সাত
— চাঁদ, যা দিদিকে ডেকে আন তো। রুটিক’টা বেলে দিক।
— এই ছোড়দা, দিদিকে ডাক।
— আমার বয়ে গেছে।
শিউলিকে পাচ্ছ না? দ্যাখো গে’ খুকুর কাছে ব’সে। খুকুর খোঁজ নেই? সে নিশ্চিত শিউলিদের ঘরে। চাঁদ তিনটে ফ্যানাভাতের গন্ধ, সাত সুপুরিগাছ আর তেইশটা রোদ্দুর পেরিয়ে সুশীলকাকুর বাড়ি পৌঁছে গলা খাঁখারি দিল। বারান্দায় উপুড় টিনের কৌটো, পাঁচছটা পুরনো পুঁতির মালা থেকে ভালো পুঁতিগুলো ছিঁড়ে শিউলি মাটিতে রাখছে… নাকি নিজেই খ’সে যাচ্ছে টাপুস-টুপুস; আর খুকু, ভালো নাম অশোকা, সেগুলো লাল কারে গেঁথে নিলেই নতুন মুক্তোহার!
— খুকুদি, তোমার বন্ধুকে মা ডাকছে।
— আমার বন্ধু সবাই। তুইও তো।
— আমি তোমার ভাই না? সবুজ রঙের ফ্রক পরা বন্ধুকে ডাকছে।
দুজনে এক-নদী হেসে গড়িয়ে পড়ল।
— এখানে সবুজ ফ্রক পরা কোনও মেয়ে নেই।
— না না সবুজ না, নীল।
এবার ফুঁসে উঠবে দাঁতের ফেনা-ঘেরা হাসির সমুদ্র।
— হোই রঙকানা, মাসিমা যাকে ডাকছে তার নাম বল।
নাম মুখে আনার নিয়ম নেই, খুকুদি ভালো ক’রেই জানে। কিন্তু চাঁদের বুদ্ধি কি কিছু কম?
— তালিবোশ্শ’য় রোশ্শি, রস্সোউ, ল’য় রোশ্শি।
আট
শিউলি কদবেলমাখা ক’রে সবাইকে দেওয়ার সময়ে দিদিমা বলেছিল :
—আমার ভাগেরডা তুই নে গে, বুনডি। আমার দাঁত কদবেল খালি ট’কে যায়।
এ-বাবা, ফলস দাঁত আবার টকে কী ক’রে! বাসু অবাক।
— তোমাগো ফলস দাঁত আছে যে জানবা?
তার এই আনজাস্ট এনরিচমেন্ট ঠেকাতে চাঁদ পেছন থেকে ডিঙি পেড়েছে বুঝে শিউলি টপাৎ ক’রে গোটা দলাটা মুখে পুরে দুটো বিশেষণ ছুঁড়ে দেয় : ১/ ছোঁচা ২/ পাতকুড়োনি, আর উড়ে আসা কিলের কথা ভেবে কুঁচকে রাখে পিঠ।
ওসবে না গিয়ে ভাই তার বাঁহাত খুঁজছে… শিউলি হাত মুঠো ক’রে পেছনে লুকোলো। ছেলেটা তখন মগ জলদস্যু, এক চোখে কালো কাপড়ের ঠুলি, দিদির কব্জি কামড়ে ধরেছে। ওর গজদাঁত দিয়ে ঝরঝর ক’রে পানখাওয়া রক্ত পড়ছিল নিশ্চয়ই, নাহলে মুঠো চিৎকার ক’রে খুলে যাবে কেন? ওমনি চাঁদ নিজের বাঁহাতের কড়ে আঙ্গুল শিউলির কনিষ্ঠায় পেঁচিয়ে ছেড়ে দেয় — আড়ি!
