আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

একুশ
ওঁ আদিত্যাদি গ্রহাঃসর্ব্বে নক্ষত্রাণি রাশয়ঃ।
দীর্ঘমায়ুঃ প্রকুর্বন্তু যস্যেয়ং জন্মপত্রিকা।।

ফালি কাগজের মাথায় চটপট শ্লোকটা লিখে নির্মল স্কেল দিয়ে কালিদাগ টানল। তার নীচে ধীর হস্তাক্ষরে একটা ক’রে বসাতে লাগল শব্দ :

শুভমস্তু শকনরগতে রতীতাব্দাদয়ঃ ১৮৮২ সন ১৩৬৭ ইং ১৯৬০ এতচ্ছকীয় সৌর শ্রাবণস্য সপ্তম দিবসে ইং জুলাই মাসস্য চতুর্বিশতি দিবসাৎ পরং রাত্রৌ সার্দ্ধেক ঘটিকায়াং ঘঃ ১-৩০ মিনিট সময়ে সেনহাটী গ্রাম নিবাসিনঃ শ্রীনির্ম্মলচন্দ্র দেবশর্ম্মণো কাব্যতীর্থোপাধিকস্য শুভ কুমারোহ জায়ত ভারতে…।

এবার ঠোঁটের ওপর বাঁহাতের তেলোর উল্টোপিঠ রেখে ভাবতে লাগল সে। ভারতে কোথায় ভূমিষ্ঠ, উদ্বাস্তু শিবিরে! সেটা কি প্রাণে ধ’রে লেখা যায় — সূতকমুহূর্তে ছিন্নমূল? নির্মলের কলম আবার চলতে লাগে, “…জায়ত ভারতে তস্য মাতামহীগৃহে। তস্যেয়ং লিখ্যতে সংবৃত্তিপত্রিকা”।

মায়া অনেকবার বিরক্ত হয়েছে : চাঁদের কুষ্টিটা বানাচ্ছেন না কেন? এত রোগবালাই লেগে থাকে ছেলেটার! হ্যাঁ, জ্যোতিষশাস্ত্রও বলে, “জন্মপত্রিকা যিনি প্রস্তুত করান নাই তাহার নিকট জীবন নিশাকালীন দীপবিহীন মন্দিরের ন্যায়”। তাছাড়া এসব দু’ঘন্টার মামলা, নিজের পরিবার বাদেও আত্মীয়-প্রতিবেশী এত লোকের জাতপত্র নির্মলের হাতে গড়া, ছকটা কষে ফেললে আর কী করার থাকে, পঞ্জিকা দেখে দেখে বসিয়ে যাও মাসফল, ঋতুফল, হোরাফল, নক্ষত্রফলম্‌…।

স্কেলে আরও একটা দাগ কেটে তার নীচে সে লিখতে লাগল, রাত্রি ঘন্টা ৯/৪৫ গতে মীনরাশি, বিপ্রবর্ণ, নরগণ, অষ্টোত্তরী শুক্রের ও বিংশোত্তরী শনৈশ্চর দশায়াং…।

মীনের অন্য নাম অস্ত্যভ। এটি সৌম্য ও জলজ রাশি। মীনের শেষার্ধ কীট নামে খ্যাত। তার দিবা ও রাত্রিতে সমান বল (অন্য রাশিরা দিবাভাগে বলী)। মীনের বর্ণবিবেক মলিন। এই রাশি অনুযায়ী জাতকের নাম চ বা দ অক্ষরে শুরু হবে। নির্মল লিখছে : প্রকাশ্য নাম শ্রীমান্‌ চন্দন কুমার দেবশর্ম্মা ভট্টাচার্য্য। রাশিনাম… একেবারে গোপনীয় হতে হবে… শ্রীমান্‌ দিগন্ত।

