নারীবাদের সাদাকালো

[Ev’ry leaf, and ev’ry whispering breath
Convey’d a foe, and ev’ry foe a death
ওলাদা একুইয়ানো (১৭৪৫-১৭৯৭) একজন
নিগ্রো দাসের লেখা কবিতা]

যদি কোনও মেয়েকে গভীর ঘুম থেকে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে জিগ্যেস করো, তুমি কে — একজন কালো মেয়ে বলবে ‘আমি কালো মেয়ে’, একজন সাদা মেয়ে শুধুই ‘মেয়ে’, বা তাদের কেউ ‘লেসবিয়ান’; কিন্তু কেউই নিজেকে ‘সাদা মেয়ে’ বা ‘সাদা মানুষ’ বলবে না।

ফেমিনিজমের টুকরো না হওয়ার সমস্যাও এখান থেকে শুরু হয়। ‘রেডস্টকিংস’দের ঘোষণা, যা নারী-আন্দোলনের প্রথম ম্যানিফেস্টোগুলোর একটা, বলেছিল — পুরুষরা মেয়েদের দমন করে আর অল্প কয়েকজন পুরুষ দমন করে বাকি সবাইকে। এই বিশ্লেষণে দুটো সম্ভাবনার কথা ধরা হয়নিঃ সাদা মেয়েরা শোষণ করতে পারে কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেদের আর, সাদা ও কালো মেয়েদের মধ্যে জাতিগত দ্বন্দ্বের একটা যথেষ্ট ভূমি রয়েছে।

একদিকে নারী-আন্দোলনের প্রধান ধারা, যা অবশ্যই শ্বেতাঙ্গ নারী অধ্যুষিত, বলেছে যৌনতা জাতিবাদের চেয়ে অনেক মূল বিভাজন আর পুরুষ-নারী সম্পর্ককে একান্তই ‘সেক্সুয়াল পোলিটিক্স’-এর যুক্তিকাঠামোয় বিধৃত করেছে; অন্যদিকে কালো মেয়েরা (অস্তিত্ববাদী ডিকশান ব্যবহার করা যাক) ‘doubly the other’, কেননা তারা যুগপৎ যৌন ও জাতিগত অদৃশ্যতায় ভুগছে। আরও স্পষ্ট বললে, কালো মেয়েদের আগাগোড়া আক্রমণ করে গেছে এই ত্রিশূল সমস্যাঃ কালো পুরুষের যৌনবাদ, সাদা মেয়ের জাতিবাদ আর সাদা পুরুষের জাতি-যৌন রাজনীতি। এর পরিণতিতে ওরা অবিশ্বাসী আর হোস্টাইল হয়ে উঠেছে শ্বেতাঙ্গ মেয়েদের বিষয়ে আর এই Bad Faith জন্ম দিয়েছে এমন ধারণার যে নারীমুক্তি আন্দোলন হল সাদা মেয়েদের ব্যাপারস্যাপার।

এই বিরোধ মেটাতে গিয়ে মেইনস্ট্রিম (সাদা) নারীবাদীরা কিন্তু স্ববিরোধী বক্তব্য রাখছে। ‘সাদা মেয়েদের নারীবাদ’-এর ধারণাকে ‘ছেলেদের সমাজতন্ত্রে’র মতো হাস্যকর বলার পর তাদের বক্তব্যঃ নারী-পুরুষ আর সাদা-কালো এই দুই শোষণের মধ্যে প্রথমটার অস্তিত্ব এই পুরুষ রাষ্ট্রগুলো স্বীকারই করে না, যেখানে পরেরটা সম্পর্কে অপরাধবোধে ভোগে। কাজেই নারীবাদী আন্দোলন আক্রমণের লক্ষ্য করবে যৌনরাজতন্ত্রকেই। নাহলে নারীবাদীদের তো বামপন্থী বক্তব্যকেই সমর্থন করা হল, যারা বলে যৌনতা-বিষয়ক ইস্যুগুলো অপেক্ষা করুক যতদিন জাতি আর দারিদ্র্যের সমস্যা না মেটে [বামপন্থী অ্যাঞ্জেলা ডেভিস-এর বই ‘উইমেন, রেস অ্যান্ড ক্লাস’]। শ্বেতাঙ্গ নারীবাদী এলেন উইলিস যৌন আর জাতিগত সমস্যার মধ্যে প্রায়রিটির প্রশ্নকেই অস্বীকার করেছেন এই ব’লে যে ‘Insistence on hierarchy of oppression never radicalizes people because the impulse behind it is moralistic’ [প্রবন্ধ ‘সিস্টারস আন্ডার দ্য স্কিন?’]।

