গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত
তিন
গণসংগীত যে বিশেষ উদ্দেশ্যে ডাক পাঠায় মানুষকে, তাতে ধুন কখনও পড়তির দিকে যাবে না। গান মানে মিউচুয়াল ফান্ডের টাকা; জমা দিয়ে বসে থাকলাম, গেলাম ভুলে, ইউনিটের দাম আজ বাড়ে তো কাল কমে করতে করতে অন্তিমে লাভই লাভ — এই সুরার্থনীতিতে তার বিশ্বাস নেই।
গণসংগীত তