আট
অনেক দূরের নক্ষত্রমণ্ডল থেকে ফিরে আসছিল চাঁদ, রিকশা ক’রে। অন্ধকার মহাজগতে চাকার নীচে খোয়ার মতো ছায়াপথ আর গ্রহাণুপুঞ্জের ঝাঁকুনি খেয়ে, রিকশার হ্যান্ডেলের লাগানো টেমি-র আলোয় রাস্তা দেখে দেখে…। হঠাৎ এক একটা উল্কা ছুটছে চারদিক সাদা ক’রে দিয়ে। তখন বোঝা যাচ্ছিল, ধ্রুবলোকের কোথাও ব’সে সিংহ কেশর ঝাঁকাচ্ছে; কোথাও রথের মেলায় তেলেভাজার দোকানে বেসন ফ্যাটানো হচ্ছে; কোথাও পাহাড়ি কেল্লার ছাদ থেকে জরির পোশাক পরা একটা মেয়ে হাত নাড়াচ্ছে তার দিকে।
রিকশাওলা তাদেরই স্টেশান-বাজারের মোতিউরদা, যার কাঁধের গামছায় জ্বলছে নিভছে অনেক জোনাকি। “তারাক’টা বেঁদে নিয়ে আসলাম বলো, কেরোসিনির যা দাম!” ব’লে সে এতক্ষণ বাঁহাতের ব্রেকে আটকে রাখা নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র খুলে দেয় আর শোঁ-শোঁ ক’রে নীচে নামতে থাকে তিনচাকা গাড়ি। চাঁদের বাড়ির হারিকেন বাধ্য হয়ে রাত ন’টাতে নিভে যেত, কেননা রেশানে এ-সপ্তাহে ‘কেরাসিন’ দেবে তো পরের সপ্তাহে দেবে না, আর মা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে, “বেলাক-এ তেল কেনা অন্যাই”। দারিদ্র সবচেয়ে ভালো মুখ লুকোতে পারে নৈতিকতার পিঠে। এখন, থকথকে কুয়াশার মধ্যে অবতরণ করতে করতে সে গুনতে থাকে — বড়ঘর, রান্নাঘর, খোপের ঘর, পায়খানা। মোট চারটে তারাজোনাকি যেই চাইতে যাবে মোতিউরদার কাছে, দেখা যায় রিকশা আলো ক’রে চাঁদের গা ঘেঁষে সেই মহাকাশ-দুর্গের মেয়েটা!
নয়
ঘোষপাড়া, চড়কপাড়া, মান্নাপাড়া — এভাবে চলল এ-দেশিয়দের ফাঁকাফাঁকা দালান, সাধারণত হলুদ রঙের, রোয়াকবিশিষ্ট, নিঃঝুম। চওড়া কাঁচা রাস্তাগুলো খেঁকিকুকুর-প্রধান; দুচার পা অন্তর ছোট ছোট মাঠ; আর আছে হরিসভা, ক্লাব নয়তো পুষ্করিণী। বাসিন্দাদের মধ্যে ভুঁড়িয়াল টাকমাথা লোক বেশি; কোমরে আলগোছে ফিতেবাঁধা পাজামা, মাথার চুল-টানা বা পিঠ চুলকোনোর জন্যে বিকেলে কচুরি কিনে দেওয়ার শর্তে বাচ্চাদের ডাকছে। খুব খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়া হয় এখানে, সকালে কর্তা, তারপর ছেলেমেয়ে, দুপুরে গিন্নি, শেষে সেটি চলে যায় পাশের বাড়ি এবং শ্লীলতাহানির সংবাদের মতো বিধ্বস্ত হয়ে রাতে ফেরত আসে।
অঞ্চলের নাম নিবাধুই। অদ্ভুত নামে আকৃষ্ট হয়ে সুকুমার সেন খোঁজতলাশ ক’রে জানিয়েছিলেন, দুশো বছর আগে আশশ্যাওড়া, আলকুশি, জার্মানিলতার ঝোপে ঢাকা; শিমূল, বাবলা, অক্ষয়বট, বেল, টককুলের বৃক্ষে ছাওয়া এলাকাটির নাম রাখা হয়েছিল নির্বান্ধবপুর। সেখান থেকে নিবন্ধপুর… নিবদ্ধপুর… নিবধই…নিবাধই হয়ে আপাতত নিবাধুই-তে থেমেছে। পুরোনো ও বর্ধিষ্ণু গ্রামটি ১৮৪৮ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চেষ্টায় ছেলেদের হাইস্কুল পেয়েছিল। চার বছর পরে তিনি এখানে বালিকা বিদ্যালয়ও বসিয়ে দিয়ে যান। বিদ্যাসাগরের নিজের সঞ্চয় থেকে অর্থসাহায্য আসত স্কুলদুটোয়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও দীর্ঘদিন ভাতা পাঠিয়েছেন। বর্তমানে এই লোকবসতি “তাদের পানে ভাঁটার টানে যাব রে আজ ঘরছাড়া” গাইছে, শরিকি সম্পত্তি ভাগ হতে হতে এক ভিটেতে তিন-চার পরিবার মাথা গুঁজলে কী আর করা! পাড়ায় কত-না শিক্ষকের বাস, নাট্যকারের ভদ্রাসন; তবু ধরা যাচ্ছে না বাউন্ডারি ওয়ালের সংস্কার, বাড়ির কলি ফেরানো বা পুকুরঘাটে সিঁড়ি মেরামতির কাজগুলো। বাথরুমের কাঠের দরজা ভাঙলে পুরোনো ফ্রেমে একপাল্লার টিন যোতা চলছে।
