এক
চাঁদের বাড়ি পার হলেই দুপাশে দুই পুকুর, বর্ষায় রাস্তার ওপর দিয়ে ডান পুকুরের জল বাঁয়ে গিয়ে মেশে — বাচ্চাদের জন্যে খুব চমৎকার নদী। এখন বসন্তে শিমূলগাছের মানচিত্র থেকে ব্যাডমিন্টনের ফেদার-ককের মতো ফুল মাটিতে পড়ে থেঁতো হচ্ছে। শীত এলে তাদের ফলগুলো রোয়াঁ-জাগা পেস্তাসবুজ ছোট ছোট হাত-গ্রেনেড — শিরা বরাবর ফেটে গিয়ে তুলো উড়বে। তাছাড়া, নিরাপদ অবতরণের খোঁজে বাতাসে ভেসে বেড়াবে সূক্ষ্ম কাপাস, পেছনে একটা চিমসানো বীজ নিয়ে। ভয়ে কাঁটা হয়ে সেই পথটুকু হাঁটে চাঁদ, কলোনির যে-কোনও বাড়ির দাওয়া থেকে গুরুগর্জিত গলা না শোনা যায়, “আবার হ্যাক্কা মারতে বেরোনো হচ্ছে? এই বাঁদর, বাড়ি যা।”
রেল লাইন পেরিয়ে এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে উঠে মুক্তি! এবং মুক্তিসূর্য রেল কেবিনের মাথায় ঝুঁকে পড়েছে, তার আঁচ কাদায় পড়া ফুটবলের মতোই। এদিকে চাঁদের শার্টের সবচেয়ে নীচের বোতাম ছেঁড়া ব’লে ঘন বাতাসে জামার ঝুল পতাকা হয়ে ওঠে। পুরোনো হাফপ্যান্টটা জলকাচা হতে হতে ছোট হয়ে কুঁচকির কাছে, অথচ শরীর বড় হচ্ছে সেই সংকোচনের বিপরীত মুদ্রায়। বর্ষার জল খাওয়া পটলের মতো সেই অঙ্গকে আঁট জামাপাকড় যেন ক্ষেপিয়ে তোলে; বন্ধুরা দেখতে পেলেই টুং ক’রে আঙুলের টোকা দেবে, শুধু বাড়িতে মা বা সেজদারই চোখে পড়ে না কিচ্ছু।
কাজেই, চাঁদ খুব সাবধান — শার্টের কানাত হাওয়ায় উড়ে তাকে অশ্লীল ক’রে দেবে না তো? মাঠে একটাও মেয়ে-দর্শক নেই ব’লে দুটো দল উদোম দুই গোলপোস্টের কাছে ইস্তিরি-করা জার্সি পাট ভেঙে পরে নিচ্ছে। চাঁদ বীণাপাণি সংঘের সমর্থক হিসেবে তাদের দঙ্গলের কাছেই দাঁড়ায়, ফুটবলাররা পায়ে বল নাচাচ্ছে কাদা বাঁচিয়ে সাইড লাইনের বাইরে, কেমন লোমওলা ভারি থাইয়ের, ঝলমলে জার্সির রাজপুত্র সব; সে একটু দূরে দাঁড়াল আশায় আশায়… বল ছিটকে এদিকে এলে শট জমাবে। অথচ চটিপরা কাঠি-পায়ে প্রাণপণ কিক করলেও শটপুটের মতো সেই মহাস্থবির ফুটবল আস্তে গড়ায় প্লেয়ারের দিকে, উল্টে বলের সেলাই লেগে চাঁদের পায়ের শিরা শুলিয়ে যায়। একটু পরে সে নিজেকে নিজেই গুপ্তচর নিয়োগ ক’রে বিপক্ষ শিবিরে অভিযান করবে, শোনা যাক খেয়ালি সংঘ কী কূটকৌশল আলোচনা করছে। কিন্তু টাকমাথা সিনিয়াররা মাঠে বসে কামিনী-কৌশল নিয়ে ব্যস্ত… “এই বাচ্চা, ভাগ এখানে থেকে”! চোখভর্তি অপমান নিয়ে চাঁদ আবার বীণাপাণিতে ফিরে দেখছিল বিকাশদার গোড়ালিতে সাদা ব্যান্ডেজ, ড্রেস করছে না। ভালোই হল, বিকাশ পাল ঝুলিয়ে দেওয়া প্লেয়ার, বদলে তাদের নিবাধুই কলোনির রোগা-প্যাঁটকা পিকু খেলবে। পুরো ধানি লংকা, শুধু বিড়ি খায় ব’লে বেশি দম পায় না বুকে।
দুই
আস্তে আস্তে মাঠে ছাতাসমাবেশ দ্যাখা গেল — যত দর্শক, তত কালো বাদুড়। চাঁদের মাথা খালি; বাড়ি থেকে আসতেই দিচ্ছিল না, আবার ছাতা দেবে? মোটে মা রাঁধে না, তার তপ্ত আর পান্তা! এদিকে লম্বা বাঁশি দিয়ে ম্যাচ শুরু করে দেয় রতনদা, রোগা কিন্তু শিক্ষিত, তার চুনসুরকি ঝ’রে পড়া বাড়ির সবুজ দরজায় লেখা আছে রতন কুমার দে, এমএ (রিডিং)।
