আজ ৩ মে। আজ শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ৮৮ তম জন্মদিন। ১৯২৯ সালের ৩ মে জননী পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় জন্ম নেন। ৪২ সালে এসএসসি, ৪৪ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন। ভর্তি হন কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। সেটা ১৯৪৫ সাল।এরপর ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড শেষ করেন। ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৫ সালে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ করেন।
তাঁর কর্মজীবন কেটেছে ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়, ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে শিক্ষকতা করে । ১৯৯১ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান। এছাড়াও তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার।
আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর ছেলে শাফী ইমাম রুমী শহীদ হন। কী দুর্ভাগ্য জননীর ! মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বামী শরীফ ইমামও মারা যান। ৭১ সালে স্বামী আর সন্তান হারানো জননী স্বাধীনতা উত্তর এদেশের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির উল্থানের পক্ষে তিনি ছিলেন প্রথম কাতারের সৈনিক। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর উপন্যাস বা দিনলিপি যাই বলিনা কেন, একাত্তরের দিনগুলি ছিলো একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মায়ের দৃঢ়তা আর আত্মত্যাগের অনন্য উদাহরন।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে লেখক জাহানারা ইমামের আত্মপ্রকাশ। প্রথমে তাঁর পরিচয় ছিলো একজন শিশুসাহিত্যিক হিসেবে। ছোটদের জন্যে খুব প্রয়োজনীয় কয়েকটি বই তিনি অনুবাদ করেন। বইগুলো পাঠক সমাদৃত হয়। তবে ‘একাত্তরের দিনগুলি’ রচনা করেই তিনি পৌঁছে যান পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জাহানারা ইমাম লেখালেখিতে ব্যস্ত সময় কাটান এবং তাঁর প্রধান গ্রন্থগুলি এ সময়ে প্রকাশ পায়।
গল্প, উপন্যাস ও দিনপঞ্জি জাতীয় রচনা মিলিয়ে তাঁর গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: অন্য জীবন (১৯৮৫), বীরশ্রেষ্ঠ (১৯৮৫), জীবন মৃত্যু (১৯৮৮), চিরায়ত সাহিত্য (১৯৮৯), বুকের ভিতরে আগুন (১৯৯০), নাটকের অবসান (১৯৯০), দুই মেরু (১৯৯০), নিঃসঙ্গ পাইন (১৯৯০), নয় এ মধুর খেলা (১৯৯০), ক্যানসারের সঙ্গে বসবাস (১৯৯১) ও প্রবাসের দিনলিপি (১৯৯২)। জাহানারা ইমাম সাহিত্যকর্মের জন্য স্বাধীনতা পদক (১৯৯৭), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮), কমর মুশতরী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮), বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১), আজকের কাগজ হতে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা পুরস্কার (বাংলা ১৪০১ সনে), নারী গ্রন্থ প্রবর্তনা (১৯৯৪), রোকেয়া পদক (১৯৯৮) প্রভৃতি পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
উল্লেখ্য যে, ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায় মিশিগানের ডেট্টয়েট নগরীর সাইনাই হাসপাতালে ৬৫ বছর বয়সে জাহানারা ইমাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে জাহানারা ইমামের জ্যেষ্ঠ পুত্র শফি ইমাম রুমী গেরিলা বাহিনীতে যোগদানের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কয়েকটি সফল অপারেশনের পর তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে আটক হন এবং নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে শহীদ হন। জাহানারা ইমাম পরিচিতি পান ‘শহীদ জননী’ হিসেবে।
শহীদ জননীর নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি গঠন করা হয়- ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। এর পাশাপাশি ৭০ টি সংগঠনের সমন্বয়ে সেবছরই ১১ ফেব্রুয়ারি গঠন করা হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি। যার আহবায়কও ছিলেন জননী জাহানারা ইমাম।
এরপরের ঘটনা বড়ই নির্মম ! যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে আমাদের জননীকে রাস্তায় নামতে হয়েছিলে। ততদিনে তাঁর সারা শরীরে দুরারোগ্য ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে। তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যায়। একদিকে রাষ্ট্রপক্ষ তাদের রাজনৈতিক বান্ধব দলের মানূষরুপী পশুদের বাঁচানোর জন্য মরিয়া, অন্যদিকে রাস্ট্রপক্ষের মদদপুষ্ট হয়ে সরাসরি আক্রমন করে বসে ৭১ সালের হায়েনাদের দল- গোলাম আযম নিজামী গং। জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে মামলা হয় রাষ্ট্রদ্রোহীতার। কী দুর্ভাগ্য আমাদের, জাতী হিসেবে কী অকৃতজ্ঞ, অসভ্য আর বর্বর আমরা !
