কম্বাইন অ্যান্ড নো রুল?

এক পেটুক সহকর্মী ছিলেন আমার, কোথাও নেমন্তন্ন পেলেই তাকে ছুটতে হবে, আবার সফরের একাকিত্ব কাটাতে সঙ্গে একে-তাকে ধরে নিয়ে যাওয়াও চাই। আমাকে পাকড়াও করার চেষ্টা করলে বলতাম, সুস্থ শরীরের বারোটা বাজাব কেন মিছিমিছি? তিনি যে সমাধান দিতেন তা ঐতিহাসিক! “আরে, শরীর-টরীর কিচ্ছু খারাপ হবে না। প্রাণ ভরে খেয়ে দুটো হজমের ট্যাবলেট গিলে শুয়ে পড়ুন। পেটের মধ্যে ওরা-ওরা মারামারি করবে, আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমোবেন”।

ব্রিটিশ শাসকদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি আর কি। হিন্দুু-মুসলিমে ধুন্ধুমার বাধিয়ে দিতে পারলে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ ওদের স্থায়িত্বের আনন্দে বদলে যাবে।

সাধারণভাবে ভারতে সেই “বিভাজন-প্রশাসন” নীতিই শাসকেরা মেনে চলে। শুধু ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার “ওরা-ওরা” স্বাধীন ভারতে এসে “আমরা-ওরা” হল। ইংরেজ আমলে রাষ্ট্র ছিল থার্ড পার্টি, বাইনারির বাইরের লোক, আর স্বাধীন ভারতে শাসকই “আমরা”, স্বয়ং সুবিধেভোগী।

কাজেই প্রশাসনের একটা চলন তৈরি হয়ে গেল, নির্দিষ্ট রাগের যেমন থাকে। ঘটনা যাই হোক, বাদী আর বিবাদী স্বর পাল্টাবে না। একটা অপরাধের স্থানাংক আর মূল্যবিচার, তার বিরুদ্ধে কী পদ্ধতিগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সব এই বিভাজন-প্রশাসন তত্বের ওপর দাঁড়িয়ে।

যা বলেছি এতক্ষণ, নতুন কিচ্ছু নয়। এও সবার জানা যে, গণতন্ত্রে রাষ্ট্র জনতাকে একবারই সক্রিয় করে তোলে যখন তাকে লাইন ক’রে ইলেকশান বুথের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হবে। কর্তৃত্বের যে শাসনের অধিকার, তাতে তখন আইনি শিলমোহর লাগানো দরকার। পরের পাঁচ বছর জনগণ নয় ঘুমিয়ে পড়ুক।

এই ঘুম নিশ্চিত করার জন্যেই আইন শৃঙ্খলা। পার্টির নজরদারিও। ক্ষমতায় থাকা দল আর বিরোধীর গুন্ডা/অ্যাক্টিভিস্টদের মধ্যে লড়াই চলতে থাকে, কিন্তু সেখানে লেজটি পেতে না দিলে সাধারণ মানুষ অস্পৃষ্ট থেকে যায়। লেজ না বাড়ানো মানে মাথা নিচু করে ক্ষেতে, অফিসে, দোকানে যাওয়া, দিনশেষে বাড়ি ফিরে আসা মাথা নিচু করে। উল্টো দিকে, কালো টাকার সমান্তরাল অর্থনীতির মতো ক্ষমতার লড়াইয়ের আদত চেহারাটা আন্ডারগ্রাউন্ড গোষ্ঠীজীবনের আদলে গড়িয়ে যেতে থাকে, কখনও সেটা পৃথিবীর ভূত্বকের ওপরে উঠে এলে সাধারণ নাগরিক ভয়ে সিঁটিয়ে যায় (ওয়েলসের “টাইম মেশিন” মনে করুন)।

কিন্তু এখনকার পশ্চিমবঙ্গে একটা নতুন প্রতিবেশ তৈরি হয়েছে যে বিরোধীরা, ভয়ে-ভক্তিতে সরকারি রাজনৈতিক দলের দিকে পা বাড়াচ্ছে আর গৃহীত হয়ে যাচ্ছে। মানে, ডিভাইডের জায়গায় কম্বাইন শব্দটা এসে বসল। এমন চলতে থাকলে “দুইখান কথা” জন্ম নেয়।

