গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত
বারো
এতক্ষণ যা বলতে চেয়েছিঃ হিন্দি ফিলমি গানে গত তিরিশ বছরে পুরুষের ন্যারেটিভে বড় একটা বদল এসেছে। সে নিজের টিম ছেড়ে যোগ দিয়েছে নারীভাষ্যে আর দুই দলই নৌকোর একই দিকে জড়ো হলে যা দাঁড়াবে, নারীপুরুষের প্রতিতুলনা বিষয়টার সলিলসমাধি হয়ে গেছে। গানের ভাষা লক্ষ করলে দ্যাখা যাবে নায়ক ক্রমাগত নত হচ্ছে পদহস্তাসনে, আগে যা ছিল নায়িকার এক্তিয়ার।
পুরুষ যে নারীর সমতলে নেমে এল, তার কী কী চিহ্ন হতে পারে? এক নম্বর: ছেলেরা কাঁদে না এই মিথ ভণ্ডুল করে দেওয়া।
অরিজিৎ গাইলঃ
ক) জিক্র তুমহারা জব জব হোতা হ্যায়
দেখো না আখোঁ সে ভিগা ভিগা প্যার বহ জাতা হ্যায়
(যখনই তোমার প্রসঙ্গ ওঠে, এই দ্যাখো, আমার চোখ দিয়ে বয়ে চলে ভিজে ভালোবাসা। ছবিঃ তেরা চেহরা)।
খ) মেরে আখোঁ মে আকে মুঝে থোড়া রুলা দে
(ছবিঃ বন্দেয়া)।
এবং সর্বোপরি
গ) অগর তূ হোতা তো না রোতে হম (বাগি ছবিতে)
ক্যারাটে ও ডিগবাজি জানা বিদ্রোহী টাইগার শ্রফ (বাগি শব্দের আরেকটা মানে উপেক্ষাকারী পর্যন্ত!) নায়িকাকে বলছে তুমি (পাশে) থাকলে আমি কাঁদতুম না গো এবং তারপরেও ধর্মেন্দ্র, এমনকি সানি দেওল জীবিত — ভাবা যায় না!
দুই নম্বর নিশানী : পুরুষ শরীরকামী না হয়ে যাচ্ছে মনের দিকে। এই দেখুনঃ
তন লড়ে তো তন মুক যায়েঁ
রুহ জুড়ে তো জুড়ি রহ জায়েঁ
(দেহ দেহে মিলিত হলে আশ্লেষের শেষ আছে। কিন্তু আত্মা মিললে সেই আসক্তি চিরকাল)।(গান: রাবতা)।
এছাড়াও, পরিষ্কার জ্ঞানের কথাঃ
রক্তমাংসের পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছ, কখনও আত্মায় এসে নেমেছ কি যে জানতে পাবে কাকে প্রেমিক বলে? প্রেম কী জিনিস?
(গানঃ আসান নহি হ্যায় ইঁহা)।
রুহ শব্দের প্রয়োগ হচ্ছে এই সময়ের গানে আকছার, যা কিশোর-কালীন লিরিকে দেখিনি।
তিন নম্বর প্লাগ পয়েন্টঃ
আগে পয়সাওলা বাপের মেয়ে গরীব নায়কের প্রেমে পড়ে বলতো আমি সব মানিয়েগুনিয়ে নেবো গো; এখন উল্টে গেছে ছবি। অরিজিৎ গাইলঃ
শীষমহল আমার সহ্য হয় না, তোর সঙ্গে শুকনো রুটি খেতে ইচ্ছে করি।
(শীষ মহল না মুঝকো সুহায়ে
তুঝ সঙ্গ সুখি রোটি ভায়ে)
(গানঃ মস্ত মগন)।
পয়েন্ট ফোরঃ
নায়ক ফলো করছে, আশ্রয় করছে নায়িকাকে — যেন এক বর্ণবিপর্যয়, উলটো রাজার দেশে…।
জঞ্জীর ফিল্মে রোগা গরীব অনাথ জয়া ভাদুড়ি একগুঁয়ে অনাপোষ এক পুলিশ অফিসারকে মাথায় রেখে গেয়েছিলঃ বনাকে কিঁউ বিগাড়া রে, বিগাড়া রে নসিবা, উপরওয়ালে। আমরা জানি, এই উপরওয়ালা যুগপৎ ঈশ্বর এবং অমিতাভ বচ্চন। নায়ক তাকে পেটের মধ্যে নিয়ে এক আন্তরিক হাগ দিতো নিশ্চয়ই, কিন্তু প্রেজেন্ট না থাকায় জয়া বাড়ির পেছনের কচুবাগানে শাড়ির আঁচল গায়ে জড়িয়ে রবীন্দ্রসংগীতের মতো পুরো গানখানি ঘুরে ঘুরে গেয়ে ফেলে। এটা ১৯৬৬-র ঘটনা।
ওই একই সালে সাধনা গেয়েছিল সুনীল দত্তের জন্যে আনন্দী কল্যাণে, করুণ গলায়ঃ তূ জাহাঁ জাহাঁ চলেগা, মেরা সায়া সাথ হোগা।