অবশেষে, রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা মাথায় নিয়েই আমাদের জননী জাহানারা ইমাম ২৬ জুন ১৯৯৪ সালে দেশের বাইরে মিশিগানে ইন্তেকাল করেন। আজ তাঁর জন্মদিন। মাগো, তুমি যেখানে যে অবস্থায় আছো- ভালো থেকো মা ! শান্তিতে থেকো ! পারলে আমাদের মত অকৃতজ্ঞ জাতীকে ক্ষমা করে দিও মা ! তুমি জানো মা, তোমার দেখিয়ে দেয়া পথে এখনও আমরা হাঁটছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে হাজারো মানুষ আজ সোচ্চার। মনে রেখো মা, এদের বিচার হবেই এ মাটিতে… এ আমাদের দৃপ্ত শপথ।।
মা কে নিবেদিত আমার কবিতা:
মাতৃত্বের ক্যান্সার
**************
অ ঠাঁই রক্ত নদীর বুকে জেগে উঠা চর
নাম তার বাংলাদেশ !
রক্তের লাল, উত্তাল জোয়ার পেলে দুর্মর
বাঁধ ভেঙ্গে মিশে বিশাল সমুদ্রে
নাম তার বঙ্গোপসাগর!
ক্ষরণের যন্ত্রণা নিয়ে যে কিশোরী
নিজে ঢেকেছে সবুজের চাদরে
নাম তার সুন্দরবন!
মরণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
যে পাখিটি আজো উড়ে স্বাধীনতার নেশায়
তার নাম দোয়েল!
গর্জনে তর্জনে উত্তাল সাইক্লোনে
যে জননী অতন্দ্র প্রহর গুনে
তারায় তারায় খুঁজে যুদ্ধে যাওয়া সন্তানের মুখ
নাম তার রেসকোর্স ময়দান!
পূর্ণিমার মায়াবী জ্যোৎস্নায়
নাকের নোলক, কপালের টিপ, পায়ে আলতা সাজায়
দীর্ঘশ্বাসে বুকের গোপন ব্যথায় কুরে কুরে খায় যে নারীর
নাম তার বীরাঙ্গনা!
স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর ও
মিটেনি রক্তের তীব্র তৃষ্ণায় আকণ্ঠ রাজাকার!
বেজন্ম চেতনায় ফিরে এসেছে দস্যু হানাদার
মায়ের আঁচলে বেড়ে উঠা মানব সন্তান
মায়ের সম্ভ্রম লুণ্ঠনে কাঁপেনি দানবীয় হাত তার!
বিজয় বিজয় করে যতোই করো চিৎকার
শুনে রাখো হে বাংলার পতাকা
তোমার অস্তিত্বে বেড়ে উঠেছে নির্মম ক্যান্সার!
– দা উ দু ল ই স লা ম
( লিখাটি তথ্যসূত্র বিভিন্ন ওয়েব সাইট, সংবাদ পত্র, ও উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহীত)
loading...
loading...
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এর মতো মহিয়সী নারী এবং সুযোগ্য মাতার প্রতি হৃদয় থেকে শ্রদ্ধা রাখি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে হাজারো মানুষ আজ সোচ্চার। মনে রেখো মা, এদের বিচার হবেই এ মাটিতে… এ আমাদের দৃপ্ত শপথ।
মায়ের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ অসাধারণ হয়েছে স্যার। অপূর্ব।
loading...