আড়ি, বলতে গেলে, ভালো। বাড়িতে যখন ঢের সারে বাচ্চা, তাদের ক্লোজড গ্রুপে দাঙ্গা ঠেকাতে আক্রোশকে খসখসে অভিমানে মুড়ে ফেলার নামই আড়ি। আর অভিমান কিছুদিন পরে বাতাসের জলীয় বাষ্প শুষে খামের ভেতরের রাগটাকে পচিয়ে দেবে। হয়ত তখনও রাস্তায় কারফিউ, কিন্তু বাগানের দুই গাছই মাথা দুলিয়ে ‘রাজি’ বলছে।
বড়দের কি আড়ি হয় না? গত বছর মান্নাপাড়ায় ভাড়াটে-বাড়িওলা তুমুল ক’রে দুজনেই কোর্টে কেস ঠুকে দিয়ে এল। মহকুমা আদালতে ডেট পড়ে; কোনও দিন এনার উকিল গায়েব, কোনওদিন ওনার। একই ট্রেনে কোর্টে হাজির হয়ে ঠনঠনে রোদে শিরিষতলায় দুজন-দুদিকে-মুখ ব’সে থেকে থেকে আবার একই ট্রেনে একই বাড়ি।
তার মধ্যে হঠাৎ বাড়িওলা শসা কিনে কলাপাতা-সমেত বাড়িয়ে দিয়েছে ভাড়াটের দিকে। সে আড়ষ্ট হাতে গ্রহণ ক’রে রোদের তেজ কমলে নিল দুটো চা। পাশাপাশি ভাঁড়ে চুমুক, ছেলের পরীক্ষা বা বাজারদর নিয়ে শৌখিন কথা; ভেতরে ভেতরে তখন ওই কবিতাটা হচ্ছে — কে বলে তোমারে বন্ধু অস্পৃশ্য, অশুচি…।
মায়া ভেবেচিন্তেই চাঁদকে পাঠিয়েছিল দিদিকে ডেকে আনতে, তারপর সে ‘ও গৃহস্থ’ ডাকা লোকটার কাছে গিয়ে বসে :
— আপনার ছোট পুত্র আর বড় কন্যার তো মুখ-দেখাদেখি বন্ধ আজ দুই সপ্তা।
— ও, আড়ি? আড়ি-তে গাইছে দুজন? দুরূহ কাজ কিন্তু, শমের আধ মাত্রা পরে ধরতে হবে। গাইতে পারলে অন্যরকম চার্ম তৈরি হয়! যেমন, ‘আজু বহোত সুগন্ধ পবন সুমন্দ মধুর বসন্ত্’, রাগ বাহার। হাতে তালি দিয়ে নির্মল দেখাতে থাকে — ধা দেন্ তা, তেটে কতা, গদি ঘেনে, ধা-আজু বহোত…।
আট
রেল স্টেশন থেকে কাঁচা রাস্তায় নামল দুটো পালতোলা নারী-পুরুষনৌকো। দেখে পুকুরঘাটে কাপড়-আছড়ানো ঘোমটা স্থির, বটতলায় বিড়িটানা আঙুল নেমে এল ঠোঁট ছুঁতে গিয়ে — কতটা লম্বা দেখেছ, কী সুন্দর জুতো, কী ভারি-ভারি গয়না, সঙ্গে আবার চাকর, তার কাঁধে কত বড় ব্যাগ! সব পয়সাওলাই রাস্তার চোত্রাপাতা-চোরকাঁটা বাঁচিয়ে, কুকুর-মানুষের গু বুঝে পা ফেলে তারপরেও দুটি হোঁচট খেয়ে গ্রামের কুটুমবাড়ি পৌঁছোয়। কিন্তু কলকাতার বড়লোকদের কাঁধের পেছনে আলোর ঝালর থাকে — জাদুকর ম্যানড্রেক! তারা কোথাও হাজির হলে আচমকা বায়ুপ্রবাহ বেড়ে যাবে; শিমূলগাছ দুটো তুলোফল ঝরাতে গিয়েও — থাক বাবা, যদি মাথায় লাগে; শালিখপাখি ঘেঁটি বেঁকিয়ে পাড়ার বেড়ালকে জিগ্যেস করবে — কোন কূলে আজ ভিড়ল তরী, আইডিয়া আছে?
চাঁদ বাড়ি ফিরে দ্যাখে ভবানীপুরের মাসি উঠোনে চৌকিতে ব’সে হ্যাঁচ্চাই এক ব্যাগ খুলে জিনিস বের করছে তো করছেই — বাবার জন্যে সাধনা-র চ্যবনপ্রাশ, দিদিমার জন্যে নতুন থান, চাঁদের কেডস, গোপুর জন্যে বর-বউ পুতুল, শিউলির ফ্রক… মায়ের কিছু নেই? এই যে, দুকেজি সরষের তেল! দেখতে দেখতে উঠোনটাই দোকান, পাড়ার লোকেরা নেড়েচেড়ে দেখছে জিনিসপত্র, মাসি উঁচু গলায় দাম শোনাচ্ছে, তার মধ্যে দিদিমা : সঞ্জুভাই, বালতিতে জল ভরো, অশ্বিণী চান করবে। উঠোনে আর একটা জলচৌকিতে মেসো গা আগ্লা ক’রে বসলে চাঁদ আর গোপু ছোট ছোট থাবায় তার আঁচিলখচিত পাহাড়-পিঠে তেল ড’লে দিচ্ছে। বদলে দুজনের চ্যাটচেটে হাতে পাঁচ পাঁচ দশ নয়া।
রানীর রাজপুত্রকন্যা নেই, সেই যন্ত্রণার ওপর সে ধনসম্পদের ডাকটিকিট চিটিয়ে রাখতে চায়। মায়াকে বিদ্রূপ করে বছর-বছর বাচ্চা বিয়োনোর জন্যে, আবার খুব ইচ্ছে দিদির একদুটো সন্তান নিজের পরিচয়ে মানুষ করবে। তারা ঘটাং-ঘটাং কাশবে না, চপর-চপর ভাত চেবাবে না, কুজড়িমুজড়ি জামাকাপড় প’রে বেরোবে না রাস্তায়, কলকাতার সবচেয়ে ভালো স্কুলের ছাত্র হবে।
দিদির ‘হ্যাঁ’ না পেয়ে রানী নিমতিতা কলোনিতে আসা কমিয়েছে, এলে দুকেজি সরষের তেলের হিংসেঝাঁঝ ছড়িয়ে যায়।
শিউলি ভাইয়ের পেছন পেছন বাড়ি ফিরে মাকে ধরল।
— মাসি এই আমাদের বাড়ি এসে আবার এই বারাসাত চলে যাচ্ছে কেন?
