পনেরো
— ক্রেস্টেড সারপেন্ট ঈগল সম্পর্কে কিছু জানা আছে?
— কেষ্টর শালা কি পাগল? না, বলতে পারব না।
— বাদ দে, বাংলাই ভালো। মোট একুশ জাতের কেশরওলা সাপখেকো ঈগল হয়। এদের মুন্ডুটা বড়, মাথায় পেছনে ব্যাকব্রাশ করা চুলের মতো একগোছা ঘন পালক আর চোখে কালো মণির চারপাশে হলুদ বর্ডার দেওয়া। এছাড়া বাদামি গলা আর পেটের পাখনা জুড়ে সাদা ছিটছিট দাগ থাকছে। এই জাতের ঈগল সাপ খেয়ে বাঁচে; তবে পাখি, মাছ বা ছোটখাটো জন্তু পেলেও ছাড়ে না। ঘন জঙ্গলের ভেতর জলের কাছাকাছি কোনও বয়ড়া গাছের মাথায় চুপ ক’রে ব’সে শিকারের দিকে নজর রাখা কাজ, আর বিপদের লক্ষণ দেখলে কানফাটানো ডাক ছাড়ে — ঈলুইই…কী-কী-কী-কীলুইইই।
টিপুদার দেখাদেখি বাসু ডাকল, চাঁদও চেষ্টা করল একবার। তারা পাঁচজন রঘুনাথের পাশের মাঠে বাতিল রেল লাইনের স্তূপের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। আঙুলে দোকানের চাবির রিং ঘোরাতে ঘোরাতে টিপুদা একটা দামি হাসি দিল : এই ক্রেস্টেড সারপেন্ট ঈগল বা সংক্ষেপে কসাই-এর বিরুদ্ধে স্টেপ না নিলে সুন্দরবনের অনেকগুলো বাঘ হয়ত প্রাণে বাঁচত না।
কসাইয়ের চোখ হল এক্স-রে মেশিনের ঠাকুরদা; মাতলা-র পশ্চিমে কৈকলমারি-ধূলিভাসানিতে উড়ে-চ’রে বেড়ায়, আর যেই দ্যাখে বাঘ গুঁড়ি মেরে কোনও হরিণ বা বুনো শুয়োরের দিকে এগোচ্ছে, ওর মার্কামারা চিল… সরি ঈগলচিৎকার পেড়ে পশুটাকে দেয় ভাগিয়ে। সারাদিন পেটে মাংসপানি পড়ে না বাঘের। জঙ্গলে যারা মধুর চাক ভাঙতে যায় তাদের অনেককেও কসাই এভাবে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
এমন একটা পরিস্থিতিতে নন্দরাক্ষস সুন্দরবনে এসে পড়ল। প্রথম কিছুদিন নন্দর লেগেছিল ও-যে সামান্য মেছোবেড়াল নয়, কনসেন্ট্রেটেড বাঘ — এটা সবাইকে বোঝাতে। তারপর দশটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা রোবট আচমকা চিল্লিয়ে কসাইকে ওপর থেকে ফেলে দিয়ে ঘেঁটি কামড়ে ধরবে কিম্বা রাতে সে ঘুমোলে চুপিচুপি চ’ড়ে যাবে গাছে — শার্দূলজাতির এসব ডিজাইন ব্যর্থ হওয়ার পরে নন্দ পেশ করল তার মাস্টার প্ল্যান, যে-গল্প আগেই করেছি।
শিউলি হাঁদার মতো জিগ্যেস করল, কোন প্ল্যান? বাসু ওর বিখ্যাত চিন্তামণি পোজে দু-আঙুলে নীচের ঠোঁট টেনে ধরল : নন্দরাক্ষসই তাহলে রোবট পাঠিয়েছিল লঞ্চ থেকে রাইফেল চুরি করতে? কসাইকে গুলি করবে ব’লে!
চাঁদের স্বপ্ন-স্বপ্ন মুখ আরও করুণ : পাখিটাকে মেরে ফেলছে? ও যে কত মানুষের প্রাণ বাঁচাল?
