শত্রুই ঈশ্বর

আমরা জানি বাঁচতে গেলে বেশির ভাগ মানুষের যতখানি বন্ধু লাগে, ততটাই শত্রুর দরকার হয়। নিজেকে ভালো বা ঠিক প্রমাণ করার আগ্রহ আমাদের অপরিসীম, এবং ভালো-খারাপ একটা তুলনামূলক বিচার। কাজেই, এই ‘আমি’টি অন্যে খারাপ প্রমাণিত না হলে নিজের ভালোত্বকে প্রতিষ্ঠা করতেই পারবে না। খারাপ কখন শত্রু হয়ে যায়? এমনি এমনিই হয়, অথবা যখন সে নিজের কথা বলে। আমাদের সহজ শত্রু কে? যার আমার চেয়ে আলাদা গায়ের রঙ, ভাবনা, ভাষা, জাত, ধর্ম, রাজনীতি…। এই ‘ভিন্ন’ লোকজন, মানে যাদের সে তলিয়ে চেনে না এবং চিনতে চায়ও না, তাদের পাশ কাটিয়ে বেশির ভাগ মানুষ নিজেরমতো-দের সঙ্গে থাকে। মজা হল, উল্টোদিকে যে তার সঙ্গে মেলামেশা করতে রিফিউজ করছে, তাকেও শত্রুপর্যায়ের ব’লে ধরে নেয়।

আমরা আমাদের উন্নতির জন্যে নিজের ধর্মের ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, পুজো দিই; কিন্তু নিজের সমস্যা বা অবনমনের জন্যে কখনও ঈশ্বরকে দায়ি করি না। দায়ি করি মানুষকে, আমার শত্রু মানুষকে। সেদিক থেকে, শত্রু = ঈশ্বর।

সাফল্য খুঁজে না পাই যদি, তবে শত্রু খুঁজে পাওয়া দ্বিতীয় সাফল্যের মতো। এতে মন সক্রিয় হয়, উদ্দীপনা ফিরে আসে। কোনও রাজনৈতিক দল বা ধর্মীয় গুরু যদি বলে দেয়, এই লোক বা এই সম্প্রদায়ের জন্যে তোমার চাকরিটি হচ্ছে না, তার মানে সেই দল বা গুরু আমাকে ইষ্টসিদ্ধির দরজায় দাঁড় করিয়ে দিল। অর্থাৎ, শত্রু = সফলতা। (“বন্ধুত্ব করে সাফল্য অর্জন করুন” এই প্রতিশ্রুতি আপনি শুধু এসকর্ট সার্ভিসের বিজ্ঞাপনেই দেখতে পাবেন)।
শত্রু না থাকলে কার মাথায় নিজের ব্যর্থতার বোঝা চাপাবো, অথবা, কে হবে আমাদের ক্ষমতার সিঁড়ি!

এন-ব্লক বা চাঁই হিসেবে শত্রু খোঁজার ইচ্ছেই মানুষকে অবমানব করে তোলে — ধর্মে হোক, কি রাজনৈতিক দর্শনে। যখনই সে কোনও ব্যক্তিকে দেখছে, ভাবছে কোন চাঁইয়ে বসাবো — শোষক, শোষিত, নারীবাদী, মৌলবাদী, দেশভক্ত, দেশবিরোধী, তৃণমূল না সিপিএম…? তারপর নিজেরটা বাদে অন্য সব চাঁইয়ের বিরুদ্ধে অ্যাকশান শুরু করো। গত কয়েক বছর আমাদের দেশে সবচেয়ে আলোচিত ব্লকের নাম মুসলমান। ভারতবর্ষের সব অসুখের কারণ হিসেবে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে চরম গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। এভাবেও বলা যায় যে, এই মুহূর্তে ভারতীয় হিন্দুরাই হল মুসলিম সম্প্রদায়ের জনপ্রিয় ব্র‍্যান্ড অ্যাম্বাসাডার।

