দুই
শিউলি ফাঁক খুঁজছিল। আড্ডা ভেঙে ননীবালা খোপের ঘরে গিয়ে পানের ডাবর খুলতেই সে গায়ে গা ঠেসিয়ে বসেছে :
— ও দিদ্মা, স্যানাটির সেনগুপ্তরা আমাগো আত্মীয় না?
বুড়ি ভুরু কোঁচকায়।
— টোরে টোইছে টেডা?
— মা তো চাপে গেল। সাজে-র মুখি শুনিছিলাম।
সাজে মানে সেজোপিসিমা কুন্তলা; বরফের মতো গায়ের রঙ, অখণ্ড সুন্দরী, জেদি মহিলাটি। নির্মলের চার বোনের মধ্যে মেজোজনের বাচ্চা বিয়োতে গিয়ে গোবিন্দপ্রাপ্তি হলে জামাইবাড়ি থেকে পরের মেয়েটিকে চাওয়া হয় এবং বাণীনাথ জামা থেকে টোকা মেরে পিঁপড়ে ফেলার মতো সে-প্রস্তাব বাতিল করেন। কিন্তু সেজো জানায়, বিয়ে করলে ওখানেই করবে। তার বোনপোকে তার মতো কেউ ভালোবাসতে পারবে নাকি!
পৃথিবীতে রাশি রাশি খোলামকুচির মতো মৃত্যু দেখেছে মানুষ, তার হাত-চোখ-কলজে-ফুসফুসের অধিক প্রিয়জনেরা চলে গেছে শ্মশানে-কবরে, তবু সে নিজের তিমির, নিজের নীরবতা, নিজের চিত্রার্পিত, নিজের গুহাবাস হয়ে কাটিয়ে গেছে আরও কত যুগ! অপরিণত মৃত্যুগুলো পরস্পর মিশে গিয়ে এক একটা প্রাণকে যেন পাথরের পরমায়ু দান ক’রে যায়।
কুন্তলাও বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে মা শীতলার কৃপায় স্বামীসন্তান হারিয়ে সিদ্ধান্তপাড়ায় ফিরে এল। এবার প্রথম গল্পের হাত থেকে ব্যাটন নিয়ে দ্বিতীয় আখ্যান ছুটতে শুরু করবে। হঠাৎ জানাজানি, বাণীনাথের বড় মেয়ে আভাময়ীর ছেলে ঋজু প্রেমে পড়েছে অব্রাহ্মণ, দু’বছরের বড়, বিধবা মল্লিকার। দামড়া নাতির পিঠে খান তিন কচার ডাল ভাঙার পরেও পথে আনতে না-পেরে বাণীনাথ তাকে ত্যাজ্য করলেন। সেটা উনিশ শো বেয়াল্লিশ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে জোর কদমে। বছরের শুরুতেই জাপান বার্মা আক্রমণ করেছে আর পাঁচ লাখ বার্মিজ শরণার্থী একটু ক’রে ভরিয়ে তুলছে ভারতবর্ষ, যেমন ১৯৪০ সাল থেকে প্রতি বছর বাংলার তিন লক্ষ টন চালের শূন্যতা বার্মা রাইস পূরণ করত। ১৯৪২-এর মার্চে জাপান রেঙ্গুন কবজা করে নেওয়ায় সেই আমদানি বন্ধ। আগের মাসে জাপান ব্রিটিশদের থেকে সিঙ্গাপুর কেড়ে নিয়েছে। আর, মার্চেই সার সার নিপ্পনি যুদ্ধজাহাজ উড়িষ্যা-মাদ্রাজের উপকূল ধ’রে এগোচ্ছে দেখে তারা বাংলা আক্রমণ করবে এই ভয়ে ইংরেজ সরকার ‘ডিনায়াল পলিসি’ ঘোষণা ক’রে দিল।
এদিকে, বাড়িখেদা হওয়ার পর ঋজুর আস্তানা সিদ্ধান্তপাড়া থেকে সিকি মাইলটাক দূরে চন্দনীমহল। গ্রামের শিকদার পরিবার কবেই ম’রেছেড়ে গেছে, পোড়ো বাড়িটার জঙ্গল সাফ ক’রে ব্লিচিং ছড়িয়ে গোটা তিনেক সাপ মেরে দুটো গিরগিটিকে বন্ধু পাতিয়ে সে থাকে। থাকে রাতের ঘুমটুকুর নিমিত্ত। গত সপ্তাহে আইএ পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোলে দেখা গেল ঋজু গোটা খুলনা জেলায় প্রথম। জেলাবৃত্তি তো পাবেই, তাকে সদর থেকে ডাক পাঠিয়েছেন অবিনাশচন্দ্র ঘোষ — খুলনা জেলা স্কুলের অধ্যক্ষ এবং ‘জ্ঞানাঞ্জন সমিতি’র সভাপতি। আগামী মাসে সমিতি ঋজুকে সম্বর্ধনা দেবে একগুচ্ছ বই, মিষ্টি আর ফুলের মালায়। তখন কথায় কথায় যেই জানা গেল বাড়ি থেকে উচ্ছেদের পর ছেলেটার থাকাখাওয়ার ঠিক নেই, অবিনাশবাবু চিঠি লিখে ঋজুর হাতেই পাঠালেন তার ভায়রার কাছে, কাটানীপাড়ায় — যুবকটিকে মাসিক আট টাকা বেতনে তোমার দুই যমজ সন্তানের গৃহশিক্ষক রাখিয়ো।
