জিততে গেলে হেরে যাব

চার
শিমূলগাছের শেকড় থেকে উড়ে আসছে পিন্টু; উড়ছে ব’লে অবিরাম সাইকেলচালনার দিনে খোঁড়া গর্ত, ছাগলবাঁধার খুঁটো, একতাল গোবর — কিছুই তাকে থামাতে পারছে না। পৃথিবীর দীর্ঘতম রান-আপ নেওয়া বোলার হয়ত পিন্টুই। মাঠের শেষে একটা ছোট নালা, ওপারে রাস্তা, তার পেছনে ঝোপঝাড়। ব্যাটসম্যান বুঝে পিন্টু অনেক সময় সেই অরণ্য ফুঁড়েও টেক-অফ করে। ক্যাম্বিজ বল আর বাঁশের চটা কেটে বানানো উইকেটের মধ্যে যে দাঁড়িয়ে, তাকে সরানোর জন্যে সে জীবন দিতে রাজি।

ডেলিভারি দিয়েই পিন্টু দাস, ক্লাস সেভেন, গাজন-সন্ন্যাসীর মতো উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। খুব বেশি আত্মাহুতি সহকারে বল করলে এমন হয়। ওদিকে চাঁদ হাফ ক্রিজ পর্যন্ত দেখতে পেল বলটা আসছে। এরপর সে অন্ধ হয়ে যায়। কোথায় ড্রপ, কোন স্ট্যাম্পে পড়বে এসব তথ্য না পেয়ে তার মাথা একশোভাগ আন্দাজের বশে শরীরকে চালিত করে। এবারও হাফ প্যান্টের নীচে ডান হাঁটু ভাঁজ খুলে হালকা এগোল, নজরুলমিস্তিরির বানানো লৌহশালকাঠের ব্যাট মুখ বের করল পায়ের পেছন থেকে এবং ঘটে গেল হলুদ ক্যাম্বিজের সঙ্গে নিখুঁত আঘাতময় হ্যান্ডশেক। মনে হতে পারে বলটাই অংক ক’ষে ছুটে এসে তার ব্যাটে ঘা মেরেছে। একজন দর্শক চেঁচাল, আরে আস্তে বল কর। বাচ্চা ছেলে, লেগে যাবে।
— বাচ্চা ছেলে? হুঃ! পুরো বিটিশ মাল। আউট ক’রে দেখাও দেখি।

চাঁদের জীবন মানে অর্ধেক জানা আর অর্ধেক ভাবনা। কিছুটা বোঝার পর সে বাকিটুকু আইডিয়া ক’রে দ্যাখে — যা ভেবেছিল, মিলে গেছে। সত্যি বলতে, কোনও কিছুরই শেষ দেখা যায় না, তামাম দৃষ্টিগোচর করতে গেলে এক অন্ধত্ব চেপে ধরবে। সত্তার অথৈ জায়গায় চাঁদ দৃষ্টিহীন, সেই তমসার ক্রমপ্রসার হয়ে চলেছে। কল্পনা দিয়ে সে প্রাণপণে নিজের গা-ভর্তি অন্ধকারকে আটকাতে চায়।

পাঁচ
আহ, ব্যাটেবলে হতেই গ্রিপে একটা বিনবিনে ঝাঁকুনি কী যে আরামের! মাঠভর্তি ফিল্ডিং খাটছে আজাদ হিন্দ ক্লাবের পুজো-সেক্রেটারি রঞ্জনমামা, কোলকুঁজো ভাইডি, দোতলাবাড়ির বড়লোক বিশ্বরঞ্জন, ট্রেনে রুদ্রাক্ষ বিক্কিরি করে জয়ন্ত; আর ভালো ক’রে সাত বছরও হয়নি একটা বাচ্চা তাদের টাকাপয়সা, মস্তানি ব্যর্থ ক’রে দিচ্ছে গোটা বিকেল ধ’রে। আরও বেশি শহিদ-মনোভাব নিয়ে রান আপে ফিরে যাচ্ছে পিন্টু, হাবুল এত ছোট সিলি পয়েন্টে উবু হয়েছে যে বোলারের ডেলিভারি তার পেছন শুলিয়ে দেওয়ায় হা-হা অট্টহাস মাঠে। খেলায় এতক্ষণ এলবিডবলিউ ছিল না, এবার “পায়ে লাগলে আউট কিন্তু”। ওমনি রাজনৈতিক নির্দেশ আসছে, পায়ে মার। সেরা চোট্টা মানিক মালো উইকেটের পেছনে হুমড়ি খেয়ে; চাঁদ একটা বল ফসকালেই অফ স্ট্যাম্প হাত দিয়ে ফেলে দাবি করবে — বোল্ড! সেও হচ্ছে না দেখে মানিক বোলারকে ইশারা করল বাম্পার দে, চাঁদ ব্যাকফুটে আসতেই লেগের বেল খসিয়ে দিয়েছে — যাও, হিট উইকেট! মাঠে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার হাততালি, কেউ দৌড়ে যাচ্ছে শয়তানটার ব্যাট কেড়ে নেবে, সেই মুহূর্তে চক্ষুলজ্জাপূর্ণ সেক্রেটারি বলল, ভ্যাহ্‌, ওকে খেলতে দে। কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছিল একটা ভোটকা-মতো লোক, পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে দেখে বন্ধুকে : পুরো এম এল জয়সিমা!

