এগারো
“ও-গৃহস্থ, আমার কলোমডা কোথায় বোলতি পারো?… ও-গৃহস্থ, আমার চ্যাবোনপ্রাশের কৌটো পাচ্ছি না”। মনে হবে ভাষকের বয়েস পঁচিশ বছরে আটকে, তেমনি নেশাধরানো গলা। ‘ও-গৃহস্থ’ ডাকে ঘর-উঠোন ভ’রে আছে সারাদিন। মায়াও “একটা কাজ যদি করার উপায় থাকে” এই নকল উষ্মা ঠোঁটে নিয়ে রান্নাঘর থেকে এসে জিনিস খুঁজে দিয়ে যাচ্ছে – কলোম তো নিজির বালিশির তলেই চাপা দিয়ে রাখিছেন।… ডান হাতখান টেবিলের দিকি বাড়ালিই চ্যাবনপেরাশ পাওয়া যায়”। তারপর ফিরে যেতে যেতে মুচকি হেসে শুনিয়ে যাচ্ছে, “শিব মন্দিরটা নড়ে, তবু ওমুক ভট্টাচার্য নড়ে না”।
সেনহাটির সিদ্ধান্তপাড়া গ্রামে তাদের বারবাড়িতে এক গেরুয়া-রঙ শিবদেউল ছিল যার পেছনের বারান্দায় গুচ্ছের চামচিকের বাসা। কর্তাকে নিয়ে বউ যে পারিবারিক প্রবাদ তৈরি করেছে, তাতে মানুষের দেবত্ব (নড়ে না) আর ভগবানের জ্যান্তভাব (নড়ে) প্রমাণিত হয়।
আপাতত একজন মধ্যবিত্ত ভগবানের পেছনে ফোঁড়া উঠেছে। কলোনির অধিবাসীবৃন্দের গায়ে এমন ছরবেছর ফোট গজায় আর চোখে আঞ্জনি। বাসুদেব আর সঞ্জু তারক ডাক্তারের বাড়ি পৌঁছে দেখেছিল, তিনি লুঙি প’রে বেকায়দাভাবে উপুড়, উরুর শুরুতে সবুজ তেলে ভেজানো তুলো লাগানো। ফোঁড়ার মুখ বেরিয়েছে কিনা, বেরোলে ক’টা মুখ, পেকে গেছে কি, পাকলে ফাটবে কবে, কোন তোকমা লাগালে তখনি পুঁজ টেনে নিয়ে ঘা শুকিয়ে দেয় — এমন চর্চায় নিমতিতা সারাক্ষণ গমগম করে। কখনও স্কুল থেকে কোনও হাফ-ছুটি কিশোর খুঁড়িয়ে বাড়ি ফিরছে, তার হাফ প্যান্টের ভেতর থেকে থাই বেয়ে নামা সরু রক্ত দেখে মেয়েরা হাতে মুখচাপা। তো উপুড়শোয়া ডাক্তার একটা ট্যাবলেট ফয়েল থেকে ছিঁড়ে অর্ধেক ভেঙে বাসুর হাতে দিয়েছিল। ওই তাতেই চাঁদের জ্বর সর্বশান্ত হল।
কিন্তু ইঁট পর পর থিয়ে ক’রে সাজিয়ে ঠেলে দিলে যেমন ধারাবাহিক পতনের লাইন আঁকা হয়, তেমনিই ছেলেটার শরীর। জ্বর ছেড়ে যাওয়ার পর মায়ের হাতে তিনচার গাল হাঁসের ডিমের ঝোল-ভাত খেয়ে শুয়ে পড়েছিল, এখুনি কেঁদে জেগে গেল বুকে সাঁই-সাঁই শব্দ নিয়ে। আঁতকে উঠল সন্তান পাহারা দেওয়া দুই মহিলা : “সব্বোনাশ! ও নাদু, ছেলের যে হাঁপির টান উঠিছে!” কাজেই, ব্যস্ত হাতে রান্নাঘরের দরজার শেকল খোলার শব্দ হয়। ফুলকাটা পেতলের বাটিতে সরষের তেল নিয়ে তাতে একমুঠো মাষকলাই ফেলে জনতা স্টোভে বসিয়ে দিল দিদিমা। আর মা ক্রমাগত “চাঁদ আস্তে… চাঁদ চুপ কর…অ্যাখোনি কমে যাবেনে, শোও সোনা… ঘুমোনোর চেষ্টা করো, আচ্ছা, কাল সকালে উঠে অ্যাট্টা নতুন জিনিস খাওয়াবানে তোমারে, ও চাঁদ, শুনলি?…”।