টিপুদা থমকে গিয়ে তার কাঁধ জড়িয়ে ধ’রে পা দোলালো একটু।
— লক্ষ্যভেদ হলেই লক্ষ্যপূরণ হবে, নাহলে নয়, এমনটা ভাবছিস কেন? নন্দ দুটো বুদ্ধিমান রোবট বেছে তাদের শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছিল। পরের দিনই সুযোগ এসে গেল — কসাই দুপুরবেলা গাছের মগডালে ব’সে আপনমনে একটা সাপের নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে খাচ্ছে। শীতকাল ব’লে গাছে পাতা নেই, ঝোপের আড়াল থেকে নন্দ আরামসে তাক করল রাইফেল, একটা বাঘ শক্ত ক’রে ধ’রে রাখল রাইফেলের বাঁট, আর একজন ট্রিগার টিপে দিল।
পায়ের নীচের ডালটা ভ্যানিশ; কসাই ডানা ঝাপটিয়ে যেই আকাশে উড়েছে, সন্ত্রাসবাদীরা যেমন প্রথম কার্যক্রম না খাটলে দ্বিতীয়টা কাজে লাগায়, ব্যাগড়া মাস্টারকে ফের তাক করল নন্দ, দুই বাঘ মিলে আবার গুলি চালাল। নীল আকাশে সূর্যের দিকে ছুটে গেল বুলেট।
চারদিক থেকে অনেক রোবট দৌড়ে এসেছে, তিন বাঘ লজ্জায় তাদের দিকে তাকাতে পারছে না। শেষে নন্দরাক্ষসের কথাই জনতার মনোবল ফিরিয়ে আনল, যেটা টিপুদা একটু আগে বলেছে:
— বন্ধুগণ, লক্ষ্যভেদ হলে তবেই লক্ষ্যপূরণ হবে, এমন নয়। গুলি যেভাবে কসাইয়ের কান ঘেঁষে শিস কেটে বেরিয়ে গেল, তাতে আগামি কিছুদিন ওর নিজের মুখ দিয়ে আর শিস বেরোবে না। আমি লিখে দিতে পারি, সুন্দরবন ছেড়ে পালিয়েছে পাখিটা।
ষোল
নির্মলের তিন বোনের বুদ্ধিমান শ্বশুরবাড়িরা পার্টিশানের সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরনগরের বড়া গ্রামে তিন মুসলিম পরিবারের সঙ্গে সম্পত্তি বিনিময় ক’রে নিয়েছিল। ইঁটসুরকিতে গাঁথা বাস্তুভিটের বদলে তারা পেয়েছে বেড়ার তৈরি, মানুষসমান উঁচু মাটির বারান্দাওলা এবং গতকাল পর্যন্ত ঝাঁট-পড়া নিকোনো বাসস্থান। এছাড়া চাষজমির বদলে চাষজমি, বিশেষ ক’রে ছোট বোনের ভাগে ঝিলের মতো নিঃসীম পুকুর যার জলজোড়া পানিফলের লতা আর পাশের জঙ্গলে হায়না-দম্পতি।
একফোঁটা চেহারা ব’লে মায়ার ছোট ননদের নাম কুট্টি; শয়তান ঘটকের পাল্লায় প’ড়ে তার মেয়ে কাজলের বিয়ে হল এ-বঙ্গে এসেই; জামাই কৃষ্ণেন্দু নাকি শেয়ার বাজারে লেনদেন করে, প্রচুর কামাই। পরে দেখা যাচ্ছে তার রোজগারপাতি শূন্য; যে কাজেই যায়, দুদিন পরে ছেড়ে চলে আসে।
— অনেকদিন মামা-মামিরে দেহি না, তাই ভাবলাম…।
আত্মীয়ের অপরাধী-মুখ দেখে গৃহকর্ত্রীর ভয়ে এসে ভালোবাসা মেশে। সজনের ডাঁটা দেওয়া মুগের ডাল, আলুভাতে, মানকচুর তরকারি (জামাই নিল না, ওর গলা ধরে) আর বারোমাসি আমড়ার টক দিয়ে চারজনে ভাত খেয়ে উঠতে উঠতে বিকেল চারটে বেজে যায়। কৃষ্ণেন্দু বটতলার দিকে বেরলো বিড়ি ফুঁকতে। ওদিকে বড়ঘরে ছোটমামির কড়া জেরার মুখে কাজল।
— কয় মাস, দুই?
— কী কও বুঝি না!
— ন্যাকা সাজিসনে, কাজ্লা। ছোট্টারে কোলে নিচ্ছিস না, আবার ঠ্যাং মেলে খাতি বসলি। ব’লে সে নিজের নাভির নীচে বাঁহাতে চাপড় মারে।
— এই কোঁখে নয়ডা ধরিছি, তিনডে হয়েও বাঁচেনি।
— আজকে নিয়ে পেরায় আড়াই মাস।
— সংসারের এই অবস্থা, কৃষ্ণেন্দুরে মানা করিসনি?