১৯৬৬ টু ২০১৭, জঞ্জীর বা তেরা সায়া থেকে ম্যায় হুঁ সাথ তেরে। সেই লম্বা নায়কেরা এতদিন জয় করতে করতে, তার চেয়েও বেশি জয়ের (বা বীরুর) অ্যাকটিং করতে করতে বেঁটে হয়ে আমির খান,তার ব্যারিটোন সরু হয়ে সইফ আলি, গানের গলা কিশোরের ধমকানো বেস ছেড়ে অরিজিতের ফ্যাঁসফেসে সমর্পিত স্বর।
কাজেই নায়ক অবশেষে নায়িকাকে গ্যাস খাওয়ানো ছেড়ে গেঞ্জি খুলে দেখাচ্ছে, ভাই ভেতরে বর্মটর্ম কিছু নেই, কেউ দিতেও ভুলে যায়নি যে দৌড়ে গিয়ে চেয়ে আনবো।
তার চেয়ে বরং “তোমার ছায়ায় চলবো আমি” বলছে নায়ক প্রেমিকাকে, যেভাবে দাশসাহেব লিখেছিলেনঃ যতদিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি। পুরো স্তবক তো শুনুন —
শাম সা তূ ঢলতা, তূ সুবহ সা হ্যায় নিকলতা, তেরে সায়ে মে চলতা, ম্যায় হুঁ সাথ তেরে।
হয়তো এই প্রথম হিন্দি ফিল্মি গানের লিরিকে এক নারীকে পুরুষতান্ত্রিক ভাষাবিধি ভেঙে সূর্য বলা হল। আরও সুন্দর ব্যাপার, প্রেমিক সময়চক্রের প্রতীক করে তুলল তাকে, ছেলেটার অস্তিত্বের সত্যের আধিকারিক হয়ে উঠল সেই মেয়ে। এই নতুন রূপককে লজেন্সের মতো মুখে নিয়ে একবার জিভ দিয়ে টাকরায় চেপে ধরুন। সারা গায়ে কাঁটা দিচ্ছে না!
নতজানুতার শেষ উদাহরণ দিয়ে আজকের এপিসোড খতম করতে চাই। অরিজিৎ আর আতিফ আসলাম দুজনেরই রেকর্ড করা গান — হুঁ, “ক্যায়সে, জিয়ুংগা ক্যায়সে-র কথাই বলছি।
এই লাইনদুটো তুলবোঃ
ম্যায় অন্ধেরোঁ সে গিরা হুঁ
আ দিখা দে তু মুঝকো সবেরা মেরা।
বন্ধুগণ, আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, “অন্ধেরোঁ সে গিরা হুঁ”, “অন্ধেরোঁ মে” নয় কক্ষণও, অথচ তাই প্রত্যাশিত ছিল। নায়ক অন্ধকারের ভেতরে ঝরে যায়নি, অন্ধকার থেকে ঝরে পড়েছে ধুলোঝাপটার পৃথিবীতে। গর্ভ থেকে এই বিরুদ্ধ অনাপন ভুবনে নিষ্কাশিত হয়ে সে আশ্রয় করতে চাইছে প্রেমিকাকে — মায়েরও আগে, মায়ের চেয়েও প্রধানভাবে।
আমরা দেখাতে চাইবো, রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গানের মনস্তত্বে এই পর্যায়ের সমর্পণ নেই। ইউরোপিয় যুক্তিবাদ, রেনেসাঁসের আলোকজ্ঞান, রোম্যান্টিকতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য আর উপনিষদীয় উইজডমের মিশেলের মধ্যে বৈষ্ণব ভক্তিবাদ বা লালনাশ্রিত যে মায়াকল্প, সেখানে প্রিয়কে দেবতা করার ইচ্ছেটা এতটা প্যাশনেট “প্রেজেন্ট প্লিজ” বলতে পারছে না।
(আর দুটো টুকরো)
loading...
loading...
একজন শ্রোতা হিসেবে আমরা কেবল গান শুনেই ক্ষান্ত হই। মনে ধরলে আর সামান্য একটু বেশী পছন্দ হলে লিরিক আয়ত্বে আনার চেষ্টা করি। এর বেশী না। কিন্তু এই লিরিকের শব্দ কথার মধ্যেেও যে কথা থেকে যায়, সেটা কতজন বুঝি।
ফ্যান্টাস্টিক ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়েছেন প্রিয় চন্দন দা। অভিনন্দন আপনাকে।
loading...
অনেক ধন্যবাদ, আজাদভাই।
loading...
একটা তথ্যের ভুল ছিল। শুধরে দিয়েছি।
loading...
ধন্যবাদ। শুভ সকাল প্রিয় চন্দন দা।
loading...
একদম ঠিকঠাক। মাঝে মাঝে আমিয়ো এমনটা বোধ করি। কিন্তু লিখতে পারি না। আমার ভাবনা যেন আপনিই প্রকাশ করে দিয়েছেন। শুভেচ্ছা রাখলেম দাদা।
loading...
ধন্যবাদ রিয়া।
loading...
একজন শ্রোতা হিসেবে উভয়ের গান-ই শুনে থাকি, আত্মতৃপ্ত হওয়ার জন্য।
loading...