বাংলাভাষার জনয়িত্রী

এক
আমার শিক্ষক বাবা সংস্কৃত, বাংলা আর ইংরাজি তিনটে ভাষাতেই ছন্দোবদ্ধ কবিতা লিখতেন। ক্লাস এইট-নাইনে পড়ি, কবিতার নামে আমার দুর্বল মকশোকাজ শুরু হল আর তক্ষুনি বাড়িতে বিদ্রূপ-নাম জুটে গেল — কপি। কে দিলেন? কে ডাকতেন সবচেয়ে বেশিবার সেই নামে? বাবা।

কবি একটা হাস্যকর, অপদার্থ উপাধি। বাংলায় সবচেয়ে বেশি কবি — তবু এবং সেই জন্যেই। কবিরা মোটামুটি দেখতে ভালো হয় না, অসুস্থ, অপরিচ্ছন্ন খুব খারাপ জামাকাপড়ের। তারপর একগাদা বাউন্ডুলে, মানসিক সমস্যাগ্রস্ত, সবজান্তা, ইগোপ্রিয়, ভনিতাপূর্ণ বিনয়ী, বিশ্বাসের মর্যাদা না রাখা নেশাড়ু বুড়ো কিম্বা বুড়ি (কবি বনতে বনতে প্রায় সবারই যৌবন ঢলে যায়)। কিন্তু কবির সবচেয়ে বেশি যা নেই তা টাকাপয়সা। কবিরা মূলত ভালো চাকরি করে না (উল্টোটাও বলতে চেয়েছি), রোজগার করলেও বড়লোক হয় না, প্রেম পেলেও ধরে রাখতে পারে না অথবা আমার এই হেরে যাওয়াতেই আনন্দ।

নিজের সম্পর্কে কবির ধারণা ওপরে যা লেখা হল, তার চেয়েও বহু ভয়ানক খারাপ। সে লিখতে ব’সে ভাবে মেয়েটাকে পড়তে বসানো উচিত ছিল, বাবাকে ডাক্তারখানায়, অতি-আবশ্যক ছিল একটা ওয়াক-ইন ইন্টারভিউয়ে হাজিরা। অন্তত বর-বউ-প্রেমিকা-প্রেমিক-সন্তান-বন্ধু-আত্মীয়-পাড়ারচায়েরদোকানের পিঠে ঠেস দিয়ে ব’সে কিছুক্ষণ আজুড়ে গল্প আর হাসাহাসি। কিন্তু আদতে এসবের কিছুই করে না এবং আস্তে আস্তে সমাজ ও পরিবারের আলোবৃত্তের বাইরে বেরিয়ে যায়।

সিনেমার নায়ক মেয়েকে নায়িকা তৈরিতে প্রাণমন ঢেলে দিয়েছে, উকিল চায় ছেলে অ্যাডভোকেট, নেতার ফ্যামিলি জন্মেই হাফ-নেতা, গাইয়ে বুলি ফোটার আগে সন্তানকে রেওয়াজে বসিয়ে দিল… একমাত্র, একমাত্র কবি ঘুণাক্ষরেও চাইবে না আত্মজ ধারেকাছে যাক তার প্রবৃত্তির। কবির খুব মিল সমাজবিরোধীর সঙ্গে। খুনি তোলাবাজ মস্তানদেরও স্বপ্ন থাকে ছেলেমেয়ে মস্ত চাকরি পেয়ে সমাজে বাঁচবে মাথা উঁচিয়ে।

এই আত্মঅবমাননা কবির সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞান। আমার বাবা নিশ্চয়ই ভেবেছেন, কবিতা না লিখে টুইশানি করলে সংসারে দুটো বাড়তি পয়সা আসত। আমাকে বাঁদর ডাকার ভেতর দিয়ে নিজের প্রতি অমর্যাদাবোধকেই প্রতিষ্ঠা দিতেন তিনি।

দুই
গ্রামে ওরা রাত বারোটায় নিষ্মানুষ রেলস্টেশানের পাথুরে বেঞ্চিতে, বিকেল পাঁচটায় নদীর পাড়ের বালিমাটিতে চপ্পল পেতে ব’সে, সকাল সাড়ে ছ’টায় বন্ধুর বাড়ি উদয় হয়ে কবিতা পড়ে। আর শহরে ভাঙা ঝুরঝুরে চায়ের দোকানে জড়ো হয় সন্ধেয় অশথগাছের ডালে পাখির গুনগুনের মতো। আমি পাশ দিয়ে এক পলক তাকিয়ে যেতাম আর আশ্চর্য লাগত — মানুষ এমন দীনতার সাধনায় লেগে থাকতে পারে প্রজন্ম ধ’রে! কী তার ইন্ধন? কালোকুষ্টি চা আর তামাক-এ খিদেকে হারাতে না পারলে কাঁচা ত্যাকতেকে হাফপাঁউরুটি-টোস্ট। নিজেদের সব রঙ এরা ঢেলেছে ভাষার গায়ে; ভাষা — যা ছাড়া আমরা ভালোবাসতে পারব না, আঘাত করতে পারব না, দুটো খেতেপরতে পাবো না… ইঁটভাঁটার চিমনির মতো নিঃসঙ্গ। কবি পোষ্য হয়ে পাহারা দিচ্ছে আর গর্ভধারিণীর মতো জন্ম দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। মুখের আর লেখার ভাষা ক্রমাগত নিজেদের মধ্যে জায়গা বদলিয়ে আক্রমণে উঠছে সবরকম শয়তানির বিরুদ্ধে।

