কুড়ি
রাইটার্স বিল্ডিংয়ে হইচই, আলোড়ন, তোলপাড়। একে তো সরকারি অস্ত্র খোয়া গেল, তারপর বাঘের হাতে বন্দুক, সে গুলিও চালাচ্ছে। রোবটরা যদি রাইফেলের জোরে একটা বিদ্রোহমতো ক’রে গোসাবা বা কুলতলির দখল নিয়ে বসে? যুদ্ধের বাজারে তখন এক্সট্রা গৃহযুদ্ধের চাপ; জিনিসটায় রাজনৈতিক রঙও লেগে যাবে, পশ্চিমবঙ্গে বাঘ-পতাকাওলা পার্টি আছে না!
মিটিংয়ের আহবায়ক বন দপ্তরের প্রধান সাত্যকি জোয়ারদার সাহিত্যিক মানুষ; বললেন, আমরা যদি গঠনমূলক দিক থেকে দেখি — বাঘের হাতে রাইফেল মানে জঙ্গল চোরাশিকারি-মুক্ত। তার এই চূড়ান্ত এগিয়ে থাকা অরণ্য-বাঁচাও ফর্মুলা বিক্কিরি হল না। দু’বছর এলএলবি প’ড়ে ছেড়ে দেওয়া ডেপুটি সেক্রেটারি (গৃহ) বিদ্যে ফলালেন, স্যার বাঘ গুলি ছুঁড়ছে কোর্টে প্রমাণ করবেন কী ক’রে? কার্তুজের খোল তো উদ্ধার করা যায়নি! ডিআইজি সাহেবের প্রথম থেকেই আলোচনায় ইন্টারেস্ট নেই। তিনি কাছাকাছির মধ্যে নদী ও জলসেচ দপ্তরের সচিবের কান পেয়ে সেখানেই ফিসফিসোলেন : পেটের ভেতর যেমন গ্যাস আর অ্যান্টাসিড নিজেরা নিজেরা মারামারি করে, আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমোই; তেমনি এখন জন্তু-জানোয়ারে যুদ্ধ চলুক; পুলিশের নাক গলানোর কী আছে! পর্যটন দপ্তরের এক বাচ্চা বিসিএস অফিসার মহা উত্তেজিত — বাঘের একটা রাইফেল-হাতে ছবি পাওয়া যায় না?
— দূর বাবা, ঘটনার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না! শিউলি বলল। মাথা ঝাঁকাল চাঁদ।
— বড় বড় মাতব্বরই ঠাওর করতে পারছে না, তার তোরা! এট্টু সবুর কর। কাকিমা কোথায়?
কাকিমা বারাসাতে গেছে, দিদিমা পাড়ায় শুনে টিপুদা একটা বিড়ি ধরাল।
আমলাদের দৌড় বুঝে নিয়ে বনমন্ত্রী শশধর চ্যাটার্জি গলা চড়িয়েছেন : ধূলিভাসানি বিটের ফরেস্ট অফিসারকে ডাকা হয়নি? সে কোথায়? রঞ্জিত সমাদ্দার উঠে দাঁড়াতেই — কী ব্যাপার, রাইফেলটা বাঘের হাতে তুলে দিয়ে নাকে তেল লাগিয়ে ঘুমোচ্ছেন?
স্যার, আমার একটা শান্তি-পরিকল্পনা আছে। আমরা বাঘদের কাছে আবেদন রাখতে পারি ওয়েপন ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যে।
সরি টু সে, সবাই গাঁজা খেয়ে আসেননি তো মিটিংয়ে!
স্যার, রোবট আমাদের ঘোষণা না বুঝলেও নন্দরাক্ষস বুঝবে।
হু ইজ নন্দ? পোষা বাঘ নাকি আপনাদের? কুনকে হাতির মতো জঙ্গলে ছেড়ে রেখেছেন?