ধরুন, ক্ষমতায় যেতে চাওয়া দলগুলোর লড়াই ওজোনস্তর নির্মাণ করে রেখেছিল আর প্রাথমিক শোষণ হল আল্ট্রা-ভায়োলেট রশ্মি। “প্রাথমিক বা প্রত্যক্ষ শোষণ” কী? খুন, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই, আগুন লাগানো এইসব — আইন-শৃঙ্খলার জাগ্রত অবস্থা যাকে সফল ভাবে প্রতিহত করতে পারে। কিন্তু “কম্বাইন” করার নতুন পরিস্থিতিতে ওই ওজোনমণ্ডলের অস্তিত্ব আর নেই। এবং যেহেতু আমাদের রাজ্যে উৎপাদনের অবস্থা খুব রমরম করছে এমন নয়, রোজগারের সুযোগ সীমিত, সেক্ষেত্রে স্লোগানটা এখানে এসে দাঁড়ায় যে ‘জনগণই অর্থনীতির উৎস’। খুব বিচ্ছিরি অর্থে এও মানব সম্পদের ব্যবহার। তাহলে চ্যাপলিনের ফিলমের দৃশ্যের মতো কামানের নল কি নিজের পাবলিকের দিকেই ঘুরে গেল! ‘আমরা’ হলাম গোটা রাজনৈতিক শক্তিবর্গ আর ‘ওরা’ ঠাওরালাম সাধারণ নাগরিককে?

দ্বিতীয় কথাটা প্রশাসন নিয়ে। তার রাগের চলন এখন স্তিমিত, যেহেতু সবই বাদী স্বর এবং বারোটা স্বর নিয়েই (সবক’টা শুদ্ধ!) গান গাওয়ার চ্যালেঞ্জ। প্রশাসন তবে কার পক্ষ নেয় আর কাকে বঞ্চিত করে? যদি সে মিলিত রাজনৈতিক শক্তির দিকে থাকে তবে তার এতদিনের “ডিভাইড অ্যান্ড রুল” নীতিতে চলার অভ্যেসে একটা বড় বদল আসবে। কেননা সে রঙ দেখে অ্যাকশান নিতে পারছে না, প্রত্যেক অপরাধের ঘটনায় অপেক্ষা করে থাকবে শেষ পর্যন্ত, রাজনীতির কী নির্দেশ? কাজেই নতুন যে পরিস্থিতির উদ্ভব হল তাতে প্রশাসনের এফিকেসি আরও অনেক মার খেতে পারে, সে ভীষণ শ্লথ হয়ে যেতে পারে এবং সাধারণ নাগরিক, যারা প্রত্যক্ষ/প্রাথমিক শোষণের শিকার বা শ্রোতা-দর্শক, তাদের মনে হবে একটা এমন একটা রাজ্যশাসনে এসে পড়লাম যার মূলনীতি “কম্বাইন অ্যান্ড নো রুল”।

তবে যেভাবে অসুখের সংজ্ঞা আর তার চিকিৎসা একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল, যেভাবে কোনও সিনেমাতেই কাঁচি না চললে সেন্সর বোর্ড মুমূর্ষু হয়ে পড়বে, ঠিক তেমনি আইন সব সময় চায় একটা ‘অস্থিতিশীল ভারসাম্য’ (পরিভাষা ইটালো ক্যালভিনো-র, “ইফ অন এ উইন্টার’স নাইট এ ট্র‍্যাভলার”) যেখানে সে শাসনের কারণ তৈরি করতে পারে, যেহেতু ল’ একমাত্র টিঁকে থাকে নিজেকে প্রয়োগ করার ভেতর দিয়েই। সুতরাং আমার আশা যে নতুন সাফলিং হবে, কোনও নতুন বিভাজন বা চিড়-সূত্র — যাতে প্রাথমিক বা প্রত্যক্ষ শোষণ-বিরোধী কামানের নল জনতার উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৩ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ৩ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৪-০৭-২০১৮ | ১১:১৫ |

    একদম পারফেক্ট বিশ্লেষণ। অসাধারণ আপনার উপস্থাপনা এবং তৃতীয় চোখ।
    শুভেচ্ছা রইলো প্রিয় শব্দবন্ধু চন্দন ভট্টাচার্য।

    GD Star Rating
    loading...
  2. রিয়া রিয়া : ০৪-০৭-২০১৮ | ১১:৫৮ |

    আপনার সমসাময়িক আর্টিকেল গুলোও আমি পড়েছি। দারুণ আপনার চেতনাবোধ।

    GD Star Rating
    loading...
  3. সাইদুর রহমান১ : ০৪-০৭-২০১৮ | ১২:২৮ |

    ব্রিটিশ শাসকদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি আর কি হিন্দুুমুসলিমে ধুন্ধুমার বাধিয়ে দিতে পারলে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ ওদের স্থায়িত্বের আনন্দে বদলে যাবেফেলে আসা ইতিহাসের চমৎকার ইতিবৃত্ত তুলে ধরলেন শ্রদ্ধেয় মি.চন্দন ভট্টাচার্য

    GD Star Rating
    loading...