২৯ এপ্রিলের পরদিন সকালের কথা-
সমস্ত বাগান লণ্ডভণ্ড!
লণ্ডভণ্ড না বলে নিঃচিহ্ন বলাই যথার্থ হবে,
শেকড় শুদ্ধ উপড়ে ভেসে গেছে প্রতিটি বৃক্ষের বসত ভূমি!
কিছু ফুল ফুটেছিল বসন্ত গুণে, কিছু ছিল বারোমাসি
আর কিছু একান্তই প্রাকৃতিক…
আচ্ছা ফুলের কি আত্মা থাকে?
ফুলের আত্মারা এখন কোথায়? এই প্রলয়ঙ্করী ঝড়, জলৌচ্ছাস
ওরা কি পারতো না ফুলেদের বাঁচিয়ে রাখতে?
রাস্তার ওপারে একঘর উদ্বাস্তুর বাস ছিলো-
কোথা থেকে যেন এসেছিলো গত বৈশাখে, পুরুষটার দু হাতে দু’কন্যা
সমুদ্রের মত চোখ তাদের, ঘেরুয়া বসনের রমণী টা নিশ্চই তাদের মা
এক হাত বুকে চেপে পীযুষ শিশুটিকে কাঁধে ঘুম পড়িয়েছে অন্য হাতে
প্রাগৈতিহাসিক কালের একটি একতারা
ওরা বেশ ক্ষুধার্ত ছিলো, পিপাসায় কাঠ হওয়া মুখ রোদের মত ঠা ঠা করছিলো
গ্রামের কেউই তাদের চিনে না- অথচ, কেউ জল,কেউ গরম ভাত
কেউ কেউ বন্দোবস্ত করছিলো তাদের রাত কাটাবার…
ওরা ঠিক আছে তো?
মাঠ আর নদী মিলে মিশে একাকার জলে, থইথই জল
মস্ত বড় বড় গাছ, পাখির বাসা, মুরগীর খোঁয়াড় আর অগণিত মৃত দেহ
যেভাবে নদী আর প্রান্তর একাকার
যেভাবে জল,মল, রক্ত, বর্জ্য একাকার
সেভাবে মৃতদেহরা একাকার; কি মানুষ , কি পশু- জন্তু জানোয়ার
কোথাও কোন স্থল অবশিষ্ট নাই,
ক্লান্ত- পরিশান্ত জলের স্রোত, তীব্রতাও আছে এখনো
থেকে থেকে ভেসে আসছে আহাজারি, চিৎকার!…
সে দিন সূর্য উঠেছিলো
কিন্তু নিজেকে বারবার লুকচ্ছিল আড়ালে
লজ্জায় হোক কিংবা কোন দ্বিধায়- আসলে কেউ কারো চোখে তাকাচ্ছিলো না!
বিধ্বস্ত মনে আমি বারবার প্রার্থনায় নিমগ্ন হয়ে চাইলাম
চেষ্টা করলাম চোখের দু’ফোটা জল মিশিয়ে দিতে জলোচ্ছ্বাসের সাগরে
দু চোখের পাতায় কম্পন বোধ করলাম, তারপর চোখ বন্ধ করলাম…
অন্তঃকর্ণ ফেটে যাচ্ছিলো সীমাহীন গর্জনে…
কোথাও হতে ভেসে আসা আর্তনাদ
পচন ধরা লাশের উপর অসংখ্য শকুনের উন্মাদ নৃত্য
কাঁক গুলো ততক্ষণে তৃপ্ত উদর পূর্তি শেষে…তবুও
রাজি নয় ভাগের খাবার হাত ছাড়া করতে
একটি লাল বেনারসি ভেসে উঠে আসে, মেহেদী রাঙ্গা হাত
চুলের গোছায় গুজে থাকা বেলি ফুলের মালা
অবিশ্বাস্য এক নিষ্পাপ চেহারা, ঠিক যেন সাগর তলা হতে মুক্তো উঠে এসেছে
যেন এখুনি মুচকি হাসবে অথবা লজ্জায় লাল…
এত সব মানুষ, এত জীবন… সবাই শুয়ে আছে…ঘুমিয়ে আছে
যে দিকে তাকিয়েছি দেখেছি- নিঃস্পন্দ দেহ
যে দিকে ছুটে গিয়েছি দেখেছি পথ- অপথ এক হয়েছে সব
কোথাও কোন ধর্ম দেখিনি, কোন বাচ বিচার দেখিনি
গর্তের পর গর্ত খোঁড়া হয়েছে যে টুকু অবশিষ্ট ছিলো স্থলভাগ
নারী পরুষ, শিশু বৃদ্ধ একসঙ্গে সমাধিস্থ হয়েছিলো!
সমাধিস্থ হয়েছিলো গরু বাছুর জীব জন্তুর
আর কেউ কেউ তাও পায়নি…
স্রোতের তোড়ে ভেসে গিয়েছে, অথবা জমির অভাবে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে!
