরের মানুষের দুর্দশা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বরং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার নানা কৌশল নিয়ে হাওরের মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে আমাদের। এমনিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু হাওরের মানুষের ভাগ্যটাই কী খারাপ। তারা বারবার দুর্যোগে পড়ে, প্রতিবার ধ্বংস হয়, আবার ওঠে দাঁড়ায়। কিন্তু তাদের রক্ষায় কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া হয় না কেন? এবারের অকাল বন্যার পর এই বিষয়গুলো অনেক বেশি আলোচনা হচ্ছে। আলোচনায় আসছে বাঁধ নির্মাণে অদক্ষতা আর দুর্নীতির নানা খবর। হাওর এলাকার বাঁধগুলো সময়মত রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। ফলে প্রতিবছরই বাধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর আসে। যেমন চলতি মৌসুমে সরকার সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডকে ৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের জন্য। গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও সেই কাজ শুরুই হয় ফেব্রুয়ারিতে। প্রতিবছর একই ধরনের সংবাদ দেখেও কি টনক নড়ে না, আমাদের নীতিনির্ধারকদের? তারা কি টেকসই বাঁধ নির্মাণের ব্যবস্থা নিতে পারেন না, পারেন না বেড়িবাঁধ মেরামতে অনিয়ম দূর করতে। হাওর এলাকার নদী-খাল-বিল নিয়মিত খনন করার মাধ্যমেও কৃষকদের রক্ষা করার চেষ্টা তো অন্তত করতে পারি। বাঁধ নির্মাণ আর রক্ষণাবেক্ষণের টাকা ইঞ্জিনিয়ার আর ঠিকাদারদের ভাগাভাগির খবর তো ওপেন সিক্রেট। সবাই জানে বাঁধের টাকা কাদের পকেটে যায়।

দেশের ৭টি জেলায় হাওর আছে। তাই বলে হাওরের মানুষের কান্না শুধু হাওরের বাতাসেই যেন মিলিয়ে না যায়। হাওরবাসীর পাশে দাঁড়াতে হবে আমাদের সবাইকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদী, টেকসই ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি এবার এই মানুষগুলোর বেঁচে থাকার জন্য সরকারকে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের খাদ্য দিতে হবে। আগামী বছরের জন্য সহজ শর্তে ঋণ দিতে, বীজ দিতে হবে।

দেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ হাওর এলাকার মানুষ। হাওরের প্রতি তার মমত্ব আমরা সবাই টের পাই। রাষ্ট্রপতির প্রতি আকুল আবেদন তিনি যেন হাওরের মানুষকে বাঁচাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেন। হাওর থেকে আমরা বাউল গানের সুরই শুনতে চাই, কান্না নয়, হাহাকার নয়।

লেখক: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ

[email protected]

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

কোন মন্তব্য নেই

মন্তব্য বন্ধ আছে।