কিন্তু যৌনশোষণকে শ্বেতাঙ্গ নারী-আন্দোলনে প্রধান গুরুত্ব দেওয়া মানে তো তাকে পূর্ববর্তিতা দেওয়াই। আর নারীবাদী আন্দোলনের মূল ধারা কখনও নৈতিকতার সীমা ছাড়ায় কি? কীভাবেই বা এরা কালো মেয়েদের নিজেদের আন্দোলনের ছাতার নিচে আনতে চান দর্শনগত অবস্থান একটুও না পালটে? ধরা যাক গর্ভপাতের বিষয়টা। রেগন-শাসনের সময় থেকে সঠিকভাবেই আমেরিকার শ্বেত মেয়েরা আবার গর্ভপাতের পক্ষে সোচ্চার। অথচ পরিসংখ্যানই বলছে কালো মেয়েদের জীবনে অভিশাপের নাম অ্যাবরশান। তাদের বিরাট এক অংশের আজও জোর করে পেট খসানো হয় যৌন-শোষণের সুবিধের জন্যে। তবে কি ঐক্যবদ্ধ নারীমুক্তি আন্দোলনের স্বার্থে কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েদের এই বুঝে নিতে হবে যে তাদের বর্তমান সমস্যা নিয়ে আর লড়াইয়ের দরকার নেই, কেননা তা কম গুরুত্বপূর্ণ, কেননা কম আধুনিক, কেননা রাষ্ট্র বিষয়টার অস্তিত্ব স্বীকার করে ফেলেছে আর তাই তাদের এ-ব্যাপারে কোনও দুঃখকষ্ট থাকতে নেই? অর্থাৎ শোষণের সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণ মেয়েদের জন্যে বরাদ্দ হচ্ছে হীনমন্যতাবোধও!

প্রত্যেক নারীর সমস্যাই তার নিজের কাছে চরম গুরুত্বের। এই সত্য অস্বীকার গেছে মার্ক্সবাদ, এখন নারীবাদীরা। তাই মার্ক্সসাহেবদের একটাকা সমালোচনাকারী ফেমিনিজমের মূল ধারার শক্তিশালী হয়ে ওঠা যেন এক নতুন মার্ক্সবাদী দলেরই আত্মপ্রকাশ। মার্ক্সইজম জনসংখ্যাকে ভাগ করেছে অনুভূমিকভাবে (নিচে শোষিত, ওপরে শোষক) আর নারীবাদ উল্লম্বভাবে (ডানদিকে পুরুষ, বাঁয়ে মেয়েরা)। এই পাইকারি শ্রেণীবিভাজন — পাইকারি, কেননা পৃথিবীতে বিশুদ্ধ চাকরির মতোই কোনও সমসত্ত্ব শ্রেণী হয় না —নারীবাদীকে সমাজতাত্ত্বিক সমস্ত সূক্ষ্মতা, বৈচিত্র্য ও জটিলতা না মানতে লোভ দেখায় কখনও এক অনমনীয় তত্ত্বের নামে, তো কখনও সাংগঠনিকতার দোহাই দিয়ে। মার্ক্সবাদের মতোই শ্বেতাঙ্গ নারীমুক্তি আন্দোলন জন্ম দেয় হায়ারার্কি নামে এক উচ্চতর ইয়ারকির, ডিসক্রিমিনেশানের, হয়ে ওঠে প্রভুত্বপরায়ণ আর শেষ পর্যন্ত পর্যবসিত হয় ডগম্যাটিকতায়।

