নিমতিতা সরকারি কলোনি

এক
নিমগাছে নতমস্তক হয়ে পড়েছে রোদ্দুর। পুকুরপাড়ে পোঁতা খুঁটির ডগায় ব’সে মাছরাঙা ভাবছে, মাছ ধরতে গেলে সেই তো পায়ে ঠান্ডা লাগবে। কার বাড়ি যেন রেডিয়োতে “বলো না সহজ ক’রে আমায় পেরেছ তুমি বুঝতে”, আর প্রত্যেক গাছের নীচে শুকনো পাতার কবিতাপাঠ।
তখন কলোনির রাস্তা দিয়ে একটা বাচ্চা ছুটছিল।
— ও চাঁদ, কুথায় যাস?
— দিদ্‌মারে খুঁজতি।
ব’লে সে দুটো হাঁচি দেয়। আবার ছোটে।

বলরাম দাসের ভিটের দিকে যাওয়া নেই। শত্তুর পরিবার, দিদিমা হাজার ম’রে গেলেও ও-মুখো হবে না। পরের বাড়ি নবীন বিশ্বাস।
— ও নবীন, তুমি কী কাজ করো?
— মাসিমা, আমার ব্যারাকপুর টেশেনের গা’য় টেশেনারি দোকান।
— কী নারী ক’লে? ভগোবান য্যান্‌ তোমারে সুবুদ্ধি দেন!

হলুদ গায়ের রঙ আর টানা নাকচোখের নবীন; তার সুবুদ্ধি আছে, আবার নেইও। বিক্রিবাটার পয়সা ঘরেই এনে রাখে, তারপর পাড়া-টহলে বেরোয়। প্রত্যেক বাড়ির পাশ দিয়ে নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াবে আর উঠোনে কি কলতলায় মেয়েমানুষ দেখলেই এগিয়ে এসে, “বুঝলে, আজ আমার চোখির সামনে তিনডে লোক এক বুড়ির হার ছেনতাই ক’রে দোড় মাল্লো”। এভাবে নীচু গলায় বিরামহীন গল্প শুরু হল, ওদিকে সে-মেয়ে একগাদা জামাকাপড়ে বল-সাবান মাখিয়ে রেখেছে, কাচবে কখন? অথবা,
— দাদা যাই, উনোনের ভাত এইবার পুড়ে যাবেনে!
— আরে, কী ঘটনা হইছে শোনো…

নবীনের বউ কাজল বাইরে থেকে খুব সাদামাটা আর রুগ্ন, কিন্তু তার হৃদয়পিঞ্জর মানুষের জন্যে ভালোবাসা আর একটা মানুষের ’পরে অভিমানে টাপেটোপে ভ’রে আছে। সূর্য মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল তবু কাজল কিছু খাবে না, গ্যাসের অসুবিধে কিন্তু ডাক্তার-কবিরাজ করবে না; আধো-অন্ধকার রান্নাঘরে বসে শুধু রেঁধে যায় — পেঁয়াজ ফোড়ন দিয়ে ভুরভুর গন্ধের মুসুরির ডাল, বড়ি দিয়ে কচি লাউডগার তরকারি, গোটা সরষে দিয়ে ডুমো কুমড়োর ছেঁচকি, পোস্তো দিয়ে কড়কড়ে পলতা পাতার বড়া…। কাজলের মেয়ে সুধা সারাক্ষণ পাড়াময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে গলাভর্তি অট্টহাসি নিয়ে। মিন্টুর ঠাকুমা যে বলেছিল, “ও সুদা, শুদা শুদা হাসিস ক্যান”, সেটাই তার এক-লাইনের আত্মজীবনী। সোনাব্যাঙের মতো লাফাতে লাফাতে সবার ঘরে ঢুকে পড়ছে সুধা — কমলাপিসি, আজ কী রাঁধলে গো? মান্তির মা, নিমবেগুন আর পেঁপের ঝোল খেয়ে খেয়ে তোমার অরুচি ধরে না? এক ঘন্টা পরে সে তরকারির বাটি হাতে আবার পৌঁছে যাবে — মা দেছে বিশ্বনাথমামার জন্যি… মা দুঃখীপিসিরে খাতি বোল্লো।

চাঁদকে ছিটে-বেড়ার গেট ঠেলে ঢুকতে দেখে থমকে দাঁড়াল সুধাদিদি :
— কী ব্যাপার, বিদ্যেসাগোর?
— তোমাগো বাড়ি আমার দিদ্‌মা আইছে?
— যাহ, চাঁদের বুড়ি হারায় গেছে!
সুধা পাকা ফুটির মতো ফেটে পড়ল হাসিতে।

