জিততে গেলে হেরে যাব

এক
— ও মা, আজকে আমাদের গল্পটা করো না!
— এখন হাত আট্‌কা। অপ্‌সার হই, দুফোরব্যালা খায়ে উঠে করবানে।

মা-দিদিমা একটা নতুন ঠাকুরমার ঝুলি বুনেছে ঠোঁট দিয়ে, সে নিয়তিবৃক্ষের ডালে দোল খায়। ভেতরটা ভাঙা বাসার রূপকথায় ভর্তি; কিন্তু যে-জীবনে প্রাণে বাঁচাটাই হুররে, খেতে পাওয়াই ভি-সাইন, সেখানে দু’চারটে তছনছ-কে কপালে হাতের ঘা মেরে ভুলে যাওয়াই মঙ্গল।

— আমাদের বাড়ি ধরো এক বিঘে জমির ওপরে একতলা, তাতে চারটে ছাদওলা পাকা ঘর, লাল শানমেঝে। পেছনে পুকুর, বারদুয়োরে বেল আর জগ্‌ডুমুর গাছ। ডেয়োঁ পিঁপড়ে বেল খেয়ে যায়। ভিটের বাঁদিকে সেনগুপ্ত বাড়ি; সাবিত্রী, মালতী, মল্লিকা, রেবা, শিপ্রা এই রকম আটটা মেয়ে তাদের। এক মেয়ের বিয়ে দিতে দিতে আর এক মেয়ের বিয়ের বয়েস পার হয়, তার ওপর মল্লিকা শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার তিন মাসের মাথায় সিঁদুর মুছে ফেরত এল।

মা ছোট্ট কাশি দিয়ে প্রসঙ্গ পালটায় : — বাড়িতে নাটমন্দির আছে, দোল-দুর্গোৎসব হয়, কালীপুজো মানে শ্যামাকালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী, ব্রত, ষষ্ঠী, সত্যনারায়ণ ইস্তক। তোমার বাবাই করেন; উনি দক্ষিণের আবাদে গেলে তখন জ্যাঠামশাই।

— পুজো হয় বলছ কেন, বলো আগে হতো।
— একই কথা। মোটে দশ-এগারো বছর বন্ধ, ফিরে গেলে আবার সব ধুমধাম ক’রে চালু হবে, বাড়ি বিনিময় ক’রে তো আসিনি তোমার কাকাপিসির মতো।

— হ্যাঁ যাও, তোমারে বাড়ি খাওয়ায় দেবেনে। অনামী পপাটি ঘোষণা ক’রে সরকার সেখেনে কবে জাতভাইগো বসায় দেছে।
ননীবালা মেয়েকে স্বপ্নের চিড়িয়াখানা থেকে বের ক’রে আনতে চায়। মায়া ছেলেমেয়ে নিয়ে ইন্ডিয়ায় চলে আসার পর ফাঁকা বাড়িতে নিজের নিঃশ্বাসের শব্দে নিজেরই ভয় লাগত নির্মলের। যাতে গোপালসেবাটুকু বন্ধ না হয়, শ্রীফলতলা গ্রামের কিঙ্কর চক্রবর্তীকে সপরিবারে বাড়িতে রেখে টিনের স্যুটকেসে খানকয়েক বই নিয়ে সে বেনাপোল সীমান্ত অতিক্রম করে। বছর দুই পরে কিঙ্করকে দ্যাখা গেল বসিরহাটে, অগ্রদানী বামুন এ-বঙ্গে এসে মাছের ব্যবসায় লেগে গেছে।

এমনভাবে কত-যে পরিবার ছিঁড়েছুটে গেল; শিক্ষিত লোকেরা তবু চিঠিপত্র লিখে আত্মীয়দের একত্র করার উপায় খুঁজত, নিরক্ষর মানুষের আপনার জন ফিরে পেতে দশ-বিশ বছর পার।
— বাগেরহাটে-বাড়ি তোদের এক পিসির (আপন পিসি না) বিয়ে হয়েছিল মোল্লারহাট। মুসলমান এলাকা, দেশ স্বাধীন হতে না হতে তারা হিন্দুবাড়ি থেকে মেয়ে তুলে আনতে লাগল। একদিন দুদিন রাখে, তারপর ফেরত দিয়ে যায়। জবা তখন নতুন বউ, তার শ্বশুরবাড়ির সবাই — কাউকে কোনও খবর না — রাতারাতি পালিয়ে হিন্দুস্তানে চলে এল। তারও এক যুগ পরে তোদের বাবা অগ্রদ্বীপের মেলায় গেছে, হঠাৎ এক মেয়েছেলে এসে, বলা নেই কওয়া নেই, হাত ধ’রে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে! বউটার দশ-এগারোর বাচ্চা মেয়ে দেখেশুনে খুবই বিরক্ত; বাবাকে এসে বলছে, তুমি মাকে আর মেলায় এনো না। ততক্ষণে বাবা-মা সেই অপরিচিতের পায়ে ঢিপঢিপ প্রণাম।

অবশেষে নির্মল জবাকে সঙ্গে ক’রে এল বারাসাতে, খুড়তুতো ভাইয়ের কাছে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বৈদ্যনাথের সে-হাপুস কান্না যদি দেখতে!