এবার সমান্তরাল দুটো রেখা টেনে খানিক দূরত্ব রেখে এঁকে ফেলল জন্মনকশা, তারপর বারো অর্ধে গ্রহের অবস্থান সাজাতে সাজাতে ভুরু কুঁচকে উঠল তার। মুখ দিয়ে দুবার অসহিষ্ণু শব্দ করল, মশারি থেকে নেমে যতদূর সম্ভব নিঃশব্দে খাটের নীচে রাখা টিনের সুটকেস খুলে নামাল বাঁধানো খাতা আর তিনটে জুস-আলগা মলাটছেঁড়া বই।

এবার প্রতিটা পর্যবেক্ষণ সে কোষ্ঠীতে তুলবে গুনেগেঁথে, শাস্ত্র মিলিয়ে। প্রথমে সংস্কৃতে লিখে নীচে তার বাংলা, কিন্তু ডাক্তারের লেখা প্রেসক্রিপশান আর রোগিকে বলা সংলাপে যেমন সময়-সময় মিল থাকে না, নির্মলও অনুবাদ করছিল শুধু বাছাই অংশের। লগ্নফলে “পীন ললাট ঘোণ গণ্ডৌষ্ঠ” বা “শূরঃ ক্লেশসহিষ্ণু সুখী রিপুহন্তা” পর্যন্ত সুন্দর চলছে, কিন্তু হোরারত্নে “পরদারকঃ” শব্দে এসে তার মুখ লাল। পরের বিশেষণ “তেজস্বী”, সন্ধি ক’রে লিখল “পরদারকস্তেজস্বী এষু”। বাংলায় ভাঙলই না কথাটা।

এভাবে কত ধামাচাপা দেওয়া যায়? দ্রেক্‌কাণফল, শুক্রের দ্বাদশাংশফল একের পর এক লজ্জাজনক মার্কশীট খুলে ধরছে সামনে; প্রত্যেক সাবজেক্টেই লাল কালির দাগ — দাম্ভিক, রতিবশ্য, লোভী, স্ত্রীপ্রিয়, বিলাসী, পানভোজনপটু, কুটিল, কলহমত্ত, চপল, কৃতঘ্ন, ক্রোধী, স্থূলতনুসম্পন্ন!

বিছানায় তার দুহাত দূরে নিরপরাধ ঘুম দিচ্ছে সেই চরিত্রহীন মুজরিম — চোখের পলক এত টানা, কর্ণকুহর ছুঁয়ে দেবে যেন। আর মন? বিজয়া দশমীর দিন চুপিচুপি এসে বাবাকে বলেছিল, রাত্তিরে মা দুর্গা স্বপ্ন দেখিয়েছে : আমাকে তোরা ভাসান দিস না, জলে সব মাটি ধুয়ে হাড়ে ঠান্ডা লেগে জ্বর আসে, আমি ঠাকুর থেকে ভূত হয়ে যাই। বরং প্যান্ডেলের পাশে একটা বাড়ি বানিয়ে আমাদের রেখে দে। আশীর্বাদ করে দেব, সবাই পরীক্ষায় পাশ। কাজেই, “আপনি আজাদ হিন্দ কেলাবে যেয়ে একবার ব’লে দেন — বিসজ্জোন হবে না, দুগ্‌গাঠাকুরের ইচ্ছে নেই”!

ছেলের অজাগর মুখ থেকে নির্মল আবার চোখ ফেরাল গণনায়, ত্রিশাংশ ফলের দিকে :
ধাতুবাদী ক্রিয়াযুক্তঃ ধন-দার বিবর্জিতঃ। তস্করো মলিনো ধূর্ত্ত ভৌমত্রিশাংশসম্ভবঃ।।

তার ফলিত জ্ঞান ভেঙে পড়ছিল, বুকের ধকাস-ধকাস নিশ্চয়ই স্কুলের দেয়ালঘড়ির চেয়েও জোরে। গণনার এই ক্ষমাহীন ধ্রুপদী ভাষা আসলে কোনও ভয়ানক পরিণতির ইশারা — সন্তান আঁতুড়ে থাকতেই ঠিকুজী বানাতে গিয়ে নির্মল জাতকের যে দগ্ধভাগ্য দেখে হাত গুটিয়ে নিয়েছিল।

