নিমতিতা সরকারি কলোনি

তিন
তারক অধিকারীই উদ্বাস্তু-মোকামে বাস করা একমাত্র বদ্যি। কেউ কোনওদিন তার ডিগ্রি জানতে চায়নি; ‘নেয়েচি’-খেয়েচি’ বলা ঘটি পরিবার সরকারি কলোনিতে ভিড়ল কীভাবে, সে রহস্যের গিঁট খুলতেও লোকের বয়ে গেছে। কামদেবপুরে তার ডিসপেনসারি, সেখানে গরীব মুসলমানদের সাক্ষাৎ খোদা এই তারকেশ্বর। দুহাতের আঙুলে সাতখানা পাথর আর সমান সংখ্যক সন্তানের মালিকটির কলম ব্যবহারের অভ্যেস নেই, ট্যাবলেট ফয়েল থেকে ছিঁড়ে খবরের কাগজে মুড়ে রোগির হাতে ধরায়, সঙ্গে ঝাঁঝালো মিষ্টি ‘মিক্‌চার’। সবাই তার হাতযশের কথা মানে, এবং যারা চিকিৎসা সত্ত্বেও মরে গেল, তাদের আপনজনের পাশে দাঁড়িয়ে তারক স্বগতোক্তির মতো ব’লে দেয় — রোগটা ঘ্যাঁজ্‌ড়া হয়ে গেছলো। খুলনা-যশোর এই শব্দ চেনে না, ঘ্যাঁজ্‌ড়াকে মহাভারতের কোনও অপরাজেয় রাক্ষস ভেবে নিয়ে মানুষ সংযত থাকে।

চাঁদ যখন অধিকারীবাড়ির পাশ দিয়ে বায়ুবেগী, চেম্বার সেরে বাড়ি পৌঁছে সবে সাইকেল থেকে নামছিল ডাক্তারবাবু। তার ফেরার খবর কীভাবে যেন পেয়ে যায় পাড়ার বাচ্চারা, সাইকেলের পেছনে এর মধ্যেই দশ-বারো জনের জমায়েত। কাগজের ঠোঙা থেকে লজেন্স বের ক’রে সে প্রত্যেকের মুঠোয় একটা ক’রে গুঁজে দিতে লাগল। একটু পরে এসে জুটবে রাস্তার কুকুরের দল, খেয়ে উঠে এক-থাবা ক’রে মাছের কাঁটামাখা ভাত তাদের মুখে ধ’রে দেবে ডাক্তার। চাঁদকে দেখতে পেয়ে সে যেই হাত বাড়িয়েছে, কেঁপে পিছিয়ে গেল ছেলেটা। বাইরের কারও কাছ থেকে কিছু নেওয়া ব্রাহ্মণবাড়িতে মুরগির মাংস তোলার মতোই কঠিনভাবে নিষিদ্ধ। কেননা, দানগ্রহণ মানে নিজেকে ভিখারি প্রমাণ করা, পরিবারের সম্মান ধুলোয় মেশানো। এর শাস্তিও পিঠে বেত ভাঙার মতো সর্বোচ্চ রকমের হয়ে থাকে।

তারক ডাক্তারের ভাইয়ের নাম নারায়ণ ছবিয়ালা। কপালে অনেকগুলো চিন্তাশীল ভাঁজ সমেত শিবনেত্র চোখ, দাদার কাছে আসা-যাওয়া করে একই রকম একখানা সাইকেলে চেপে। দুজনের জামাকাপড়ও সেম টু সেম : টেরিকটনের পাঞ্জাবি, ধুতি; পাঞ্জাবিতে কান্তা সেন্ট আর চারটে ক’রে পেতলের বোতাম লাগানো। নারায়ণ অধিকারী আগে ছিল ভ্রাম্যমান ফটোগ্রাফার : বিয়ে-পৈতে-অন্নপ্রাশন উপলক্ষ্যে ছবি তুলিয়া থাকি। আচমকা ক্যামেরা বিক্রি ক’রে ফটো বাঁধানোর দোকান দিয়েছে কাশিমপুর বাজারে। পেছনের গল্পটা টিপুদা জানে।

কলোনির আপামর কাজে ডাক-পড়া, জলেস্থলে চরকি-কাটা ছেলের নাম টিপু, যার পদবি বলতে লাগে না, পাড়াসুদ্ধু মানুষের জন্যে ইয়োরস ফেথফুলি হয়ে আছে। কোনও বয়স্থা মেয়ে যদি মায়ের কাছে যাত্রা বা গানের জলসা দেখার জেদ ধরে — “পা খুব লম্বা হইছে, না? বাবা শুনতি পালি ঠ্যাং কাটে নেবে। ও আচ্ছা, টিপু নিয়ে যাবে? তালি যাও, ঘুরে আসো”।