পিন্টু শুনতে পেয়েছে।
— ল্যাটা ব্যাটসম্যান না? উইকেট গার্ড ক’রে খ্যালে। ডান হাতে খেলুক, চ্যালেঞ্জ দিলাম — এক বলে প্যাভিলিয়ানে ফেরত পাঠাব!

ওসব বাতেলা পরে। এই চাঁদ, এবার ছাড়; পার্টি ক’রে খেলা হবে।

ইশ, আজ তার হাত একদম জ’মে গেছিল; টানা রুখে যাচ্ছিল বলের অপরাধ প্রবণতা। উইকেট ভেঙে যাওয়ার মধ্যে একটা সন্ত্রাস আছে — বাড়ির খোড়ো চালে দাঙ্গার আগুন লাগিয়ে দেওয়ার মতো। তখন গৃহস্থ যেভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটছে, ব্যাটসম্যানকেও ক্রিজ ছেড়ে পালাতে হয়। ব্যাটিং ক্রিজ মানে ঠাকুরের থান, লক্ষ লক্ষ মানুষ এখানে ব্যাট ঠুকেছে, একটা কাঁকর জমতে দেয়নি; এবং পরিস্থিতির দাবি মেনে নিজেকে নিয়ে গেছে কখনও কেল্লা কখনও গোলাবারুদের ভূমিকায়।

ছয়
চাঁদপ্রতাপ সারা জীবন চিতোরের দুর্গ হয়েই থাকতে চায়। কলোনি-কিশোরদের দুজন নিতাই আর বলাই ক্যাপ্টেন হয়ে পার্টিভাগ করছিল। নিতাইয়ের বাবা আর বলাইয়ের মা ভাইবোন। মামার ছেলে নিতাই প্রথমেই ডাকল — চাঁদ। ভুল হল, কম্পিটিশান ম্যাচে ভাইডি বা সুরজিতের মতো তাড়ু ব্যাটসম্যান নেওয়া উচিত, চাঁদ তো চার মারতেই পারে না।

টসে জিতে মাসির ছেলে বলাই ব্যাটিং নিতেই খালি গায়ে মায়ের শাড়ি পরা ভাইডি ওপেনিংয়ে। কাপড়ে বল আটকে যাবে আপত্তি আসায় সে মালকোঁচা মেরে নিচ্ছে। এবং বোলারের মুখোমুখি দুপা ফাঁক ক’রে দাঁড়িয়ে মাঝখানে লুচিভাজার ঝাঁঝরি-হাতায় বলটা নিয়ে উইকেটকিপারের মাথা টপকে বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে দিল। হু-হু ক’রে রান উঠছে দেখে মাসির ছেলে এই বেআইনি অরাজক ব্যাটিংয়ের প্রতিবাদ করে, খেলা তিন মিনিট বন্ধ থেকে আবার শুরু হয়।

একা ভাইডিই মামার ছেলের দলের রানকে লোভনীয় জায়গায় নিয়ে গেছে। এবার মাসির ছেলে ওপেনিং-এ দলের শ্রেষ্ঠ হয় ছক্কা নয় ফক্কা প্লেয়ারের সঙ্গে এক দিক ধরে থাকবি-কে নামিয়ে দিল। চাঁদ মর্যাদা সহকারে ঠুকে যাচ্ছে, ক্কচিৎ ব্যাট কাত ক’রে স্লিপের মাঝখান দিয়ে বাউন্ডারি ওয়ান; কিন্তু শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হচ্ছিল স্ট্রোক মেকাররা। ফোকলা দাঁতের মতো তাদের মিডল স্ট্যাম্প উড়ে যাচ্ছে, অথবা কারও তীব্র হাঁকড়ানো বাড়ানো হাতে জমিয়ে নিল ফিল্ডার। তখনও সন্ধে মিনিমাম আধঘন্টা দূরে, জিত আঠাশ রান তফাতে, ব্যাটসম্যানেরা প্যাভিলিয়ন নামের ওলটানো জংধরা বাতিল রেলের পাটির ওপর। একা চাঁদ নট আউট ব’লে ম্যাচ খতম হয়নি।