— করি তো ছিলাম… তোমার জামাইয়ের যে বড্ডো মেয়ের শখ!
পরদিন সকালে কৃষ্ণেন্দু গামছা প’রে (“আহ, করো কি বাবাজি”) শালিমার নারকেল তেলের খালি কৌটো দিয়ে কলতলার ছ্যাদলা ঘষতে লেগে গেল। তারপর বেলা বাড়তে মামিশাশুড়ির চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে ফেলল মাথায় চাল না থাকা বাথরুমে। তিতপোল্লার খোসা দিয়ে হাতেপায়েপিঠে কাপড়কাচা বল সাবান ঘ’ষে দু-দু বালতি জল এক-এক জনের ঘাড়ে ঢেলে যখন বাইরে বের করছিল, যেন বইয়ের নতুন সংস্করণ ছাপা হয়ে বাজারে এসেছে। এবার কাজল রসুন-নিমপাতা-পেঁয়াজ বেঁটে তাতে লেবুর রস মিশিয়ে শিউলির মাথায় ঘষতে লেগে পড়ল, মেয়ের কেশবনস্থলী থেকে উকুন নিব্বংশ করতে হবে। অবশেষে বাড়ির মেয়েদের যার যেটুকু হাতে-কানে-গলায় আছে, তেঁতুলজলে ডুবিয়ে ধুয়ে দিতেই দোকান থেকে এক্ষুনি গড়িয়ে আনার মতো হেম আবার হেসে উঠল হেমবর্ণে! বাচ্চাদের “উপোরে তাকাবি না, চোখ বন্ধ কর” ব’লে কঞ্চির ডগায় ন্যাকড়া জড়িয়ে তিন ঘরের ছাদের সব ঝুল ঝেড়ে ফেলল শ্যামাঙ্গী। ওদিকে কৃষ্ণেন্দু জং-পড়া কোদালেই পেয়ারাগাছের পাশ থেকে মাটি তুলে রান্নাঘরের ছাঁচতলায় ঢেলে ফলার উল্টোপিঠ দিয়ে বসিয়ে দিতে দিতে বলছে : বর্ষাতে আর জল জমবে না, দ্যাখবেন মামি। পরের দিন সে কাতা-র দড়ি দিয়ে বড়ঘরের দরজায় ঝুঁকে আসা কাঁঠালগাছটাকে সোজা ক’রে দক্ষিণ কোণের সুপুরিগাছের সঙ্গে বেঁধে দিল। খোপের ঘরের খাটের তলা থেকে কবেকার আটটা নারকোল বের ক’রে দা দিয়ে ছাড়ানোর পর বাঁশের লগা-র মাথায় কঞ্চি বেঁধে সেই কোটা দিয়ে পায়খানার পাশের হ্যাচ্চাই উঁচু লেবুগাছ থেকে পেড়ে ফেলল ছাব্বিশটা লেবু। তার ইচ্ছে নারকোল আর পাতিলেবুক’টা নিয়ে বাজারে গিয়ে বসে।
— ওমা, কাজল তোর বররে ঠ্যাকা। কয় কী ও! আমাদের মানসম্মান ব’লে কিছু থাকবেনে নাকি!
সুতরাং, নারকেল-কুরুনির মাথা উপচে পড়ে কাঠটগরে, কাঁসার থালায় যেন পুষ্পভোগ চুড়ো হচ্ছে। বড় বড় শ্বাস টানতে টানতে শাঁখাপলা বাজিয়ে কুরুনির মাথায় হাত ঘোরাচ্ছে কাজল, তার ঘামেসিঁদুরেখোঁপায়হাসিতে-মাখা মুখের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে গোপা শিউলি দুই বোন। নারকোল-ফাটানো ঘোলা ঝাঁঝালো জল গামলায় ঢেলে বাচ্চাদের হাওয়ালে করা হয়েছে, প্রত্যেকে দুই ঢোঁক ক’রে খাবে। সঞ্জু নীচু হয়ে সবার গলার হাড়ের ওঠানামা গুনছে — ওমা, ভাই তিন ঢোঁক খেয়ে নিল!
.
(আরও আছে)
loading...
loading...
লিখাটির প্রথম থেকে এই অব্দি মুগ্ধতার সাথে পড়ে চলেছি প্রিয় কবি।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইলো।
loading...