টিপু ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিন বাড়ি-বাড়ি ভাইফোঁটা নিয়ে কুল করতে পারে না। মাথার চুলে ধানক্ষেত, কপাল মোটা হয়ে যায় ঘি-চন্দনে।

তো, মাস দুয়েক আগে চাঁদের শিউলিদিদি তাকে ফোঁটা দেওয়ার পর খাটে বসে লুচি-আলুরদম খেতে খেতে টিপু শুনিয়েছিল :
মুখার্জিপাড়ায় সিতু মুখার্জির মা মারা গেল না? ছবি তোলার জন্যি নারানকাকুরে ডাকে (ভালো কথা। তারপর?)। কাকু সেদিন ঠিক মার খাতো (ওমা, কেন!)। সিতুর বড়ভাই কংগ্রেস তো! সে শাসানি দিছিল, “ফেরার সময়ে ক্যামেরাটা নন্দসায়রের জলে ফেলে দিয়ে যাস। আর কোনওদিন ফটো তুলতে দেকেচি তো তোর খবর আচে! ফ্রেমে বাঁদিয়ে জবার মালা পরিয়ে ঘরে ঝুলিয়ে দোবোখুনি” (হি হি, টিপু তো জোরদার ঘটিভাষা শিখে গেছে! কিন্তু নারানদার দোষটা কী হলো, কোবি তো?)।

কাকুর সেই প্রথম মরা মানুষির ফটো তোলা। ক্যামেরার পেছনে যেয়ে ডেডবডিরে ব’লে বসিছে “রেডি”? শুনে সবাই হয়রান (ধ্যাস্‌, টিপু বানায় বানায় কচ্ছে)! কিন্তু তাতেও নারানকাকুর চেতনা হয়নি। মাথা তো কালো কাপড়ে ঢাকা। সে এবার আরেট্টু গলা তুলিছে, “এস্‌মাইল”!

চার
যিশুর রুপোলি ক্রসের মতো জেট প্লেন ঝিলিক দেয় আকাশে। তার ধোঁয়া-লেজ প্রথমে কেকের সাদা ক্রিম, আস্তে আস্তে ছানাকাটা দুধ হ’য়ে আকাশেই ভাসতে থাকে। রাস্তায় কমলালেবুর খোসা দেখে চাঁদ তুলে পকেটে পুরে নিল (বোনের চোখে রস দিয়ে দেব), তারপর ঢুকে পড়ল লখাইদিদির বাড়ি। বারান্দায় কেউ নেই, দরজা খোলা পেয়ে সে সোজা ঘরে পৌঁছে দ্যাখে মাসিমাও জেট-প্লেনস্বরূপ, মুখ দিয়ে কড়া গন্ধের ধোঁয়া বেরচ্ছে। ভট্‌চাজবাড়ির পোলাকে দেখে সেই বাষ্প থতমত, আর কোথা থেকে লখাই এসে প’ড়ে “কী হইছে রে, দিদিমা আমাগো বাড়ি আসলি দেখতিই তো পাতিস” বলতে বলতে তাকে ঠেলে ঘরের বাইরে ক’রে দেয়।

এভাবে বারবার চাঁদের ব্যর্থতায় দুঃখিত রোদ্দুর তেঁতুলগাছের পাতা বেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছিল তো যাচ্ছিলই। যেমন পাড়ার নাইটগার্ডদের একদল ঘুমোতে গেলে অন্যদল পাহারায় দাঁড়ায়, রোদ রেখে যাচ্ছিল ছায়াকে। ব্যাপারটা বাবার মুখে শোনা জয়দ্রথের উপাখ্যানের সঙ্গে পুরো মিলে যাচ্ছে। সূর্যাস্তের পর বিধবাদের ভাত খাওয়ার নিয়ম নেই ব’লে অভিমানী বৃদ্ধা সন্ধে পর্যন্ত আত্মগোপনে, তাকে জটিল ব্যূহের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছে পাড়ার কোনও দুর্যোধন পরিবার! সুতরাং দিদিমাকে বের ক’রে আনার একমাত্র উপায় হল… নিজের ডানহাতের তর্জনীর দিকে তাকায় চাঁদ, কিন্তু সেখানে কোনও সুদর্শন চক্র দেখতে না পেয়ে আবার মুষড়ে পড়ে।

বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে এখানে রাস্তা চারভাগ হয়ে কলোনির অচেনা চার দিকে ছড়ানো। সে মরিয়া হয়ে বড় রাস্তা ধ’রেই ধাবমান, হঠাৎ কী মনে হতে ডান দিকে তাকায়… একটা চেনা চেহারা সরকারবাড়ির দুর্গামণ্ডপে পা ঝুলিয়ে বসে আছে না! কষ্টিপাথর গায়ের রঙ, বেঁটেখাটো শরীর, শুধু চোখদুটো যেন কালিপুজোয় চোদ্দপ্রদীপের ঢল থেকে বেছে এনে বসানো। যত অশ্রুই রাখো, ধ’রে যাবে।