মা তো বোঝে না, শুতে গেলেই দম বন্ধ হয়ে যাবে। মুখ দিয়ে বাতাস টানার চেষ্টা করতে করতে চাঁদের গলা শুকিয়ে এখন কাশি হচ্ছে, প্রতিধ্বনিময় ঘং ঘং — স্টেশানে লোহার তারে ঝোলানো কাটা রেললাইনে হাতুড়ির বাড়ি মারলে যেমন ঘন্টা বাজে। যত শ্বাসকষ্ট বাড়ে, তত সমস্ত পৃথিবীর ‘পরে রাগ তৈরি হয় তার। বোন অবহেলায় নিঃশ্বাস নিচ্ছে, মহানন্দে নাক ডাকছে দিদি, অথচ আমার বুকই আমার শত্রু! পিপারমেন্টের মতো ঠান্ডা হাওয়া চারদিকে, শুধু আমার জীবনেই কেন বাতাস বাড়ন্ত হয়ে যায়? দিদিমা শীতল আঙুলে গরম মাসকলাইয়ের তেল মাখিয়ে তার বুকেপিঠে ড’লে দেয়, তালে তালে ফুসফুস-অ্যাকর্ডিয়ান থেকে নানা সুরের সিম্ফনি…ফুসফুস-জারুলগাছে অনেক পশুপাখালির ডাক। কারও কোলে কোলাব্যাঙের মতো ঝুলে থাকলে কিছুটা আরাম পাওয়া যেত, কিন্তু দিদিমার কাঁখ থেকে তাকে পিছলে যেতে হয় বারবার, মাও একটু পরে হাঁপাতে থাকে, “নাম বাবা, আমি কি পারি, তুমি না বড় হয়ে গেছো!” এখন নিঃশ্বাস নিতে গেলেই চাঁদের পিঠের পেশিতে খিঁচ লেগে দম আটকে আসছে। তখুনি হালকা খুটখুট শব্দ হয় কোথাও, আর মায়া মাথায় ঘোমটা টেনে বসে।
— ও মা, তোমার জামাই দরজায় টোকা দেচ্ছে!
— ওরে না, কালো মেনিডা রাতবিরেতে অমোন দুয়োর হাঁচড়ায়।
নিজের স্বামীকে কীভাবে কতটা চিনেছে, বাইশ বছর বয়েসে বৈধব্যগ্রস্তকে সে বোঝাবে কী ক’রে! একশোটা কাঠের ডাঁটিওলা ছাতা থেকে মায়া স্বামীর ছাতাটি এক মিনিটে চিহ্নিত করে দেবে। স্কুলে যাওয়ার পাঞ্জাবি প’রে ভুলুকভালুক তাকালেই বোঝে হাতঘড়িটা খুঁজছে, স্কুল থেকে ফেরার পথে যখন কলবল করতে করতে হেঁটে আসছে ট্রেনযাত্রীরা, একজন নীরব মানুষের জুতোর আওয়াজ সে মোড়ের মাথাতেই শনাক্ত ক’রে ফেলে। তিন মাসের পোয়াতি জানলায় ব’সে যেমন দূর-মাঠের ঘাসের গন্ধ পায়, স্বামীর ব্যাপারে দিনরাত তেমন গভীর ইন্দ্রিয়শক্তি নিয়ে জেগে থাকে মায়া।
ঘরে ঢুকে নির্মলচন্দ্র ছেলেকে কোলে তুলে নিজের গায়ের লম্বা পুরোনো শালটি তার পিঠের ওপর জড়িয়ে নেয়। পাশের ঘরে ফিরে যেতে যেতে বলে, রাত দুটো বাজে গেছে, তোমরা হেরিকেন নিভোয় শুয়ে পড়ো।
বারো
বাবার গায়ে সারাক্ষণ পুজো-পুজো গন্ধ। যদিও নির্মল বাড়ির পুজো আর স্কুলের সরস্বতীঅর্চনা ছাড়া কোথাও পৌরোহিত্য করে না। কেউ অনুরোধ করলে বলে, আমাদের বংশে যজমানিবৃত্তিতে নিষেধ আছে। বাবার কাঁধে কন্ঠার হাড়দুটো জেগে থাকে। সেই খোঁদলে নিজের থুতনি বসিয়ে নেয় চাঁদ। বাবার তলপেট সামান্য উঁচু, সেখানে তার পাছাটি আশ্রয় পায়। যেন এক উল্টোনো ইজিচেয়ারে শুয়ে সে এই প্রথম সুষুপ্তির ভাবনা ভাবতে পারে।
