যৌথখামার আর হাফ রাইটিং
ফেসবুকের শুরুতে বন্ধুদের অনেকে বারণ করেছে – এটা চ্যাট আর গসিপ করার জায়গা, একটাও সিরিয়াস পাঠক নেই, লেখা পোস্ট করা মানে সেগুলোর বেইজ্জতি!
ভাবতাম, ফেসবুক যদি সামাজিক আন্দোলন ট্রিগার করতে পারে তবে সাহিত্যের আধারপাত্র হতে মুশকিল কোথায়? তাছাড়া, পৃথিবীর সব গোল গর্তে চৌকো স্ক্রু একমাত্র আমিই – মানা যাচ্ছে না! আরও কিছু মক্কেল থাকবে ঠিক – বর্ষায়-ভাসা পুকুরের কইমাছ, যারা গন্ধ শুঁকে শুঁকে এখানেই নির্ভুল জড়ো হয়েছে।
কাট টু…
দার্শনিকদের মধ্যে স্ল্যাভয় জিজেক-এর ইমেজ অনেকটা ধর্মগুরু হিসেবে ওশো বা সাহিত্যিক হিসেবে হারুকি মুরাকামির মতো – কেউ মাথায় তুলে রাখেন তো কারও মতে পপুলিস্ট, অ্যাক্কেবারে সময় নষ্ট!
জিজেকের ওপরে অনেকগুলো তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছে, তার একটা ‘দা পারভার্ট’স গাইড টু ইডিওলজি’। সেখানে চমৎকার সব কথাবার্তা বলেছেন – “আমরা ইডিওলজি-উত্তর সমাজে বাস করি। ‘ইডিওলজি’ লেখা একটা ট্র্যাশ ক্যান থেকে খাবার কুড়িয়ে কুড়িয়ে খাচ্ছি সবাই” – ইত্যাকার।
কিন্তু জিজেক হেসে ফেলেন, তার ছোটো ছোটো সাজানো দাঁত দেখা যায় একবারই, যখন ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে কোট করছিলেন – প্রসঙ্গঃ কিছুদিন আগে লন্ডনের কালো, ঘেটোবাসী জনতা কর্তৃক বাড়িঘরে ভাঙচুর করা, দোকানপাটে আগুন লাগানো। ডেভিড ক্যামেরন বলছেন, “ঠিক আছে, ওরা লোকজনকে ধরে ঠ্যাঙাচ্ছে বা বাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু সত্যিকারের ভয়াবহ জিনিস হল, দোকান থেকে মালপত্র নিয়ে চলে যাচ্ছে দাম না দিয়ে!”
জিজেকের অবাক উপলব্ধি, “এটাই যেন সেই সর্বোচ্চ পাপ যা মানুষ কল্পনায় আনতে পারে!… তাহলে আদর্শ, ন্যায়বিচার, সাম্য, এরা সব ভেঙে পড়ল, আর যা থেকে গেল তা বিশুদ্ধ কনজিউমারিজম?”
কাট টু…
আমি ভেবেছিলাম, যেভাবে মেট্রো রেলে মোবাইলের টাওয়ার কাজ করে না, যোগাযোগ-মাধ্যমগুলোর ভেতরে কোথাও একটা শিল্পতালুক (শিল্প মানে আর্ট) তৈরি করা চাই যেখানে বাজারনীতি ব্যর্থ হবে। ব্লগ বা ফেসবুকের মতো ব্যক্তিগত মিডিয়াগুলো সেই সুযোগ এনে দিয়েছে, এক পূর্বশর্তহীন সাহিত্যদর্শনের জন্ম দেওয়ার সুযোগ।
দেরিদার “অফ গ্র্যামাটোলজি” থেকে জানা যাবে — জাঁ জাক রুশো তার গ্রন্থ ‘কনফেশন’-এ ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে লেখক হলেন। “তার লেখার দিকে যাত্রা হল একরকম অনুপস্থিতির সাহায্যে; এবং যে উপস্থিতি কথ্যভাষা নিয়ে নিরাশ (disappointed), তাকে একরকম হিসেব ক’ষে মুছে দেওয়ার ভেতর দিয়ে”। রুশো বিশেষজ্ঞ স্টারোবিনস্কি মূল্যায়ন করছেন, “নিজের সত্যমূল্য অনুযায়ী নিজেকে প্রকাশ করা থেকে লেখককে যা আটকে দেয়, সেই ভুল বোঝাবুঝি কীভাবে অতিক্রম করবেন তিনি? শক্তিহীন (impoverished) কথার বিপদ থেকে কীভাবে বাঁচবেন একজন লেখক? …আর কী উপায়েই বা নিজেকে প্রকাশ করবেন? জাঁ জাক বেছে নিলেন অনুপস্থিত থাকা আর লেখাকে। আত্মবিরোধী (paradox) মনে হতে পারে — তিনি নিজেকে লুকিয়ে ফেলবেন নিজেকে আরও ভালোভাবে দেখাবেন বলে। এবং নিজেকে সীমাবদ্ধ করে নেবেন লিখিত কথার মধ্যে”।
এবার রুশো থেকে সরাসরিঃ “আমি সমাজকে অন্যদের মতোই ভালোবাসব, যদি না আমি নিঃসন্দেহ হই যে (এর ফলে) নিজেকে শুধুমাত্র একটা অসুবিধে হিসেবে দেখানো নয়, আমি নিজে যা তার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা হিসেবে দেখাব। লেখা এবং নিজেকে লুকোনোর যে ভূমিকা সেটা সংক্ষেপে আমার পক্ষে মানানসই। আমি যদি উপস্থিত থাকি, কেউ জানবে না আমি কতখানির যোগ্য”।
