আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

সতেরো
নারকোলগাছের গাব্‌ড়ো দিয়ে ব্যাট বানিয়ে ক্রিকেট চলছিল উঠোনে, হঠাৎ খেলা ভেঙে শুরু শিশুকিশোর নাচ। সঙ্গে গান এক লাইনের — আজ মাংসো খাবো। আআজ মাংসো খাবো। তখন নির্মল স্তব্ধ ও সুচিন্তিতভাবে বাজারের ব্যাগ তুলে দিচ্ছে মায়ার হাতে।

কলোনির কোনও ঘরে মাংস রান্না হলে আশপাশের বাড়িগুলোর চাল নাক আকাশে তুলে গন্ধ নেয়। পাড়ার বাতাসে যখন ভাসছে কৌতূহল আর বিষণ্ণতার মৌরিফুল, ভটচাজবাড়ির হেঁসেলের দরজায় ভিড় অধিকারসচেতন মানুষের।

সঞ্জু — মা, এবারে আমারে চারটে মাংস দেবা।
(বেড়াতে আসা ছোটছোট ভাগনেদের কথা ভুলে গেলি, মামা!)
শিউলি — আমি পায়ের হাড়টা চুষে চুষে খাবো। গতবার মনিদা পাইছে।
(গতবার = সাড়ে তিন মাস আগে দুর্গাপুজোর মহাষ্টমী।)
— মা, আমারে দুটো আলু দেবা কিন্তু৷
(অন্তত এক পিস মেটের দাবি তোলার জন্যে চাঁদকে উসকেছিল ননীবালা। কিন্তু রামকৃষ্ণ যতই বিবেকানন্দকে ভবতারিণীর কাছে টাকাপয়সা চাইতে পাঠাক, সে শুধু জ্ঞান-ভক্তি প্রার্থনা করেই ফিরে আসবে।)

আজ দুপুরের নায়ক পাঁঠার মাংস, আর নায়িকা চালের গুঁড়ো মাখিয়ে ভাজা কুমড়োর ফুল। বাচ্চারা খেতে বসেছে রান্নাঘরে, একটু ফাঁক রেখে দিদিমার আসন। দরজার বাইরে কিশমিশ চোখ বুজে কিন্তু মনশ্চক্ষু খুলে বসে আছে। আর হয়ত একুশ দিন, ঋতুট্রেনে ড্রাইভারের কেবিন থেকে শীত নেমে গিয়ে চেপে বসবে বসন্ত। এখন কিশোরের সদ্য গোঁফ ওঠার মতো আমের বোল গজাচ্ছে, রোদ বাবলু গিরির মতো লিকলিকে, রঘুনাথের মাঠে সাইকেলে সে এক পাক ঘুরে এলে একদলা ক’রে ভাত মুখে তুলে দিচ্ছে মা।

এদিকে মায়া যেই পেছন ফিরল, ননীবালা নিজের পাতের একখানি কুমড়োফুলভাজা ছুঁড়ে নিখুঁত অবতরণ করিয়েছে চাঁদের থালায়। ভাজায় অনাগ্রহী চাঁদ তক্ষুনি ফেরত পাঠাল পালটা থ্রো-তে, আর চেলে দিয়েই বুঝেছে — কেলেঙ্কারি ঘটালাম! ননীবালা স্মিত মুখে বাঁহাতে ঘটি উঁচু ক’রে গলায় জল ঢেলে খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়ছে।

— গাধা ছেলে, দিলি তো দিদিমার পাত ছুঁয়ে! সেই কাল দুফোরের আগে আর ভাত মুখি তোলবে না। তোমারেও মা বলিহারি, ছেলেটার স্বভাব খারাপ করেই ছাড়বা!
— ওরে, আমার খাওয়া হয়ে গিছিলো। তুমি শুদুশুদু চাঁদরে বকাবকি কোরে না, মনি।

আঠেরো
বাটিতে-বাটিতে মাংসের তেলভাসা নিফুটি ঝোলে বারোর এগারো ভাগ মাথা গুঁজে আছে দু’টুকরো ছোট মাংস আর এক পিস আলু।

শুধু একটা জামবাটি ছেলেমেয়েদের থেকে সরিয়ে রেখেছে মায়া। ওতে ‘বাবার মাংস’। নির্মল পাঁচ দানা অন্ন থালার বাঁ পাশে মাটিতে শ্রীবিষ্ণুকে উৎসর্গ ক’রে তার ওপর জল ছিটিয়ে ওই গণ্ডূষেরই অবশিষ্ট মুখে সুড়ুৎ করে টেনে নিয়ে ভাত ভাঙে। তারপর বাটির চার থেকে এক টুকরো মাংস পাতে তুলে নিলে “সবটুক খাতি হবে, নয়ত আমার মাথা খান” ব’লে জেদ ধ’রে উবু হয়ে বসে তার স্ত্রী। তখন সে দ্বিতীয় টুকরোটা নেয়। মায়ার দিব্যি কাটা থামছে না দেখে শেষ ভাতের দলা গিলে নিয়েই বলে “পেট ভ’রে গেছে”। আর কিছু করার নেই, নির্মল খেতে ব’সে কথা বলেছে মানে তার আহারে ইতি।

চার দিনের দিন ভোরেই মামা-মামিকে ঢপাঢপ প্রণাম ক’রে কাজল-কৃষ্ণেন্দু বিদায় নিয়েছিল। অবাক মায়া দোষী ঠাওরায় নির্মলকে। আপনাকে কতবার সাবধান করেছি, “তোমরা কি আজ থাকপা, না যাবা? থাকতি হলি থাকো, আর যদি যাতি চাও, রোদ থাকতি বেরোয় পড়ো সকাল সকাল” কথাটা অতিথি ভালো মনে নেয় না। জামাই নিশ্চয়ই কিছু মনে করেছিল…।

প্রায় তক্ষুনি বাসু চেঁচাল, জ্যামিতিবাক্স থেকে আমার পেনসিল আর রবার কে নিয়েছে? ক্রমশ দেখা যাবে শিউলির জরির কাজ করা ব্লাউজ, সিঁদুর কৌটোয় রাখা গোপার অন্নপ্রাশনে পাওয়া কানের দুল, পঞ্জিকার ভাঁজে নির্মলের চারমিনারের খরচ সাড়ে দশ টাকা — এমন বস্তুসমূহের হদিশ নেই। সবাই অনুসন্ধানে ডুবে আছে, রান্নাঘরে খ্যানখেনিয়ে বাসন পড়ার শব্দ হল। গোয়েন্দা কিশমিশ বেড়া বেয়ে উঠে শিকে থেকে বাটি ফেলে দিয়েছে। মেঝেয় গড়াচ্ছে সেই দু’টুকরো নির্মল মাংস।

উনিশ
— অপরাধ কে করে? যে মানসিকভাবে দুর্বল। তুমি কাজলদের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখতে চাইছ না। কিন্তু দুর্বলকে ত্যাগ করাও কি অপরাধ নয়?

— অপরাধীদের তো মেরেই ফেলা হল মহাভারতে। ভায়েরাই মারল ভায়েদের। কৃষ্ণ সমর্থন করলেন। আমি শুধু বাড়িতে আসতে দেব না বলেছি। আপনি সারাদিন গীতা প’ড়ে এখন উলটো কথা বলেন কেন?

— যা পড়ি তার সবটুকু মানি এমন তো নয়।

— না মানলে কৃষ্ণনাম উচ্চারণ করামাত্র চোখে জল ভ’রে যায়, গলা বুজে আসে?

— ভক্তি মানুষের সংস্কারে থাকে, খুঁজে বেড়াতে হয় না। কিন্তু স্পৃহা তার নিজের অর্জন। অভিলাষ থেকেই আসে জ্ঞান।

বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়লে বউ এসেছে তার পাশটিতে। আজকের ঘটনা আপন-পর সবার জন্যে ‌মন-কাঁদা মহিলার ভেতরটা থরথরিয়ে দিয়েছে। কথার শুশ্রূষা চাইছে সে। স্বভাবে দ্বিধাগ্রস্ত নির্মল কিছুক্ষণ চুপ ক’রে বিষয় আর কথনভঙ্গি হাতড়াতে থাকে। তারপর তার কিশোরপ্রতিম পাতলা গলা শোনা যায়।