এদিকে সারা রাত ঘুম ভাঙে আর ঘুম জোড়ে মায়ার, পাশের ঘরে মৃদু পদপাত তবু থামে না। প্রতি অর্ধ-প্রহরে ছেলেকে বিছানায় শোয়াতে যায় বাবা, আর সে চিৎকার ক’রে কেঁদে আবার কোলে উঠে আসে। বাচ্চা কোলে এই অনন্ত পায়চারির মধ্যে শুকনো পাতা মশ-মশ ক’রে বাড়ির পেছন দিয়ে শেয়াল দৌড়ে যায়, রাতের পাখি ডেকে ওঠে আজাদ হিন্দ সংঘের বটগাছে, আর ভেসে আসে মান্নাপাড়া থেকে কীর্তন-আসরের গান — ও মন, ওরে পাগল মন, তুই চিনলি না আপন। পদকর্তার গলা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে :
গৌরীদাসের সঙ্গে চৈতন্যের মিলন হল কোথায়? এ-নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিস্তর বহুমত, কেউ বলছেন শ্রীখণ্ডে, কেউ কাটোয়ায়, কেউ বা কাঞ্চননগর। আমরা বলি, কোন কালে দেখা? কেননা, স্থান গুরুত্বের নয়, কথা হল কাল।
যেথা যেথা নিত্য হরিনাম-সংকীর্তন।
সেথা নিত্য নবদ্বীপধাম, নিত্য বৃন্দাবন।।
বাণীনাথ ভট্টাচার্যের দুই ছেলের ছোট নির্মল, দাদা করুণাময়। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি করুণা ভাইকে বললেন, নিমু আমি হিন্দুস্তানে চলে যাব সপরিবারে। তুই আমার সম্পত্তির অর্ধেক অংশ বাবদ টাকা দিয়ে দে। নির্মল নগদ যা ছিল কুড়িয়েবাড়িয়ে ব্যাংকের জমা টাকা ভেঙে দাদাকে দিয়ে দিয়েছে। কয়েক বছরের মধ্যে তাকেও ভিটে ছাড়তে হল। নারায়ণশিলার নিত্যপুজোয় যাতে বাধা না পড়ে, এক ব্রাহ্মণ পরিবারকে বাড়িতে বসিয়ে পরিবর্তে কিচ্ছুটি না নিয়ে দেশ ছাড়ল লোকটা।
তখন পদাবলী-কথকের গলা :
শ্রীচৈতন্য নিত্যানন্দাদি বন্ধু ও শিষ্যদের নিয়ে নগর-পরিক্রমায় বেরিয়েছেন, বদনে হরিনাম — এমনি সময়ে গৌরীদাস উপস্থিত। তাঁকে দেখেই গৌরাঙ্গের মনে পড়েছে শ্রীরাধার কথা। কেননা, এই গৌরীদাস তো আর কেউ নন, তিনি বৃন্দাবনের সুবল। মহাপ্রভু গৌরীকে জড়িয়ে ধরে “রাধা রাধা” ব’লে উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে লেগেছেন।
তাদের হিন্দুস্তানে চলে আসার তোড়জোড় চলছে, পাশের গ্রাম মহেশ্বরবাসা থেকে মাদারে মুখুজ্জে এসে বলে কি, নির্মল আমাকে তুমি কিছু টাকা দাও তো দত্তপুকুরে ভালো জমি পাওয়া যাচ্ছে, তোমার জন্যে রাখি। নির্মল তার হাতে নিজের শেষ সম্বল দু’হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়েছিল। এ-বঙ্গে এসে দ্যাখে কলোনির জমি সরকারি, কিনতে এক পয়সাও লাগে না। আদাড়ে নামে বেশি পরিচিত মাদারেকে সে আর টাকার কথা শুধোয়নি। যা গেছে, গেছে।
তখন মান্নাপাড়ার কথকঠাকুর :
আহা, সে কী অশ্রু! দৃশ্য দেখে কোনও ভক্ত বলছেন, প্রভুর দুচোখ বেয়ে মুক্তো গড়িয়ে পড়ছে। আবার কোনও ভক্ত বলছেন — না না, গড়িয়ে পড়ছে মুক্তি। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের ভক্তিরূপ গাল বেয়ে মুক্তি গড়িয়ে পড়ছে গো!