চন্দ্র মনের কারক। কেউ তার বৈরী নয় — চন্দ্রমসো চন্দ্রস্য ন কশ্চিৎ শত্রু ইতি ভবঃ। মানুষের শরীরে বিন্দুচক্রে শশাঙ্কের অবস্থান, সে নতুন অথচ সুদৃশ্য বস্ত্রের অধিপতি। কিন্তু চন্দ্র হীনবল ও নীচস্থ হলে মানব দোলাচলচিত্ত হয়। যদি শনি দ্বারা যুক্ত বা পূর্ণদৃষ্ট হয় তবে সর্বদা চিন্তাযুক্ত, অল্প দুঃখে অধিক ম্রিয়মান, সন্দেহস্বভাবী ও ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ডুবে থাকবে; আর শুক্রের সঙ্গে মিলিত হলে বা শুক্র দ্বারা পূর্ণদৃষ্ট হলে জাতক সারাক্ষণ কামাদি চিন্তায় রত। চন্দ্র দুর্বল ও শনিদ্বারা পীড়িত হলে মানব আক্রান্ত হবে উন্মাদ রোগে।

নামটা রেখেছিল শিউলি। বাসে যেতে যেতে মহিলা-গলায় “চাঁদ, শিগগিরি নেমে এসো” ডাকের সঙ্গে এক মিষ্টিমুখ বালকের ঝনাৎ ক’রে লাফ দিয়ে অবতরণ দেখা মেয়ে বাড়ি ফিরে সবার আগে পৌঁছোয় উদরিণী মায়ের কাছে — “যদি ভাই হয়, আমি কিন্তু নাম রাখব চাঁদ”। এভাবে সন্তান হাজির হওয়ার আগেই তার ডাকনাম উপস্থিত হয়ে অপেক্ষারত, যেন মালিককে গর্ভযান থেকে এক-লাফে নেমে আসার অনুরোধ পাঠাচ্ছে। শিউলি যদি তখন জানত, চাঁদই হবে চাঁদের অপৌরুষ; তার পরিপন্থী, তার অসমীচীনতা, তার বিপর্যয়…!

বৈদ্যকুলতিলক প্রজাপতি দাস বলে গেছেন, “শিশু ভূমিষ্ঠ হলে যোগজ শিশুরিষ্টি বা পতাকী শিশুরিষ্টি আছে কিনা তা সবার আগে নিরূপণ করে পশ্চাৎ ভাগ্য ফলাফল বিচার করবে। যেহেতু প্রবল রিষ্টি থাকলে শিশুগণ প্রায়ই মানবলীলা সংবরণ করে থাকে”। সেদিকে যাওয়ার আগে… ক্ষীণ চন্দ্রের ওপর বুধের প্রভাবটা কোথায় লিখেছে, ভয়চকিত নির্মল ‘জাতক পারিজাত’ হাতড়াতে থাকে… হা ঈশ্বর :

“বুধ ক্ষীণ চন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হলে পাপ সংজ্ঞায় অভিহিত হয়েন। পঞ্চ-ত্রিংশ বর্ষ পরমায়ু”।

বাইশ
“ঘুমোবেন না? বারোটা তো বাজে… ও কী, মুখ ওর’ম কেন! খারাপ কিছু দেখিছেন চাঁদের কুষ্টিতি?”

হারিকেনের কাচের একদিকে কাগজ আঁটা, ঘুমন্ত বাচ্চাদের চোখে আলো না পড়ে। মায়া পাশের ঘর থেকে ওই প্রচ্ছায়ার ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছে ব’লে তাকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু সে বরের মুখ পড়তে পারছে স্পষ্ট।
অবস্থা সামাল দিতে মিথ্যে যুগিয়েও গেল নির্মলের মুখে:
— ভাবছিলাম, কাজল কেন যে এমন একটা কীর্তি ক’রে গেল!
— সেসব আমি ভুলে গেছি। আপনি সুন্দর ক’রে বুঝিয়ে বললেন যে।