— কুরুক্ষেত্রে অর্জুন তার ঠাকুরদা, জ্যাঠা-কাকা, শ্বশুর, মামা, ভাই, ছেলে, নাতি, শিক্ষক, বন্ধু — সবার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে ভেবে শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েন। রক্তের সম্পর্কের টান আর মানবতার শিক্ষা থেকে তিনি সমরে অংশ নিতে পারবেন না ব’লে শ্রীকৃষ্ণকে জানান। এখানে অর্জুনের মনোভাব দয়া, ক্ষমা আর স্যাক্রিফাইসের। তিনি প্রশ্ন তুলছেন, আমার পূজনীয়কে আমি মারব কীভাবে? বোঝা যায়, অর্জুন কৃষ্ণের তুলনায় অনেক আধুনিক মানুষ। গীতার শুরুতে যদুনাথ তাকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করতে দুটো লোভ দেখিয়েছেন, পৃথিবীতে রাজ্যভোগ আর মৃত্যুর পরে স্বর্গলাভ, কিন্তু কিরীটির লক্ষ্য জীবনে নৈতিকভাবে সুখী হওয়া। “স্বজনং হি কথং হত্বা সুখিনঃ স্যাম মাধব” — স্বজনদের বধ ক’রে আমি কীরূপে সুখী হব, মাধব? বলছেন, ভিক্ষে করে খাব, কিন্তু রক্তমাখা অর্থ ও কাম চাই না। তিনি সামাজিক নৈতিকতার বোধে সুরক্ষিত। উত্তরে কৃষ্ণ প্রচুর উপদেশ দিলেন, যার প্রথম দুটো — মানুষের মূল হচ্ছে আত্মা, সে অনশ্বর, এক শরীর ছেড়ে অন্যতে যায়। তাই প্রকৃত অর্থে কাউকে মারা যায় না, তুমিও মারছ না। দ্বিতীয়ত, নিষ্কাম কর্ম করলে পাপ স্পর্শ করবে না।

ব’লে নির্মল থামে।
— ঘুমোলে?
— শুনছি।
— বোঝা যাচ্ছে?
— দিব্যি সুন্দর।

— অর্জুনের জ্ঞান বাস্তব ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া। কিন্তু বাসুদেব যা বলছেন, সেটা দার্শনিক বিবেচনা যার কোনও বাস্তব প্রমাণ নেই। আমরা কেউই জানি না আত্মার ধারণা কতদূর সত্যি বা কামনাহীন কর্ম করলে তজ্জনিত পাপ ছোঁবে কিনা। এই স্তরের কল্পবিশ্বাস দিয়ে পার্থিক সংকটের মোকাবিলা করতে গেলে স্ববিরোধিতার জালে জড়িয়ে পড়তে হয়। শ্রীকৃষ্ণও পড়েছেন।

জীবনের নৈতিক সমস্যার সমাধান জীবনের বৃত্তেই খোঁজা উচিত। আয়ুর প্রাক-এ বা আয়ুর অন্তিমে কী আছে, আমরা অবগত নই, কিন্তু এটুকু টের পেয়েছি যে ব্যক্তির জন্মমৃত্যুর আগেপারে এই পৃথিবী ও তার প্রাণপ্রবাহ থেকে যায়। কাজেই মানুষের অভিজ্ঞতায় অনশ্বরতার সবচেয়ে কাছাকাছি জিনিস হল মানবসমাজ, আত্মা বা অন্য কিছু না। এই জীবনস্রোতকে বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র উপায় ক্ষমা আর ভালোবাসা।

— আমাকে গীতা পড়াবেন?

— তাহলে তুমি আমার মতোই ভাবতে থাকবে। গীতার বাংলা অনুবাদ কিনে আনব, নিজে প’ড়ো। আর জানো তো, স্কুলে পাঠ্যবইয়ের মানেবই মুখস্থ করতে নেই? গীতারও পণ্ডিতদের লেখা হাজারটা ব্যাখ্যা আছে, একটাও ছোঁবে না।

.
(আরও আছে)

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৭-০৩-২০২৩ | ১১:৪৬ |

    নিশ্চিত যে ধারাবাহিক এই গল্পটি মনোমুগ্ধকর এবং সুখপাঠ্য। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

    GD Star Rating
    loading...