প্রতিদিন বিকেলবেলা কুন্তলা থালায় ভাত বেড়ে বোনপোর বাউন্ডুলে-আবাসে পৌঁছে যায়। ঘরে খাবারটা থালাচাপা দিয়ে মশারির চারকোনা বেঁধে একটা হারিকেন জ্বালিয়ে রেখে আসে। বাণীনাথ অনেক ধমকেছেন, কথা না শোনায় সেই কবে থেকে মেজোমেয়ের সঙ্গে তার আড়ি। এছাড়া ভটচাজবাড়ি থেকে নিয়মিত দুবেলা গাল পড়ে সেনগুপ্তদের উদ্দেশ্যে। কোনও দুপুরে চন্দনীমহলের বকুলতলায় ঋজু-মলিকে কথা বলতে দেখা গেলে, কোনও বিকেলে দুজনকে দিঘলিয়ার হাটে গরুর গাড়ির পেছনে ঠ্যাং দুলিয়ে বসতে শোনা গেলে তিরস্কার পালটে যায় অভিশাপ-প্রদানে : আমার ছেলেডার জীবন নষ্ট করিছিস, মুখি রক্ত উঠে মরবি সবাই। তোগো জন্যি চোখের জল ফেলারও লোক থাকপে না।
এভাবে একদিন পরিত্রাহি চিৎকার রাস্তার ওপার থেকে… বিভাময়ী ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে গিয়ে দ্যাখে, নার্সিং স্কুল থেকে ফেরা, খাতার পৃষ্ঠার মতো রোগা মেয়েটাকে মা টানতে টানতে রান্নাঘরে এনে এক হাতে মাটিতে মুখ খুঁসে ধরেছে, অন্য মুঠোয় খাঁড়া অথবা আঁশবঁটি। সেদিন সন্তানহত্যার পাপ থেকে বেঁচে গেল মলির মা, তাকে নির্বংশ হওয়ার শাপ দেওয়া মহিলাকে জড়িয়ে হাউহাউ কাঁদতে থাকল।
তিন
সরকারি ‘প্রত্যাখ্যান নীতি’ লাগু হতেই রুক্ষ হাওয়ায় যেমন দীঘির পদ্মপাতার তেলতেলে ওপরপিঠ উলটে গিয়ে শিরাজালে ভরা ফ্যাকাশে নিম্নতল দেখা যায়, গ্রামজীবনের শান্ত নকশার নীচে তার চিরবহমান ক্ষিদের ছবিটা ফুটে উঠেছে। জাপানি সৈন্য বাংলায় ঢুকলে যাতে খেতে না পায় — বাখরগঞ্জ, খুলনা আর মেদিনীপুরের সমুদ্রবন্দর থেকে তিরিশ হাজার টন চাল তুলে উত্তরবঙ্গে পাঠিয়ে দিল সরকার। তারপরেও বাতাসে ফিসফিসানি পাক খায় : আমাদের সেনারা চারদিকে মজুত চাল নষ্ট করে বেড়াচ্ছে; পূর্ববঙ্গের তিনটে নদীবন্দরে রাখা আরও হাজার টন শস্যকে দেওয়া হয়েছে জলকবর। অথচ দেশের খবরের কাগজগুলোয় এ-সংবাদ নেই, রেডিয়ো নিউজ টুঁ শব্দও করছিল না। ঋজু বিএ-তে ব্রজরাজ কলেজে ভর্তি হয়েছে ব’লে এখন মাসের অর্ধেক অবিনাশ ঘোষের বাড়িতে কাটায়। একদিন ভোরে অবিনাশবাবু তাকে সমিতির দশবারোটা ছেলের সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন রূপসা-ঘাট। সেখানে পৌঁছে দেখা গেল, নদীর চরে পাহাড় সমান উঁচু চালের বস্তার লাটে চারপাঁচটা পুলিশ আর ক’জন মজুর বড় বড় টিন থেকে কেরোসিন ঢালছে।
দেখে চোখ জ্বালা ক’রে ওঠে ঋজুর। পূর্ববঙ্গে নীচু বর্ণ আর নীচু অর্থের মানুষ একটা অফুরন্ত অর্ধাহার-অনাহারের কুয়োর ভেতরে সার্কাস-খেলোয়াড়ের মতো গোল-গোল ঘুরে যাচ্ছে। অন্নাভাবে থাকে ব’লেই এদের মধ্যে নষ্ট খাবার খাওয়া আর পেটের রোগ বাধানোর হিড়িক। সাধে কি মেঝেয় পড়া পাতের ভাত খুঁটে না খেলে আমাদের মা লক্ষ্মী রুষ্ট হন!