পৃথিবীর কোন সুগন্ধিই সে দিন দুর্গন্ধের মুখোমুখি হতে পারেনি
তাছাড়া গন্ধের তোয়াক্কা না করে জীবন খুঁজছিল জীবন
চিৎকারে আর ক্ষিপ্রটায় শিশু খুঁজছিল মাতৃকোল, একটু সহনীয়তা;
রাতের অন্ধকার ছিলো জলের মত
সাইক্লোন সেন্টার গুলো গিজগিজ করেছে কোথাও কোন ঠাঁই নাই…
অগাধ… অঠাই সর্বত্র! অবর্ণনীয় এক আঠালো বাতাস- থমথমে
ওভাবেই রাত্রি নামে- সকাল নামে…
……তারপর এক নিদারুণ মহামারী
জলের দাগ চিনে চিনে দুর্ভিক্ষ ঢুকে গিয়েছিলো প্রতিটি গৃহে- জমিনে;
আমরা তখন জীবন বুঝতাম না, মরণ বুঝতাম না
আমরা কেবল ক্ষুধা বুঝতাম, বই বুঝতাম- যা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে আছে
আমরা জামা বুঝতাম- বাবার হাতে মোয়া বুঝতাম…
একেক টা দিন যুদ্ধগ্রস্থ, বিধ্বস্ত
বাবারা অন্নের সন্ধানে মরিয়া, আর মায়েরা খড় কুড়ো যা পায়…
এভাবে ঘুরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বিগত হলো- দেড় যুগ
আজো আমার কানে বাজে সহস্র কণ্ঠের দুর্বল আর্তনাদ, বাঁচার মিনতি
আজো উড়ে যাওয়া আত্মারা ফিরে ফিরে আসে অমোঘ প্রত্যাশায়…
Daudul Islam ২৯ই এপ্রিল ২০১৭
২৯ এপ্রিল ১৯৯১ ইতিহাসের ভয়াল প্রলয়ংকরী দিন। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হেনেছিল স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। রাতের অন্ধকারে মুহূর্তের মধ্যে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল উপকূলীয় এলাকা। দেশের অন্যান্য এলাকার মত পাহাড়-সাগরবেষ্টিত চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকা সেদিন ঘূর্ণিঝড়ের ছোবলে বিরাণভূমিতে পরিণত হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় কক্সবাজার, মহেশখালী, চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, পতেঙ্গা, সীতাকুণ্ড, কুতুবদিয়া, চকরিয়াসহ বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকা। সর্বোচ্চ ২২০ কিলোমিটার গতিবেগে বয়ে চলা ঝড়, জলোচ্ছ্বাসে বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয় দেশের ১৫ জেলার ২৫৭ টি ইউনিয়ন। মারা যায় লাখ, লাখ মানুষ। এখনও বাতাস বইলে চট্টগ্রামের উপকূলীয় জনগণ আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। ১৯৯১ সালে ঘটে যাওয়া সেই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের কথা উপকূলবাসী তথা দেশের মানুষের কাছে অম্লান হয়ে রয়েছে। ২৯ এপ্রিল এই ভয়ংকর রাতে হাজার হাজার মানুষ হারিয়েছে পরিবার পরিজন। আপনজনদের সাথে ভেসে গেছে মাথা গোঁজার ঠাঁই। এ ঘূর্ণিঝড়ে দেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে চট্টগ্রাম জেলার উপকূলীয় এলাকা কুতুবদিয়া। শুধু কুতুবদিয়া সেদিন আনুমানিক ৪৫ হাজার মানুষ নিহত এবং কয়েকশ’ কোটি টাকার সম্পদ বিলীন হয়েছে। ২৯ এপ্রিলের সেই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার ২৫ হাজার নারী-পুরুষ প্রাণ হারায়। পাশাপাশি হাজার হাজার গবাদি পশু প্রাণ হারায়। সম্পদের ক্ষতি হয় প্রায় হাজার কোটি টাকার।
সেই মহাপ্রলয় এর ২৭ বছর পর ও আমাকে সেই রাতের ভয়ংকর স্মৃতি আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। সেই রাতে আমাদের ঘরে আমি আরর আমারর বাবা ছাড়া বাকীরা সবাই ফেনী নানার বাড়িতে ছিলো। আমাদের তখন টিনের ঘর। টিনের ছাউনি টিনের বেড়া, ফলে বাতাসের তাণ্ডবনৃত্য আর গাছগাছালির প্রচণ্ড আঘাতে অবর্ণনীয় ভীতি কাজ করেছিল। এরর মধ্যে উঠোনের একটি আমগাছ, এক্টি নারকেল গাছ উপড়ে পড়ে। আমরা ভয়ে ছিলাম কারণ আমাদের ঘরের চার দিকে নারকেল সুপারি আরর আমগাছে ভরা ছিলো।
পরদিন সকালে বাতাস কমে আসে,
কিন্তু আশপাশের অন্যান্য বাড়িঘর আর অন্যান্য ক্ষয় ক্ষতি গুলো দৃশ্যমান হয়ে উঠছিল।
মহান আল্লাহ পাকের দরবারে সেই দিনের কাছে আমরা পানহা চাই। আর পার্থণা করি তাদের জন্য যারা সে দিন প্রাণ হারিয়েছেন।
সে সব বোব পশুর জন্য যারা ভয়াবহ মৃত্যুকে বরণ করেছে বন্দী অবস্থায়।
আর পানহা চাই
আগামীর জন্য
আল্লাহ যেন সবাই কে হেফাজত করেন। তার রহমতের
আশ্রয়ে ঠায় দেন।
লেখক: দাউদুল ইসলাম
২৯শে এপ্রিল২০১৮
মিরসরাই।
loading...
loading...
করুণাময় ঈশ্বর সবাইকে ভাল রাখুন। দুঃসহের স্মৃতি মানুষ ভুলতে পারে না।
loading...
মহাপ্রলয়ের সেই রাতকে কে ভুলতে পেরেছে ? আমাদের জাতিয় জীবনের এক মহা বিপর্যয়ের রাত। এই সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া আদৌ সম্ভব হবে কিনা আমার জানা নেই। মহান আল্লাহ পাকের দরবারে সেই দিনের কাছে আমরা পানহা চাই। আর প্রার্থণা করি তাদের জন্য; যারা সে দিন প্রাণ হারিয়েছেন। আমীন।
loading...