আসলে চিরকাল সভ্যতা এক একটা আন্দোলন প্রসব করার পর প্রসন্ন হয়ে দেখেছে লক্ষ্য অর্জনের কিছু আগেই তারা নিঃশেষ হয়ে গেল, প্রতিটা মতবাদ তাৎপর্য হারানোর বহু মুহূর্ত আগে ঢাকা পড়ে গেল নতুন মতবাদের রোদ্দুরে। এভাবেই ব্ল্যাক লিবারেশান মুভমেন্ট অর্ধশেষ পথে কোথায় হারায়, উঠে দাঁড়ায় ফেমিনিজমের সাদাকালো। কোনও আন্দোলন তাই স্থির, সদৃশ ভূমি পায় না ছায়া রেখে দাঁড়ানোর, আর আকাশ যা পায় — অর্ধেক-মরা দর্শন আর সেই সংলগ্ন সমাজ-অবস্থার এক কোলাজ ছাড়া কিচ্ছু নয়।

এমন অবস্থায় নারীবাদকে যদি শুদ্ধ সমাজ-আন্দোলনের চেহারার কাছাকাছিও দাঁড়াতে হয়, তবে তার বিশেষ রূপ হবে খণ্ডিত, সামাজিক ভূগোলের বিভিন্ন দিকে ছড়ানো টুকরো টুকরো অনেক আত্মনিয়ন্ত্রিত নারীমুক্তি আন্দোলন, আর সাধারণ রূপ হবে এগুলোর মধ্যে যোগাযোগ রেখে চলা উপগ্রহের। ভারতে দলিত নারী-আন্দোলন, শ্রীলঙ্কায় তামিল নারী-আন্দোলন… এমন বহু-র পাশে পাশে হয়তো কালো নারীবাদও ভেঙে যাবে একদিন আমেরিকান আর আফ্রিকান ব্ল্যাক নামের দুই দেশিয়তায়। তাতেই মঙ্গল। নয়তো কালো মেয়েদের ভবিষ্যৎ আর বর্তমান আর অতীত সেই রকম হয়ে থাকলো ওলাদা একুইয়ানো যা একটু আগে লিখেছেন তার কবিতায়।

[মন শোকে মন্থর হলে পুরনো বইখাতা হাঁটকাই। তাতেই জালে পড়ল ১৯৯৫ সালের নোটবুক, দু’খান প্রবন্ধিকা আর একগাল গল্প তার পেটে পেটে। দুঃখজনকভাবে প্রথম গদ্যটা এখানে ছাপিয়ে দিলাম ননস্টপ। সুদীর্ঘ তেইশ বছর আগে এত জ্ঞান ছিল আমার! ভেবে ভয় করছে। হাসিও পাচ্ছে একটু]।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৫-০৮-২০১৮ | ১২:০২ |

    Smile ভালো উপস্থাপন করেছেন চন্দন দা। কিছু কোট করার লোভ সামলাতে পারলাম না।

    "নারীবাদকে যদি শুদ্ধ সমাজ-আন্দোলনের চেহারার কাছাকাছিও দাঁড়াতে হয়, তবে তার বিশেষ রূপ হবে খণ্ডিত, সামাজিক ভূগোলের বিভিন্ন দিকে ছড়ানো টুকরো টুকরো অনেক আত্মনিয়ন্ত্রিত নারীমুক্তি আন্দোলন, আর সাধারণ রূপ হবে এগুলোর মধ্যে যোগাযোগ রেখে চলা উপগ্রহের।"

    GD Star Rating
    loading...
  2. রিয়া রিয়া : ১৫-০৮-২০১৮ | ১৪:৪৯ |

    উদ্দীপক লেখায় অনেক কিছু জানলাম। নমস্কার দাদা।

    GD Star Rating
    loading...