সেই মুহূর্তে সমিতির এক যুবক তাকে রূপসাচর থেকে চলে যেতে বলছিল, অবিনাশকাকুর তেমনই নির্দেশ। ঋজু মাথা নাড়িয়ে ফিরে আসতে আসতে ওয়্যারহাউজের ভাঙা দেয়ালের পেছনে লুকোলো। সঙ্গীরা এগিয়ে গেছে বালিতে উলটে থাকা একটা বাতিল কন্টেনারের দিকে। তারপর হঠাৎ ওই লোহার খাঁচার পেট থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি পাথর ছুঁড়তে লাগল পুলিশগুলোকে। তাদের ‘বন্দে মাতরম’ স্লোগান উৎকট বাতাসে ভাঙা ভাঙা রামধনুর মতো এদিক-সেদিক ছিটকে যাচ্ছিল। ঋজু একলাফে বেরিয়ে এসে বন্ধুদের সঙ্গে খোয়া ছোঁড়ায় হাত লাগিয়েছে। পুলিশ তখন ধন্দে — চালের বস্তায় আগুন লাগাবে না ধাওয়া দেবে কংগ্রেসিদের? আসলে ওটা ছকবাজি, সেই ফাঁকে যে ক’জন স্টিমার-প্যাসেঞ্জার এত সময় ঋজুদের পেছনে বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল, হুড়মুড়িয়ে ধেয়ে আসছে। পালা, শিগগির পালা!
ছুটতে ছুটতে ছেলের দল চক্রাখালি পার হয়, গজালমারি ফুঁড়ে বেরিয়ে যায় একবারও পেছনে না তাকিয়ে। পেটমোটা গোয়েন্দা পুলিশের ঝাঁক কোথায় হারিয়ে গেছে… তারপরেও ঋজুরা দৌড়োতে থাকে — ডোবায় হাত-জাল ছোঁড়া জেলের গা ঘেঁষে, সদরমুখো সবজিবোঝাই ভ্যানরিকশাকে হারিয়ে… যেন এক গুচ্ছ অ্যাথলিট অলিম্পিকের প্র্যাকটিসে নেমেছে। ঋজু যত হাঁপায় তত হালকা হয় মাথা — অবিনাশবাবুর ওকে ব্রজরাজ কলেজে ভর্তি করানো, বিশেষ বিশেষ বই পড়তে দেওয়া, ইংরেজদের অত্যাচারের গল্প শুনিয়ে সেটা ইংরাজিতে রিপোর্টের ঢংয়ে লিখতে বলা… সবই কোনও ভারি রাগের শুরুতে স্বরপরিচয়ের মতো না? ভাবতে গিয়ে আর একখানা মুখ মনে আসে — নাকের দুপাশে তীক্ষ্ণ পেনসিলে আঁকা গাঢ় লাফ লাইন, অথচ দুঠোঁটের আংটায় ছোট্ট টিপতালা।
অবিনাশকাকু বলেছে, ইংরেজদের আসল উদ্দেশ্য জাপানিদের মারা নয়, দেশে দুর্ভিক্ষ ডেকে এনে বাংলা আর বাঙালির মাজা ভেঙে দেওয়া। এমন মন্বন্তরের ঋতুতেই প্রেম হল ঋজু-মল্লিকার?
.
(চলছে)
loading...
loading...
দ্বিতীয় পর্ব পাঠেও মুগ্ধ হলাম প্রিয় কবি চন্দন ভট্টাচার্য দা।
loading...