আমরা ধর্ষক বা হত্যাকারীর নাগরিকত্ব মুছে দিতে চাই না। সংখ্যাগুরু শ্রেণীর লোক অপরাধে জড়ালে দেখতে যাই না তার ধর্ম। অথচ একই কাজের জন্যে সংখ্যালঘুর সঙ্গে তার কমিউনিটিকে জুড়ে দিই। ফলে যে স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসে তা হল : একটা সম্প্রদায় সামগ্রিকভাবে বেআইনি কাজে, রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধাচরণে এবং স্বাভাবিক জনজীবনকে ধ্বংস করার চেষ্টায় গোপনে ও খোলাখুলি নিযুক্ত আছে।

এটা সামাজিক স্কিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ। ক্রাইমের পেছনের আর্থসামাজিক কারণ ভুলে গিয়ে এক কাল্পনিক জিনবিজ্ঞানের জন্ম দিয়ে আমরা স্কিজোফ্রেনিক। যে নিজের ভেতর থেকেই আক্রান্ত তার পক্ষে আসল আক্রমণকারী কে তা বোঝাও সম্ভব নয়।

তবু গুহার মধ্যে একটা আলোও তো জ্বলছে। সংখ্যাগুরুর সংখ্যাগুরু অংশের এই মনোভাব সংখ্যালঘুর ক্ষমতায়নেরই একটা রাস্তা খুলে দেয়। গুরুর শত্রুপ্রচারের ভেতর দিয়েই এই এমপাওয়ারমেন্ট ঘটাতে থাকে। এর ফলে লঘুরা সচেতন ও প্রতিবাদী হবে, মেজরিটির একটা অংশ খুলে এসে লাগবে তার গায়ে। অলস জলধারাকে চাপ দিয়ে দূরগামী ফোয়ারা করে তুললে দেশ ও গোটা পৃথিবীর নজরে পড়বে তাদের সমস্যাগুলো। গত কিছুদিন ধরে মনে হচ্ছে না, আমাদের দেশে শুধু মুসলিমরাই বাস করে অথবা তারাই প্রধান সমাজ? বুদ্ধিজীবী, ছাত্র বা সাধারণ মানুষ শুধু তাদের হয়েই কথা বলছে? মিডিয়ায় শুধু তাদেরই আলোচনা এবং বাকি ভারতবর্ষ ভ্যানিশ করে গেছে! শত্রুরাজনীতি ভারসাম্য হারিয়ে নিজেকেই অপ্রাসঙ্গিক করে তোলার এই বিরল ক্ষমতাটি ধারণ করে।

তাছাড়া এদেশের সংখ্যাগুরু কি চাইতে পারে মুসলমানহীন দেশ? কক্ষণও না! লঘু যদি না-ই থাকে, তবে দিনরাত কার নামগান করবে সে, কাকে অমিত শক্তিশালী ভেবে ভয় পাবে? নিজের ব্যর্থতা আর অপারগতা থেকে তৈরি দুঃখরাগঅজুহাত নিশ্চিন্ত মনে সমর্পণ করবে কার পায়ে?

শত্রুই তো ঈশ্বর।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৫ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ৫ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ৩০-১২-২০১৯ | ১৪:৩১ |

    আমরা আমাদের উন্নতির জন্যে নিজের ধর্মের ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, পুজো দিই; কিন্তু নিজের সমস্যা বা অবনমনের জন্যে কখনও ঈশ্বরকে দায়ি করি না। দায়ি করি মানুষকে, আমার শত্রু মানুষকে। সেদিক থেকে, শত্রু = ঈশ্বর। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
  2. সাজিয়া আফরিন : ৩০-১২-২০১৯ | ২০:৪৬ |

    বাঁচতে গেলে বেশির ভাগ মানুষের যতখানি বন্ধু লাগে, ততটাই শত্রুর দরকার হয়। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
  3. সুমন আহমেদ : ৩০-১২-২০১৯ | ২১:১৪ |

    অসাধারণ আলোচনা কবি চন্দন দা। শেখার বিষয় আছে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
  4. রিয়া রিয়া : ৩০-১২-২০১৯ | ২৩:০০ |

    হুম। তারপরও অনেক অনেক শুভেচ্ছা প্রিয় কবি দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
  5. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ০১-০১-২০২০ | ১৩:৩২ |

    প্রাণঢালা ভালোবাসা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif​​​​​​​

    GD Star Rating
    loading...