— ওই যে দিদি, বর অ্যাতোক্ষণে তুমারে নিতি আসিছেন।
দিদিমার চেয়েও বয়স্কা সরকারজেঠুর ফোকলাদাঁতি কোলকুঁজো মা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
— তুমি কীরম জামাই, বউ ঘোনো ঘোনো পলায় যায় ক্যান!”
— আমি কিছু করিনি। মা’র সঙ্গে ঝগড়া…।
— তা বোল্লি তো শোনবো না, মোনি। নিজের ইস্‌তিরি যহোন, যত্ন ক’রে রাখতি হবে। বড় হয়ে ছুঁড়ি বউ অনেক পাতি পারো, কিন্তু কথাডা মিলোয় নিয়ো, এই বুড়ির মহোব্বতের মোটে ধারেকাছেও কেউ আসতি পারবে না।

চাঁদ দ্যাখে, দিদিমা কিশোরীর মতো লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। মাথার ঘোমটা আর একটু টেনে সারাক্ষণের সহচর পানের ডাবরটি হাতে সে নাতির পেছন পেছন নিঃশব্দে মণ্ডপ থেকে নেমে যায়।

রাস্তায় পড়তেই ওদের দুপাশ দিয়ে যেন ভূতের তাড়া খেয়ে ফোঁশ ক’রে উড়ে গেল দুই কিশোর; যাদের চালু নাম বাবু-হাবু। এবং অচিরেই তাদের পাঁচ-ছয় তুলসী চক্রবর্তী দূরত্বে ফুটে উঠল তৃতীয়জন — ভুঁড়ি, ফটফটিয়া চপ্পল, হাতে কঞ্চি আর কোমর থেকে বিপজ্জনক নেমে যাওয়া লুঙি নিয়ে; প্রচলিত নাম জুতোনিমাই। বাচ্চা মানুষ করাকে কেন্দ্র ক’রে কলোনিতে খুবই জনপ্রিয় এই দৌড় প্রতিযোগিতা সারাদিনে দু’ থেকে তিন বার অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

শোনা যাচ্ছিল, নিজের ছেলেদের পৃথিবীর প্রায় সমস্ত জানোয়ারের বাচ্চার নামে ডাকার পর হাঁফাতে হাঁফাতে তাদের কেটে কুচিকুচি ক’রে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে জুতোনিমাই। ধরতে পারলে তবে তো ভাসান? যমজ ভাইদুটো ঘুম ভাঙতেই আজাদ হিন্দ ক্লাবের চাতালে এসে বসে, পাশের শীতলা মন্দিরের ঘট থেকে পয়সা গেঁড়িয়ে মটরভাজা কিনে খায়, কুকুর পেলেই ঢিলোয়, দাঁড়াশ সাপ দেখলে ডান্ডাপেটা ক’রে মারে, শেষে শান্ত হয়ে চাতালে ইঁট দিয়ে ঘর কেটে মাথা গুঁজে ষোলোগুটি খেলতে লেগে যায়। সাধারণত এই সময়েই চিতবাঘের চরিত্র নিয়ে দুজনের ঘেঁটিভাঙার লক্ষ্যে গুঁড়ি মেরে এগোয় তাদের জনক, অথচ ঠিক আগের সেকেন্ডে কীভাবে টের পেয়ে ছাগলের বাচ্চার মতো তিড়িং ক’রে লাফিয়ে পালায় ওরা। তারপর তিনজনের ছুট ক্রীড়াসূচি মেনে।

রান্নাঘরে লোহার মতো ভারি গাঢ় খয়েরি রঙ কাঁঠালপিঁড়িতে বসে বড় বড় ভাতের দলা মুখে পুরছিল দিদিমা। সম্পত্তি বলতে এই পিঁড়ি আর ওই পানের ডাবরই সে ওদেশ থেকে আনতে পেরেছিল। চাঁদ কোলের ওপর লেপ টেনে বড়ঘরের খাটে বসে আছে। ছেলেদের পাকড়াতে আবারও ব্যর্থ জুতোনিমাই বাড়ির পাশ দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল তখন :
“আমি শালা পেত্যোহো পঞ্চাশটা লোকেরে জুতো পরাই, এদিকি হারামিদুটো কিছুতি একজোড়া চটি পা’য় দেবে না, গোড়ালিতি বাবলাকাঁটা ফুটোয় খোঁড়াতি লাগিছে! ইচ্ছে ক’রে ছাড়ে দিলাম…।”

(আর একটু)

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
নিমতিতা সরকারি কলোনি, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৪-১০-২০২২ | ১০:২৭ |

    ইন্টারেস্টিং লিখা। পড়তে গিয়ে কখন যে মনটা হালকা হয়ে গেলো বুঝতে পারলাম না। Smile শুভেচ্ছা নেবেন প্রিয় কবি চন্দন ভট্টাচার্য দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...