— যাচ্ছে পদ্মর সঙ্গে দেখা করতে। দুই বাঁজায় ব’সে পরের সংসারের মুন্ডুপাত করবে না?
নয়
ঋজুদার মতো পদ্মপিসির গল্পটাও অ্যাডাল্ট, শিউলি দিদিমাকে তুইয়ে-তাইয়ে শুনে নিয়েছে :
সাত-আট বছর বয়েসেই পদ্মকুঁড়ির বিয়ে হল পঁচিশ বছরের জোয়ান ছেলের সঙ্গে। রাত্তিরে সে ঘরে ঢুকলেই বউ আপাদমস্তক চেঁচাত। কিছুদিন পরে মা ছেলের দ্বিতীয় বিয়ে দিল; প্রথম জন ফিরল তার মাসির শ্বশুরবাড়ি, সিদ্ধান্তপাড়ায়।
আস্তে আস্তে সে-মেয়ে বড় হয়, অতি নম্র, মাটি দিয়ে হাঁটলে মাটিতে আওয়াজ হবে না; আর এমন রূপসী, পুকুরঘাটে গেলে বৌঝিরা কথা থামিয়ে তাকিয়ে থাকে। তখন খবর পেয়ে তার বর লুকিয়ে লুকিয়ে পদ্মর কাছে আসতে লাগল। এদিকে তোমাদের বাড়িতে অনেক দিনের পুরনো এক কুরির মেয়ে ছিল, সে জন্ম-বোবা।
— কুরি মানে কী, দিদ্মা?
কুরি হচ্ছে ময়রা। কাজের মেয়ে হলে কী হবে, জোচ্ছোনার ভীষণ দাপট। বাড়িতে ভিখারি এলে নাদু চাল-আলু দিতে গেছে, সে বারান্দায় ব’সে ইশারা করছে — অত চাল দিয়ো না। শীত হোক বর্ষা হোক, জ্যোৎস্না শুতো বাড়ির বারান্দায়। সে ধরে ফেলল, পদ্মর বর গভীর রাতে তার কাছে আসে, পদ্ম নিঃসাড়ে দরজা খুলে দেয়, আবার শেষ রাতে ঘর থেকে তাকে লুকিয়ে বের করে।
যদি মেয়েটার পেটে বাচ্চা এসে পড়ে, কী হবে! হিন্দুদের মধ্যে দুই বিয়ে তখনও করে কেউ কেউ, কিন্তু এক বউয়ের হাল হয় রক্ষিতার মতো। বাণীনাথ শালীর মেয়েকে বললেন, জামাকাপড় গোছাও। বাগেরহাটে গরীব বাপমা-র কাছে ফিরে গেল পদ্ম, সেখান থেকে দেশভাগের পর দুই ভাই বৈদ্যনাথ আর অজিতের সঙ্গে হিন্দুস্তানে।
কিন্তু দুঃখের কথা কি জানিস? পদ্মপিসির কোনওদিনও সন্তান হতো না। শরীর খারাপই হতো না ওর। তোদের ঠাকুর্দা জানত না, বলার সাহসও কেউ দেখায়নি।
— দিদ্মা, পিসি এখনও শাঁখাসিঁদুর পরে ক্যান্?
— বরের তো কোনও দিশে-হদিশ নেই, আইনমতোন ছাড়াছাড়িও হয়নি। ওই শাঁখাসিঁদুর নিয়েই চিতেয় উঠতি হবে পদ্মর।
শিউলি কিছুক্ষণ হাঁ হয়ে ব’সে থাকে। তারপর হাসি পায় তার ঠোঁটদুটোর :
— বলো দিদ্মা, সারা জীবন মাছ খাতি পারবে পদ্মপিসি!
.
(চলছে)
loading...
loading...
যাপিত জীবনের অসাধারণ শাব্দিক প্রকাশ। একরাশ শুভকামনা প্রিয় কবি চন্দন দা।
loading...