এবার জোকার উঠল — হরে হরে কৃষ্ণ, নিতাই নিত্যানন্দে জয় জয়! বলো শ্যামো অঙ্গে, গৌর অঙ্গে বলো জয়। নির্মল টের পায়, শ্বশ্রূমাতা মাটির হাঁড়িতে গোবরজল নিয়ে ছড়া দিচ্ছে উঠোনে। ফার্স্ট ট্রেন ঘটঘট ক’রে স্টেশানে ঢুকল। মাঘী পূর্ণিমা লাগবে সকাল সাতটায়। বচ্ছরকার দিন ছেলেটা অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। তবু তার গলার বাঁশি-শব্দ এখন অনেক আবছা। সন্তর্পণে শোয়াতে গিয়ে নির্মল দেখে গাল ভিজে ভিজে, কয়েক দানা কৃষ্ণপ্রিয় অশ্রু বাবার চোখ থেকে খ’সে গিয়ে লেগেছে সন্তানের মুখে।
সংস্কৃতে কাব্যতীর্থ উপাধি-র মানুষটা বিড়বিড় করে গীতগোবিন্দ ভাঁজছিল — চন্দনচর্চিত নীল কলেবর পীত বসন বনমালী। কিন্তু জয়দেবের দ্বিতীয় চরণ কেলি চলন্মণি কুণ্ডল মণ্ডিত গণ্ডয়ুগস্মিত শালী-র জায়গায় হঠাৎ মাথায় এল — মাটির বুকে চাঁদের নিমাই, ধরতে গিয়ে জাত খোয়ালি। এটা কোনও বাউলগানের লাইন, নাকি নিজেই সে লিখেছে কখনও! অযাচিত এমন এক সৃষ্টিমুহূর্তেই হয়ত ছোটছেলের নাম রাখা হয়েছিল অযাচক। এখন ঘুমে বিভোর তীক্ষ্ণ-করুণ মুখটার দিকে তাকিয়ে মনে হল, কে জানে জীবনের কাছে কত-কতবার হাত পাততে হবে এই শেকড়-ওপড়ানো শিশুকে; প্রার্থনা, মাঙন, কাতর অনুরোধে ভ’রে থাকবে কিনা এর পরমায়ু! বৈরাগী নামের বোঝা চাপিয়ে একটা দুর্বল ফুসফুসকে আগে থেকেই ক্লান্ত ক’রে তুলব?
চাঁদের ভালো নাম তবে চন্দন, যে সব রকম সৎকারেই লাগে — এই ভেবে তাকে বিছানায় নামাল নির্মলচন্দ্র। বালিশে নতুন নামের গন্ধ নিয়ে সে স্বপ্নের দিকে বয়ে যাক…।
(শেষ)
loading...
loading...
যেন বাস্তব জীবনের গল্প পড়লাম। একরাশ শুভকামনা প্রিয় কবি চন্দন ভট্টাচার্য দা।
loading...