মোষযুদ্ধ লেগে গেল। প্লেয়ারদের গায়ে-ফোস্কা-ফেলা ফোঁস-ফোঁস, গলায় খোমানোর শব্দ আর অনেক দিনের পুরোনো তামাকপাতার মতো ঘামের দুর্বাস বগলে। যখন সাইড লাইনে ছররা কেটে থ্রো ইন বাঁচাচ্ছে, চারপাঁচ জন দর্শকও প্লেয়ারের সঙ্গে পড়ে গিয়ে কাদামাখা। আর বল কর্নার ফ্ল্যাগের দিকে ছুটে গেলে বাকি তিন দিকের দর্শক মাঠে নেমে আসবে ভালো ক’রে দেখার মানসে, ওমনি লাইন্সম্যান হলুদ পতাকা তুলে তাড়া ক’রে যায়। আকাশ থেকে দেখলে — কালো সমুদ্রপাখির ঝাঁক চারকোনা ঢেউ নিয়ে সবুজ ঘাসের ওপর ভাসছে।
ওই আকাশেই চাপ বেঁধে আছে মেঘের গ্রানাইট, একজন খেলোয়াড় একবার মাটিতে গড়ালেই বংশপরিচয় হারাচ্ছে, তখন তাকে অন্য প্লেয়ারের থেকে আলাদা করে কে! তবু তার মধ্যে বীণাপাণির সবচেয়ে বলশালী রাইট আউটের নাম মেথর! সে আসলে এক তরতাজা গয়লা শ্রী বারিদবরণ ঘোষ, কিন্তু মিশমিশে এবং লোহাগড়ন গতরের জন্যে ছোটবেলায় বন্ধুদের কাছে পাওয়া ওই খ্যাপানো নামেই আজ আঞ্চলিকভাবে বিখ্যাত। মেথর গরীব গ্রামবাসীদের বিদেশ বসু, বল নিয়ে কচুগাছের গোড়া ওপড়ানোর মতো ঘোঁত-ঘোঁত স্পিডে গোল লাইন পেরিয়ে চলে যায়… পেছল মাঠে তার দুর্বল ব্রেক আরওই কাজে আসছে না। এই ভাবে হাফ-টাইম জাগল। যে খেয়ালি সংঘকে বীণাপাণি যেখানে পাবে হারাবে, সে এখনও গোললেস করে রেখেছে। ভাবনার ব্যাপার!
মধ্যান্তরে মাঠে প্রচুর খোসাবাদামওলা সক্রিয় হয়ে ওঠে, ঘটিগরম ঘুরে ঘুরে হাতেগেলাসে ঝকর-ঝকর ঝাঁকুনি দেয়। কাঁচা পেঁয়াজের গন্ধ আর বাদামের খোলা ভাঙার পুট শব্দে বাতাসে ঝিম। চাঁদের হাতে পয়সা নেই, জিভে জল আছে শুধু। সে জীবনে কোনও একদিন পুরো দু’টাকার ঘটিগরম কিনে বাঁহাতে খুব সাবধানে ঠোঙাটা ধ’রে (একটা দানাও পড়ে না যায়) ডানহাতে ঢেলে ঢেলে মাঠের ফাঁকায় ব’সে খাবে। রাক্ষস ছোড়দা বা হ্যাংলা বোনটা — কেউ ধারেকাছে নেই তখন।
ভালো কথা, পিকুকে আজ খেলানো হবে না-ই ঠিক ছিল; সেভেন-এ-সাইড ম্যাচেই ও চলে, পায়ের কাজ ধুয়ে কি জল খাবো, এসব মাঠে ডিফেন্স এক টিক মারলেই পিকুকুমার চিৎ। এখন প্রথমার্ধে ড্র হওয়ার পর তাকে ঢলঢলে জার্সি প’রে সাইড লাইনে ছুটতে দেখা গেল। খেয়ালি সংঘের স্টপাররা নাকি কোনও ফরোয়ার্ড এগিয়ে এলেই তুড়ে মুখ খারাপ করছে, শুনে মাথা গরম ক’রে বার পোস্টের ছ’হাত ওপর দিয়ে মারছে বীনাপাণি। সরকারি কলোনির ছেলে পিকুর খিস্তিতে পুব-পাকিস্তানের আন্তরিকতা, কিন্তু সে মা সরস্বতীর ক্লাবের হয়ে প্রথমবার নেমে অশৈলী কিছু করল না। হাফ টাইমের পর নিজেদের হাফ লাইনের কাছে ফ্রিকিক পেয়েছে খেয়ালী, ওদের পেটমোটা ব্যাকি অপরেশদা বল জায়গায় বসিয়ে মোশান নিতে পিছিয়ে গেছে খানিক, পিকু আনমনে বলের কাছে দাঁড়িয়ে, অপরেশদা ছুটে এসে শট নেওয়ার আগের সেকেন্ডে সে বুটের এক টোকায় বল সরিয়ে দিল। ব্যাকির শটটা ফলস হয়ে গেল পুরো, ভারি শরীর ফুট তিনেক শূন্যে লাফিয়ে উঠে “বাবা রে” ব’লে দড়াম ক’রে মাটিতে।
(আর একটু বাকি)
loading...
loading...
অসাধারণ লিখন।
loading...