চাঁদ হঠাৎ বলে, বদ্যিনাথকাকু তখন খালি গায়ে একটা নীল রঙের লুঙি প’রে ছিল না? আর জবাদিদি ঘোমটা দিয়ে ছিল?
— তুই কী ক’রে জানবি? তোর তো জন্মই হয়নি!
— আমি সব দেখতে পাই। সেদিন বর্ষাকাল, রাস্তায় কাদা ছিল, বাবা একবার পিছল খেয়ে পড়ে গেছিল বারাসাত স্টেশানে।
— পাগলের ছাতা! দোল পূর্ণিমার পরের কৃষ্ণা একাদশীতে গোপীনাথের মেলা, তখন বৃষ্টি কোথায়?
— হইছিল, তোমার মনে নেই।

বাসুর কিন্তু দাঙ্গার স্মৃতি ফটফটে পরিষ্কার।
— মা, তোমার খেয়াল আছে, একবার সন্ধেবেলা ভৈরবের ওপারে হিন্দুপাড়ায় বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছিল মুসলমানেরা, আকাশ পুরো লাল, তারপর নদী পার হয়ে সেনহাটিতে এসে পড়ল মশাল হাতে পঁচিশ-তিরিশ জন লোক, আমরা একটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পালাচ্ছিলাম, শিউলি তোমার কোলে, এক মিঞাভাইয়ের বাড়ি গিয়ে লুকিয়ে থাকলাম সারা রাত। ওরা কী যেন খেতে দিয়েছিল?

সঞ্জুর অতীতও জাগ্রত হয় তখন।
মুসলমানরা তারপর আক্রমণ করল আমাদের। মিঞাভাইয়ের দুই ছেলে সারা রাত বন্দুকের গুলি ছুঁড়তে লাগল।

মায়া হেসে ফ্যালে :
— এত কিছু হয়নি। তোর বাবা গেছিল যশোরে, ন’-মামার বাড়ি। সন্ধেবেলা আমি রান্নাঘরে, হঠাৎ মনোজ ঘটকের ছেলে এসে বলে, বৌদি খবর পালাম আজ হিন্দুপাড়া লুঠ করবে ওরা। রায়েট বেধে যেতে পারে। এই গোনে বাচ্চাদের নিয়ে লালু মিঞার বাড়ি যেয়ে ওঠো। লালু আড়তদার, খুলনা ব্যবসায়ী ইউনিয়ানের কী বলে… সহ-সভাপতি। কড়াইতে যেমন তরকারি তেমনি প’ড়ে থাকল, বাড়ি হাট ক’রে খোলা, যেয়ে দেখি আমাদের মতো প্রায় একশোজন, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বসে আছে। লালুর ছেলে ব’লে গেল আপনারা নিশ্চিন্তে থাকেন, তামার টাটে গুড় আর বস্তায় চিঁড়ে রেখে গেলাম। জল দিলি তো ছোঁবেন না, ঘরের পেছনে টিউকল, হাত-কোশ ক’রে খেয়ে আসবেন।

— তারপর কী হল?
— আর কী হবে! সিদ্ধান্তপাড়ার লোকজন সজাগ হয়ে গেছে বুঝে মোল্লারা আর এগোল না। আমরাও সারা রাত্তির না ঘুমিয়ে সকালবেলা বাড়ি ফিরে রান্নাবান্না আদাড়ে ফেলে আসলাম।

চাঁদ বলল, উঁহু মুড়িচিঁড়ে খেতে দেয়নি। দিয়েছিল … সে ঠোঁট সুঁচোলো ক’রে ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে … চা আর সন্দেশ।
— হ্যাঁ, তুই অন্তরীক্ষ থেকে দেখেছিলি তো!

সে যাই হোক, মায়ের বোনা ঠাকুরমার ঝুলি বড্ড সাদা-সাদা। বরং মনিদার কাহিনিতে একদিকে নদীর আকাশ ন্যাড়াপোড়ার রাতের মতো আগুনের স্ফুলিঙ্গ ওগরাচ্ছে, আর একদিকে অনেক বাচ্চা বালক ধ্রুব-র আদলে ‘হা-কৃষ্ণ হা-কৃষ্ণ’ ক’রে ছুটছে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে।

ছুটতে ছুটতে তারা কলোনির পঞ্চু, ছোটবাবু, বাবলা, খোকোন, কানু হয়ে গেল।
— এ চাঁদ, মাঠে যাবি না?
— মা, এখন আর আমাদের গল্প করবে না কিন্তু। আমি খেলে আসি, তারপর।

.
(শুরু হল)

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
জিততে গেলে হেরে যাব, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২০-০৪-২০২৩ | ১৪:০১ |

    আর একটি জীবন গল্পের প্রথম পাঠে স্বাক্ষী হয়ে থাকলাম প্রিয় কবি চন্দন দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
  2. নিতাই বাবু : ২০-০৪-২০২৩ | ২১:৫৬ |

    গল্পখানা অত্যন্ত পরিচিত! গল্প পড়ে আমার চোখের সামনে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সব স্মৃতি ভেসে উঠলো। এমন আরও জানতে চাই, পড়তে চাই। 

    GD Star Rating
    loading...