ওপরের আলোচনাটা আদতে ছিল কথ্য আর লেখ্য ভাষার তুলনা নিয়ে যেখানে রুশো, হাইডেগার, দুক্লোস, সসুর ইত্যাদিরা মুখের ভাষাকে এগিয়ে রেখেছেন, আর দেরিদা তার সিন্থেসিসের শেষে লেখার ভাষাকেও দিচ্ছেন সমানের গুরুত্ব। কিন্তু আমাকে ভীষণ মুগ্ধ করেছিল রুশোর প্রতিবেদন। লেখকের লুকিয়ে থাকা জরুরি, আবছা হয়ে থাকা; এটা খুব মানি আমি। কোকিলই যে বসন্ত, তার বড় কারণ ওকে দেখা-ছোঁয়া যায় না। সুরই কুহুর সবকিছু — সাড়া-প্রতিক্রিয়া, দেনা-পাওনা, অর্থ-অর্থহীনতা, প্রেম-পরাজয় আর এর হাইফেনচিহ্নের ভেতরে বাইরে চারপাশে যা যা আছে।
ভার্চুয়াল মিডিয়ায় আমি আর পাঠক-পৃথিবী মুখোমুখি, অথচ সামনা-সামনি নেই; তাই নিজের পরিচয় লেখার মধ্যে বা বাইরে বা বাইরের পরেও একই থেকে যাচ্ছে। পড়ুয়াই তো ইনফর্মার যার ভেতর দিয়ে হাত বাড়িয়ে লেখাকে স্টেশানে পৌঁছনোর আগে থামিয়ে বা রাস্তা ঘুরিয়ে দেয় বাজারনীতি। তাই আপাত-উপস্থিতির ভেতর একই সঙ্গে অ্যাবসেন্স আর প্রেজেন্স ধরা থাকল।
কাট টু…
এদিকে “আকাঙ্খার জন্যে আকাঙ্খাকেই আকাঙ্খা বলে”, জিজেক জানিয়েছেন। কোক খেয়ে আমাদের তেষ্টা মেটে না, বেড়ে যায়। তার মানে, লেখাকে লাভজনক হয়ে ওঠার লক্ষ্য থেকে সরিয়ে দিলেও এমন নয় যে সে চাহিদা-যোগান বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারবে। বাধ্যবাধকতা থেকে যায়, মুখাপেক্ষিতা। পকেটে টাকা না থাক, মনে ডিজায়ারের মৃত্যু ঘনাবে না! কনজিউমারিজম থেকে ছুটকারা যদিও বা পাও, ভোগ্যপণ্যবাদের দর্শন থেকে মুক্তি নেই।
বাজার চাহিদা-যোগানের ‘পরে দাঁড়িয়ে আছে — এই ভাষ্যও তাহলে আধা সচ্! সাপ্লাই-ডিম্যান্ডের আরামচেয়ার আসলে পাতা ইডিওলজির ওপরে, যে আদর্শের ‘দানা’ আমাদের শুরুতেই ‘খাইয়ে’ দেওয়া হয়েছে।
হয়তো এই জন্যেই ফেসবুকে মোটের ওপর প্রতিক্রিয়ার ঢেউ বইতে দেখি — রাজনীতিতে সিপিএম-এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া, নয়তো তৃণমূলের বিরুদ্ধে। জাতীয়তাবাদে হয় ভারত নয় বাংলাদেশের পক্ষে, ধর্মে হিন্দু নতুবা মুসলমান, ঠিক যেমন ফুটবলে ব্রাজিল কিম্বা আর্জেন্টিনা। বাইনারির কোনও একটা বাহুতে দাঁড়িয়ে অন্যের দিকে লেখা ছুঁড়ে দেওয়া যা পূর্ণিমার সাতদিন আগের আকাশের মতো…আধখানা।
আনকাট
এই গোটা লেখাটাই নিজের জন্যে, নিজের বিরুদ্ধে।
স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন ছিল, কিন্তু “extreme violence of liberation”-কে কবজিতে বেঁধে নেওয়ার সাহস কোথায়?
কোথাও মুনাফার ছোঁয়া না থাকুক, ইনভেস্টমেন্ট-রিটার্ন জুটির হাত ধরে ঘুরপথে দ্যাখো সেই চাহিদা-যোগান ব্যবস্থাই তো ফিরিয়ে আনছি ফেসবুকে। নিয়ম করে খিচুড়িভোগও বানানো! বাজারের লেখক একলাখ পাঠকের জন্যে খুন্তি নাড়ে, আমিও একই নিয়মে তিরিশ জনের পাতে খাবার তুলে দিই — নিজেই নিজেকে লেখার ফর্দ ধরিয়ে দেওয়া সাহিত্যরাঁধুনি।
loading...
loading...
অসাধারণ নিবন্ধ। ফেসবুক যদি সামাজিক আন্দোলন ট্রিগার করতে পারে তবে সাহিত্যের আধারপাত্র হতে মুশকিল কোথায়? ঠিক তাই।
loading...
"কোকিলই যে বসন্ত, তার বড় কারণ ওকে দেখা-ছোঁয়া যায় না। সুরই কুহুর সবকিছু — সাড়া-প্রতিক্রিয়া, দেনা-পাওনা, অর্থ-অর্থহীনতা, প্রেম-পরাজয় আর এর হাইফেনচিহ্নের ভেতরে বাইরে চারপাশে যা যা আছে।" অকপটে আপনার প্রশংসা করলাম চন্দন দা।
loading...
এমন লেখার তুলনা হয়না দাদা।
loading...
কাট টু কাট এবং আনকাট। বাস্তবতা।
loading...
সুন্দর।
loading...