স্মরণার্থী
এক
কাল রাত্তিরে বাড়ির বাথরুমে ঢুকছি, ফটাস করে হাওয়াই চপ্পলের ফিতে গেল ছিঁড়ে। আর প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় এক মাইক্রো সেকেন্ডের মধ্যে আমার মাথা প্রশ্ন করল, সেফটিপিন?
চৌকাঠে ঝিম হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম দু’তিন মিনিট। মাটির ১২০ ফুট নিচে থেকে ভেসে উঠেছে “নিরাপত্তাকাঁটা” শব্দটা, আর মন কাঁকরবালি খুঁড়তে খুঁড়তে হু হু করে নেমে যাচ্ছে আরও অন্তত ২৬০ ফুট, আর্সেনিকহীন দ্বিতীয় স্তরের জলে — যেখানে শালুকপাতার মতো থাক-থাক সাজানো আমার শৈশব, স্কুলের পেতলের থালাঘন্টা, আমার আধপেটা রাতগুলো।
হাওয়াই চপ্পলের সঙ্গে শরণার্থী জীবনের সম্পর্ক নিয়ে কোনো না কোনো দিন প্রেমের এপিক লেখা হবে আমি জানি। মনে পড়ছে সদ্য চাকরি পেয়ে অডিট টিমে পোস্টিং হয়েছে, সবাই শিয়ালদায় একসাথ হই, তারপর গাড়ি নিয়ে অকুস্থলে রওনা। তো একদিন স্টেশানের “অনুসন্ধান-এ পৌঁছোতেই সিনিয়ার কোলিগ বললেন, ঠিক বুঝেছিলাম, এই যে ভিড়ের ঝাঁকটা বেরলো, এ চন্দনের ট্রেন না হয়েই যায় না।
— কী করে বুঝলেন!
— আমি তো প্যাসেঞ্জারের পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। এইট্টি পার্সেন্ট হাওয়াই চটি মানেই বনগাঁ লোকাল।
দুই
আমরা রাবারের চপ্পল ফটফটিয়ে কলেজে বা সিনেমায় যেতাম; বিয়েবাড়ির ড্রেস হল ডেকরনের প্যান্টে টেরিলিনের ফুলহাতা শার্ট ইন করা এবং পায়ে বল-সাবানে মাজা হাওয়াই চপ্পল। আর ঝিঁঝিঁব্যাঙল্যাটামাছশামুককেঁচোখচিত ছোটবেলার সেই বিমানবিধ্বংসী বর্ষাকালে সবুজ শ্যাওলা অবুঝ এঁটেলমাটির ওপর দিয়ে আমরা যেভাবে আছাড়বিমুক্ত ছুটে যেতে পেরেছি পায়ে প্লেন চটি, ততটা স্বচ্ছন্দ ডোবায় জলে জলঢোঁড়া হয়ে দেখাক তো!
কিন্তু কখনও কখনও ওই এঁটুলি মাটিই চটির আত্মাকে ছাড়তে চাইতো না, তখন তাকে খিঁচকে সরাতে গেলেই উৎপটাং ব্যাপার। পা বেরিয়ে এসেছে, নগ্ন-একপদ বুদ্ধদেব চেঁচিয়ে উঠল:
— মা? ও মা! চটি ছিঁড়ে গেছে। সেপ্টিপিন নিয়ে আসো।
হন্তদন্ত এক ঘোরশ্যামা অনেকখানি লম্বা হেতু রান্নাঘর থেকে ঘেঁটি-নিচু বেরিয়ে আসে। দুহাতের শাঁখাপলা-সমৃদ্ধ কবজি হাতড়ায়।
—না রে মনা, সেপটিপিন তো নেই!
— ধুস, তোমরা যে কী করো না! এখন কী ক’রে ইশকুলি যাবো?
দাঁড়া দেখতিছি, ব’লে মা আমার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে বাড়ির দক্ষিণে লিচুগাছের ওপর বসা দোয়েলপাখির দিকে তাকায়, ওপরটি দিয়ে নিচের ঠোঁট আস্তে চেপে ধরে। আর বুকের শাড়ির নিচে চালান করে দেয় হাতদুটো।
এমন কতোবারই হয়েছে, কিন্তু তখন তো আমি ক্লাস এইট ছিলাম না, সমঝদার ছিলাম না। ঝটকা দিয়ে মুণ্ডু ঘোরাই।
— লাগবে না। তুমি বরং আমারে পাঁচ নয়া দাও, ইশকুল ছুটির পরে চটিসারা-র কাছ থেকে সেলাই ক’রে নিয়ে আসবানে।
মা প্রথমে বিমূঢ় হয়, তারপর তার মু্খের সাগরতীরে “আচ্ছা, বুঝেছি”-র গোলাপি সূর্য উঠতে থাকে! নিজের শিশুসন্তান পরিণত ও যত্নবান পুরুষে বদলে যাচ্ছে টের পেলে আনন্দ আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিজের নারীসত্তার দিকেও কি আর একবার ফিরে তাকায় সেই মা?
— অ মিনু, তোর কাছে সেপটিপিন থাকলি অ্যাট্টা নিয়ে আয় তো!
খোপের পড়ার ঘর থেকে বাড়ানো-হাত দিদি নেমে আসে, তার দিকে মা এক অসীম রহস্যভরা মুখে তাকায়।
— আমারে না, ভাইরে দাও। উনি আমার সেপটিপিন নেলেন না।
হাঁটু গেড়ে বসে চটির ফিতেয় রিফুকর্ম শুরু করি আর বেশ বুঝতে পারি অন্ধকার আকাশে তরোয়াল ছুটে যাওয়ার মতো দুই নারীর সংকেতময় চোখ আমার এলোমেলো মাথার চুলে অনেক নরম তারা ঝরিয়ে দিচ্ছে।
loading...
loading...
লিখার গভীরতায় অসাধারণ এক সাহিত্য রসায়ন কাজ করেছে। অভিনন্দন প্রিয় চন্দন দা।
loading...
আপনাকে ভীষণ আত্মবিশ্বাসী লেখক মনে করি দাদা। প্রণাম।
loading...
লেখার মধ্যে একটা দৃঢ়তা আছে।
loading...