মোতিউরের রিকশা প্যাঁক ক’রে হর্ন মারে, সাড়ে দশটার অন্ধকার শূন্য রাস্তা থেকে নেমে দাঁড়ায়, আর ডান হাতে ভেসে ওঠে দোলপূর্ণিমার ফাংশানের মাঠ। তারপর জোড়াবটতলা পার হল, যেখানে সারা দুপুর গাছের ঝুরি ধ’রে ঝুল খেতে খেতে এতবার বটনিম্নস্থ পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাচ্চারা যে এই শুনশান রাতেও দুটো পরিচ্ছন্ন ঝুপ শব্দ শোনা গেল। চমকে উঠে মোতিউর দ্যাখে পুকুরের ওপর তির্যক ফলবাগান থেকে নারকোলমুন্ডু খ’সে পড়ে হাসতে হাসতে ভেসে যাচ্ছে জলে।
মান্নাপাড়ার কালীবাড়ি পৌঁছে রিকশা থামবে জানা কথা; এখানে প্রণাম না সেরে কোনও নতুন বউ শ্বশুরবাড়ি ঢোকে না। কিন্তু ভগবানই জানে কখন কোন বৃষ্টিতে চাঁদের সারা গা জবজবে ভিজে আর অসম্ভব বাতাসে জামাটা খুলে উড়ে যেতে চাইছে… গেলও বোধ হয়। এদিকে চুমকিপাড় ওড়নার রাজবালিকা মা-কালীকে গড় ক’রে উঠে দাঁড়াতেই চাঁদ দেখল তার ছিপছিপে গলায় দিদিমার মুখ বসানো! অবাক হওয়ার সময় নেই, উড়নচন্ডে হাওয়া এবার খুলে ফেলেছে তার হাফপ্যান্টের প্রথম বোতামটা…।
দশ
লেপের নীচে অসুস্থের ঘেমো শরীর মুছিয়ে দিতে দিতে সঞ্জু ভাবছিল — সেরে উঠুক, তারপর যা খ্যাপাবো না! একটু আগে রোগি দিদিমাকে জিগেস করেছে, সিঁদুর পরোনি কেন? সন্ধেবেলা কাঁদল আমার মাথাটা খুঁজে পাচ্ছি না ব’লে। যখন পাশ ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কী রাগ —“আস্তে চালাও, মোতিউরদা”, অথচ একমাস হয়ে গেল রিকশাওলা মোতি ট্রেনে কাটা পড়েছে। ধুম জ্বরের মধ্যে এত মজার মজার প্রলাপ বকছিল চাঁদ যে শীতলাতলায় চার আনার বাতাসা মানত করতে হল ছোটভাইকে সারাক্ষণ চড়-থাপ্পড় মারা ছেলেটার।
তখন মা বলল, কাঁদতিছিস কেন, এই সঞ্জু? এই বোকা, ভাইয়ের জ্বর নামে গেছে ব’লেই তো ঘাম দেচ্ছে। কালই দ্যাখবা, তোমারে আবার চিমটি কাটবেনে পড়তি ব’সে।
জননী তারপর রান্নাঘর থেকে এইমাত্র আসা দিদিমার সঙ্গে ইশারাময় সংলাপে ডুবে গেল।
— পালি, নাদু?
— ও মা, কী পাবো!
— সত্যি কোচ্ছিস, গন্দো পাসনি?
— তুমি পাইছো?
— একছিটেও না। আমি ভাবলাম আমার বুঝি সোদ্দি…।
— উনোনে ক’টা মরিচ পোড়াইছিলে?
— তিন-তিনডে। ডালি অ্যাট্টা ফ্যালায় সোম্বোরা দিলিই কাশতি কাশতি পেরান যায়! ফাটানে ঝাল।
— তার মানে তুমি যা ভাবিছো তাই!
— নালি আর কলাম কী?
স্বাভাবিক শত্রু কিন্তু আপৎকালে একজোট দুই রমণী গালে-হাত চোখ-দীঘল ক’রে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর একজনের ঈষৎ গর্বিত গলা শোনা যায়, “আমার চাঁদ হয়ত এট্টু রোগা, কিন্তু মুখটা-মাথাটা টলটল করে”। দিদিমা, যেন নিজেরই প্রশংসা হল, ব্লাশ করে যথারীতি : “বোলতি নেই, যা ফনফনায় উঠিছে, তোর মতোন নাম্বা হবে”। তারপরই মুলিবাঁশের বেড়া কেটে বানানো জানলা দিয়ে কুটিল দৃষ্টি ছোঁড়ে বলরাম দাসের বাড়ির দিকে : “বলা-র বউখান তো না, য্যান্ পুতোনা রাক্ষসী”।
এখন সব চোখই দৃষ্টিহীন এই উপনিবেশে। শুধু বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে পা-দুটো ছাড়িয়ে নিল মা-মেয়ে। অসুস্থ সন্তানের মাথার কাছে ব’সে তারা কত রাত ভোর করেছে তার হিসেব হয় না।
(আর একটু)
loading...
loading...
অস্টম নবম এবং দশমাংশ পড়লাম প্রিয় কবি। বেশ।
loading...