সব শুনে চাটুজ্জেবাবুর মুখ উজ্জ্বল হল। রূপান্তরিত শিলা পড়েছিলাম ক্লাস এইটের ভূগোলে, তারপর এই রূপান্তরিত বেড়াল! বেশ লেগে পড়ুন, আমার বেস্ট অফ লাক থাকল।
সারাদিন ধরে মাইকিং হচ্ছে কৈকলমারি-শুইয়া-ধূলিভাসানি বিটের নদীবক্ষে এবং বন-ঘেরা রাস্তায় : মাননীয় বাঘগণ ও বিশেষভাবে প্রিয় নন্দ, আপোনাদের চুরি করা, সরি ছিনতাই করা রাইফেলের অভাবে বন দপ্তরের ডে-টু-ডে কাজ খুবই হ্যাম্পার হচ্ছে। তাছাড়া প্রশিক্ষণ নেই ব’লে আপোনাদের হাতের টিপ খুবই খারাপ। একটা বাঁদর-সাইজের ঈগল পর্যন্ত মারতে পারলেন না। তাই বেশি ফুটুনি না ক’রে, সরি, জটিলতা বৃদ্ধি না ক’রে রাইফেল জমা দিয়ে দায়িত্বশীল নাগরিকের পরিচয় প্রদান করুন। শুইয়া নদীর খাঁড়িকে হাতিয়ার সমর্পণের ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে, সময় আগামি কাল সকাল দশ ঘটিকা। সরকার কথা দিচ্ছে, চার হাতপায়ে চালানো বন্দুক আবিষ্কার হলে সবার আগে এই জঙ্গলেই সাপ্লাই দেওয়া হবে।
মাঝ-মাতলায় দাঁড়িয়ে থাকা লঞ্চে ঠাসাঠাসি গ্রামের কিছু মাতব্বর, পুলিশ, রেসকিউ টিম, ব্যান্ডপার্টি আর ‘সুন্দরবন বার্তা’ পত্রিকার একই দেহে মালিক-সম্পাদক-সাংবাদিক-ক্যামেরাম্যান বিকাশ সাঁপুই। বাঘের হাতে ঘড়ি নেই ব’লে দশটা বাজতে পাঁচ থেকে ব্যান্ডপার্টির কনসার্ট চালু : “কর চলে হম ফিদা জান-ও-তন সাথিয়োঁ”… কিন্তু কোনও সাড়া নেই। তারপর “অ্যায় বতন অ্যায় বতন হমকো তেরী কসম” সুর ওঠা মাত্র নদীর পাড়ে কালোহলুদ মাথাও ফুটে উঠতে লাগল। বাজিয়েরা ভয়ে থেমে গেছে, সমাদ্দার চেঁচালেন : চালিয়ে যাও; তিনি খেয়াল করেছেন বাঘদল গানের তালে তালে পা ফেলে এগিয়ে আসছে —- ঝম্পু ঝম্পু ঝম ঝম, ঝম্পর ঝম্পর ঝম। মিছিলের নেতৃত্বে এক বাদামি বুনো শুয়োর, আরে না না, ও তো আচ্ছাসে বডি বানানো আমাদের নন্দরাক্ষস! পিঠে তার রাইফেল, মুখে কামড়ে আছে স্লিংয়ের কাপড়। শুইয়া খালের মুখে নৌকো বেঁধে রেখে এসেছিল ফরেস্ট গার্ডরা, তার গলুইতে রেশন দোকানের মুটে যেমন পিঠ ঝাঁকিয়ে চালের বস্তা ফ্যালে, তেমনি এক ঝটকায় রাইফেলটা নামিয়ে দিল নন্দ। তারপর লোহার গজালে বাঁধা কাছির ফাঁস দাঁত দিয়ে খোলার চেষ্টা করতে লাগল। পেছনে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে দুশো রোবট, সময় লাগছে দেখে একটা মুশকো বাঘ কামড়ে উপড়ে দিল লোহার খোঁটা। ওমনি ফরফর ক’রে ভাসতে ভাসতে নৌকো লঞ্চের গায়ের কাছে! এদিকে হাফ-সেঞ্চুরি মানুষ হাততালি দিচ্ছে, ওপাশ থেকে ডবল সেঞ্চুরি বাঘের একজোট গর্জন! সেই শব্দে লঞ্চ থেকে ক্যামেরাসুদ্ধু নদীতে পড়ে গেল বিকাশ সাঁপুই।
বাসু মুখে হাতচাপা দিয়েছে : আমি জানতাম লাস্টে ক্যামেরাম্যান জলে পড়ে যাবে।
— কেন রে মনিদা?
— যদি কেউ অস্ত্র জমা দেওয়ার ছবি দেখতে চায়!
টিপুদা বাসুর চোখদুটো পুনরাবিষ্কার করছিল। সেখানে বুদ্ধি, সতর্কতা আর আত্মবিশ্বাস দিয়ে সীমাহীন এক মোকাম থেকে দেয়াল-তোলা ঘরে স’রে যাওয়ার রাস্তা আঁকা হচ্ছে। ছেলেটা ভুলে যাচ্ছে কল্পনার মাটিতে আলপনা আরও সুন্দর ফোটে, স্বপ্নের টিকিট কাটলেই জীবনের ট্রেনে চাপা যায়। আসলে পাঠক জন্ম নেয় কাহিনির সামনে বুঁদ হয়ে বসে থাকবে ব’লে — প্রতিমাকে পুজো দেওয়া মানুষ যেন; আর সমালোচক পা টিপে-টিপে মূর্তির পেছনে গিয়ে দেখতে থাকে কাদা-মাখানো বিচালি, কাঠের শলাগুলো। ছোটরা নতুন জামার ভাঁজভাঙা গন্ধেই মাত; বড়রা রঙ বোতাম কিচ্ছু না, পরখ করে সেলাই কতটা অপলকা।
বাসুদেবও অসহায়ভাবে বড় হয়ে যাচ্ছে!
(আরও আছে)
loading...
loading...
সতত শুভকামনা প্রিয় কবি চন্দন ভট্টাচার্য দা। চলুক …
loading...