বরাহাচার্য্যের সূত্র মেনে সে দ্রুত হাতে নতুন কুণ্ডলী গড়ছিল পতাকীরিষ্টির। পুব-পশ্চিমে লম্বা পতাকালাগানো তিনটে লাইন টেনে তার ওপর উত্তর-দক্ষিণে আরও তিন লাইন বিন্যাস করলে কুণ্ডলী দ্বাদশ ভাগে বিভক্ত হল। নিয়ম মেনে দুই-দুই রাশির মধ্যে তির্যক রেখা এঁকে তাদের বেধ বা যোগ নির্ণয় করল নির্মল। তৈরি হল পতাকী-চক্র। চাঁদের জন্মছকে গ্রহেরা যে-যে রাশিতে আছে, তাদের পতাকীচক্রের ঠিক ওই জায়গায় বসাল। এবার বেধ অনুযায়ী শুভাশুভ ফল-বিচারটা শুধু বাকি।

— জানেন, বাসু বলছিল কাজল-কৃষ্ণেন্দু এখান থেকে বাড়ি যায়নি, স্টেশানে গিয়ে উল্টোদিকের ট্রেন ধরেছে। তার মানে ছোট্‌ঠাকুরপো-র কাছে যাচ্ছে, নিমতায়। আমাদের এখানেও তো এসেছিল চারঘাট-এ নারায়ণদার বাড়ি থেকে। পোয়াতি মেয়ে এইভাবে নিজের ভিটে ছেড়ে অন্যের বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে দুটো পেটের ভাতের জন্যে!

ঠিকুজী থেকে জন্মের দণ্ডকাল ১৭।৫৪।১৪ তুলে বিড়বিড় করতে করতে নির্মল দণ্ডাধিপতি কষতে বসল এবার। দেখল, সম্ভাবনার মধ্যে সবচেয়ে মন্দটাই ঘটে ব’সে আছে। অশুভ দণ্ডাধিপতি গ্রহের সঙ্গে লগ্নের যোগ, এমনকি চারটেই পাপগ্রহ বেধচতুষ্টয়ে। সমস্ত ফাঁড়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় রাক্ষস এই ‘নিয়ত পতাকীরিষ্টি’। গণ্ডযোগ নয় যে নবগ্রহের পুজো দিলে পরিত্রাণ আছে, রাহু-ফাঁড়া কেতু-ফাঁড়া নয় যে পাথর পরাবে। মীন রাশির পতাকীরিষ্টিকাল (নির্মল পরাশর-সংহিতা ঘাঁটছে)… মানে জাতকের সর্বোচ্চ আয়ু… হ্যাঁ পঁয়ত্রিশও না, উনত্রিশ বছর!

চাঁদের মা তখনও বলে যাচ্ছে, “আপনার বুনঝি গোপার কানের দুলজোড়া নেয়ায় পেত্থোমে আমার খুব রাগ হইছিল। পরে চিন্তা কল্লাম, ঠাকুরির ইচ্ছেয় কাজ্‌লার মেয়ে হোক, মুখদ্যাখানি সোনা তো কিনতিই হতো মামা-মামির, নয় আগাম দিয়ে রাখলাম”।

যেন দুই নেশাড়ুর দুটো সমান্তরাল গল্প একে অন্যের কাছে। তবু মায়ার গলা থেকে কোনওভাবে কি ‘কানের দুল’ খুলে কানে গিয়েছিল নির্মলের? ভিজিয়ে রাখা চা-পাতার মতো অপেক্ষায় ছিল তার স্মৃতি : “দিয়ে তোমার রতনমণি আমায় করলে ধনী”… আর তারপর মনে পড়েছে, “আমায় তুমি করবে দাতা, আপনি ভিক্ষু হবে”। আর্তের মতো উৎকন্ঠায় সে মায়াকে জিগ্যেস করল, তুমি কাল একটু রবি ঠাকুরের গান শোনাবে আমাকে?

.
(আরও আছে)

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২১-০৩-২০২৩ | ১৮:৪৫ |

    বরাবরের মতো মুগ্ধপাঠ প্রিয় কবি। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...