দুই
শীতের দুপুরে বাতাস এত ঝাঁঝরা হয়ে থাকে শূন্যতায়, প্রজাপতি উড়তে গিয়ে একটুতেই থ’কে যাচ্ছে। সব উঠোনের রোদ্দুরেই চুলের উকুনবাছা নারীসমাজ দৃশ্যমান। ভক্তবাড়ির পুঁচকে ছেলে কালিদাস ঘেঁটুফুলের ঝোপে নিজের পেছছাপের ধারা দিয়ে ছবি আঁকার চেষ্টায় ব্যস্ত। ফোঁত ক’রে নাক ঝেড়ে রাস্তা দিয়ে আবার ছুটল চাঁদ। এবার বীরেন-ধীরেনের খোলা বাড়ি, মানে দু’হাত অন্তর কচাগাছ পোঁতা নেই প্লটের সীমানা ঘিরে। কয়েক মাস ওদের বাবা মারা গেছে।

আস্তে আস্তে মরে যাওয়াটা কলোনির দস্তুর। যে কাশে, কেশেই যায়; যার হাগা, বারবার গিয়ে বসছে চাড়ি বসানো খাটা-পায়খানাতে। একদিন চাঁদের মা বিকেলে চুল বাঁধতে বাঁধতে বলবে, মালাকারবাড়ির প্রভাতের বুকির রোগডা আবার ঠ্যালা দেছে। ঠোঁট দিয়ে ফিতের একটা দিক চেপে থাকায় কথাটা ভালো বোঝা যাবে না। তারপর একরাতে ভাত খেতে ব’সে গরাস মুখে তুলতে গিয়ে আবার পাতে নামিয়ে রাখবে, “বিরু-ধিরুর বাবা মনে হয়…”। সকালে এবাড়ি থেকে একজন, ওবাড়ি থেকে আর একজন ধীর পায়ে হাজির হচ্ছিল মালাকার-বাড়ির দরজায়। মাতব্বর-গোছের কেউ, প্রায়ই যার নাম বলরাম দাস, চেঁচিয়ে বলছিল, “ওরে বের ক’রে উঠোনে এনে শোয়াও। ঘরের মোদ্দি থাকলি পেরানডা বেরোতি পাত্তিছে না”। শোনামাত্র প্রভাতের বউ কুক দিয়ে কেঁদে উঠেছে। যেন পুজো শুরু হবে কিন্তু দুব্বো তোলা হয়নি মনে পড়ায় কেউ ডেকে আনছে পাড়ার ডাক্তারটিকে। সে আসলে হিন্দি সিনেমার পুলিশ অফিসার, শেষ দৃশ্যে নায়ক ভিলেনকে মেরে পাট-পাট করে দেওয়ার পর হাজির হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত খলনায়ককে হাতকড়া পরিয়ে দেয়।

বাঁহাতের তিন আঙুলে আলগোছে রোগির কব্জি ধরে নিজের কব্জির ঘড়ির দিকে ঠায় তাকিয়ে ছিল তারকডাক্তার। তারপর মাথা নেড়ে ঠোঁট উল্টোয় — ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।

প্রিয় টিম হেরে যাওয়ার শোক বুকে বয়স্ক প্রতিবেশীরা ফিরে আসছিল — মৃত্যুর সঙ্গে ফাইনাল ম্যাচে পরাজয় নিয়ে মাঠ বা রেফারিকে দায়ি না ক’রেই। তখনও বীরেন-ধীরেনের মা উঠোনে উবু হয়ে শবদেহের পরামর্শ নিতে ব্যস্ত। “বাড়িতি চাট্টে পেট, কী করি কও তো! কোইলকাতায় বাসনমাজার কাজ ধরবো? না আড়তে যেয়ে পচা আলু পচা পেঁয়াজ বাছার জোন খাটতি শুরু করি? আড়ত ভালো, দিনিদ্দিন টাকা; কিন্তু তোমার বেয়াই জগন্নাথ সাহা গা পর্‌শো ছাড়া কথা কোতি পারে না। হারামির হাতদুটো জগন্নাথ ঠাকুরির মতোন ঠুঁটো হয়ে যায় না ক্যান!

সুতরাং কলোনিতে বিধবা গিজগিজ করছে। তাদের বরেরা কেন যে এমন আপোষে মরে যায়! চারদিকে সাদা থান আর প্রত্যেক আঁচলের নীচে তিন-চারটে শুকনো কিশোর মুখ। সময়ের অনেক আগে ডিমের খোলা ভেঙে গেছে, তলতলে কুসুম হয় ভ্যান টানছে কাদা রাস্তায়, নয় দাদ-হাজার মলম নিয়ে উঠে পড়েছে লোকাল ট্রেনে। আর বারো-তেরো বছর থেকেই মেয়েদের জিভের নীচে তরল থলি, অপছন্দের শব্দ শুনেছে কি তাক করে নীল থুতু ছিটিয়ে দেবে। যে বাড়িতে দুতিনটে মেয়ে, খবরদার তাদের লেজে পাড়া দিতে যেয়ো না।

(আরও আছে)

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
নিমতিতা সরকারি কলোনি, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৮-১০-২০২২ | ১৩:৪৯ |

    অসামান্য একটি পর্ব পড়লাম প্রিয় কবি চন্দন ভট্টাচার্য দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...