এই রকম সংকটে বাবা-কাকারাও দাঁড়িয়ে যায় মাঠের পাশে, পতৌদি-চন্দ্রশেখর-সেলিমদুরানি পর্যায়ে চলে যায় স্থলযুদ্ধের গভীরতা। ফিল্ডাররা চাঁদকে প্রণাম-দূরত্বে ঘিরে আছে আর সে হোমিওপ্যাথির সূক্ষ্ম মাপে নিজের আবছা চোখদুটো বসিয়ে নিয়েছে ব্যাটের গায়ে। নির্যাতিত ঘাসের গন্ধ, নিকেলের মতো বিকেল, লেগসাইডে শাপলাপাতার সরপড়া পুকুর — সবকিছুর মাঝখানে বল বোলারের চেয়ে ব্যাটসম্যানের ঘনিষ্ঠ হতে চাইছে বেশি। দর্শকদের মধ্যে এসেছে কানাইস্যার, নিবাধুই স্কুলের গেমস টিচার :
— ওডারে কী কয়, খ্যালা না ক্যালা? তহোন থে’ কুলো পাতে যাচ্ছিস মায়েগোর মতো! মারবি কবে?

পরের বলটা হাঁকাতে যায় চাঁদ, মিস ক’রে এক চুলের জন্যে বাঁচে। ডাঙশের মতো ভারি ব্যাট চাগাতে গেলে ব্যাক লিফট নামার আগেই বল উইকেট ভেঙে দেবে। খালি পায়ে মাটির ঠান্ডা তাত নিতে নিতে সে আবার ঝুঁকে স্টান্স নেয়। পেছনের তিনটে উইকেট আসলে মা-বাবা-দিদিমা, অথবা তার তিন দাদা-দিদি। তাহলে ছোটবোন কী হবে? গোপু একটা বেল, আর একটা বেল কিশমিশ, যদি কোনও দিন ফিরে আসে!

সাড়ে পাঁচটা বাজতেই মাসির ছেলে চিৎকার পাড়ছে : খেলা বন্ধ, ম্যাচ ড্র। মামার ছেলের কড়া প্রতিবাদ — বন্ধ কিনা, একমাত্র আম্পায়ার বলতে পারে। অনেক চাপাচাপির পর রঞ্জনমামা বুঝিয়ে দিল, ব্যাটসম্যানকেই ‘আলোকাভাব’ ব’লে তার কাছে আবেদন করতে হবে। শব্দটা কলোনিতে কোনও জীবজন্তুপশুপাখির মুখে শোনা যায় না, চাঁদ তারক ডাক্তারের বাড়ি দৈনিক বসুমতী পড়তে যায় ব’লে জেনেছে। ক’দিন আগেই তো ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে টেস্টে মনসুর আলি খান পতৌদি গোপালকৃষ্ণণকে অনুরোধ করেছিল। খান না খাঁ; পতৌদি, পাতৌদি নাকি পতাউদি — এসব কনফিউশান মাথায় নিয়েই তাকে দলের চাপে ভারত-অধিনায়ক হতে হয়। তারপর সবাই চাঁদের পিঠ থাবড়ে দিচ্ছে; মাসির ছেলে বলছে, কেন কুলোপাতা প্লেয়াররে নিছিলাম, এবার বুঝিছো? আর ফাস্ট বোলার পিন্টু :
— সুব্রত-র ফুলটস বলও ঠুকে দিচ্ছিলিস কেন, এগিয়ে এসে মারবি টেনে ছয়! আর তো মোটে আট রান বাকি ছিল, জেতার চেষ্টা করলি না?

এখনও দিগ্বিজয়ের সময় আসেনি! ইশকুল, তারপর নাকি কলেজ, তারপর চাকরি, তারপর যতখুশি আইসক্রিম, চিটে গুড়, বুটভাজা বিজয় করো। নাকেমুখে ঘুষি খেয়েও পুরো বারো রাউন্ড টিকে থাকা মানেই কেল্লা ফতে, তারই বয়েসি বলরামকাকুর মেয়ে কর্ণফুলির মতো হঠাৎ নাকমুখ দিয়ে কৃমি উঠে শুঁটি নদীর শ্মশানে যাওয়া নয়। ড্র-ই ভালো, খেলায় থাকুক দু’পক্ষই, বাজিমাত করতে গিয়ে হট ক’রে না হারের মুকুট কিনে ফেলি!

.
(চলবে)

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
জিততে গেলে হেরে যাব, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৯-০৫-২০২৩ | ১৯:০৪ |

    মুগ্ধপাঠ প্রিয় কবি চন্দন ভট্টাচার্য দা। ভালো থাকবেন এই প্রত্যাশা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...