যে কবিকে পড়িনি কোনওদিন, নামও শুনিনি যার, সেও অসাড়ে আমাকে ভাষা যুগিয়ে যায়। এই সূত্র বাজার-অর্থনীতির চেয়ে অনেক জটিল ও নিয়ন্ত্রণ-অযোগ্য। শিল্প নিয়ে ব্যবসা অথবা কমার্শিয়াল সাহিত্য-পত্রিকার ধারণাকে সফল করা হল অন্ধ রাইফেল শ্যুটারের অলিম্পিকে সোনার মেডেল। কেননা, একজন কবি সব দিকেই গুলি চালিয়ে দিতে পারে। তার সাহিত্য-কার্তুজ কোচ, সহপ্রতিযোগী, বিচারক, ট্যুর্নামেন্ট কমিটির চেয়ারপার্সন, দর্শক…যে কোনও বুকে বিঁধে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।

যে প্রাণী যত ভয়ংকর, তার সন্তানের বেঁচে থাকাও তত বিপদসংকুল। তাই এটা আশীর্বাদের মতো যে, কবির রিচ খুব কম (ফেসবুকে যতই বন্ধুসংখ্যা বাড়িয়ে যাও না কেন)। দ্বিতীয়ত, নিট মদে সোডা মেশানোর কাজে কবি আর মেজরিটি পাঠকের মাঝখানে সংস্কৃতি নামের একটি বাফার নিরত রয়েছে। মাংস রান্নার সময়ে পাঁঠার হাড়ের ভেতরের মজ্জা যেমন কিছু লঘু হয়ে ঝোলের মধ্যে মেশে, তেমনি সংস্কৃতিও কালে কালে কবিলেখকের সাহিত্যের সহজতর আর জনপ্রিয়তার কাছাকাছি থাকা অংশকে নিজের তরলতায় টেনে নেয়। লেখার সারভাগ সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হতে আরও সময় লাগবে। হয়তো বা হবেই না। সাধারণ মানুষ সংস্কৃতির প্রভাব আর নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা মিশিয়ে তার ভাষা নির্মাণ করে। সেই ভাষাকে আশ্রয় করে কবি। তাকে পালটায়। আবার ফেরত পাঠায় সংস্কৃতি মধ্যস্থের ভেতর দিয়ে।

কবি তার সারাটা জীবন বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে। ক্ষমতার সামনে দাঁড়িয়ে বুকের কাছে করজোড় তুলে আনেনি। সে সমাজকর্মী নয়, এবং কবিকে ‘সাহসী’ ব’লো না, ‘বেশিবেশি’ বলতে পার। ভালোবাসা, দুঃখ, সাহস, ভয়… সবই অধিক পরিমাণ। সবচেয়ে বড় তার উদাসীন। সে খ্যাতিকে মঞ্চকে সাফল্যকে অর্থকে করে উদাসীনতা, নিরাসক্তি করে। পয়সাচেতা সম্পাদক প্রকাশক এক-ধারসে ঠকিয়ে যাচ্ছে; আমি উদ্বৃত্ত মূল্যের আলোচনায় গেলাম না, প্রতিশ্রুত সংগ্রহমূল্য-ই ঝেড়ে দেওয়া হয়; কবির সাহায্য তবু পরোক্ষ এবং চিরপ্রসারমান। সাহিত্যই পুঁজি; সেই মূলধন বিস্মৃতির ফিক্সড ডিপোজিটে পড়ে থাকলেও প্রতি মাসে যে স্বয়ংক্রিয় সুদ পাঠায় আমাদের দিনাতিপাতের সেভিংস অ্যাকাউন্টে, তাই সংস্কৃতি। ৯৯ ভাগ মানুষের চেতনার খাদ্য সংস্কৃতি, সাহিত্য নয়। মাকে সে চেনেই না, জানে সন্তানকে। আবার বলি, ইহা আশীর্বাদ। কবিকে জনতা মাথায় তুলে নাচছে না বলেই তার পঞ্চাশ বছর আগে লেখা পংক্তিতে টোকা দিলে আজও রক্তচিহ্ন ফুটে ওঠে।

কবিকে দেখলে আমরা যেন বুঝি সে কাকপুচ্ছ ময়ূর, ভেড়ার ছাল প’রে থাকা মৃগরাজ। তার চেয়েও যেন বেশি করে জানতে পারি — যে কবিতালেখা মেয়ে ভুল সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে আত্মহত্যা করল, যে অর্ধেক-পাকা-দাড়ি উনপাঁজুরে লোক নড়বড়ে অন্ধকার টেবিলে বসে নিজের লেখার প্রুফে ছুরি চালাচ্ছে — ওরা মা, বাংলাভাষার।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. ফয়জুল মহী : ০৪-০৩-২০২১ | ১:৫৪ |

    অসাধারণ ,শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইল,

    GD Star Rating
    loading...
  2. মুরুব্বী : ০৪-০৩-২০২১ | ৮:১৮ |

    আলোচিত লিখাটি শব্দনীড়ের আর্কাইভে সম্পদ হয়ে থাক।
    ধন্যবাদ প্রিয় কবি চন্দন ভট্টাচার্য। আমাদের শুভেচ্ছা জানবেন। শুভ সকাল। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...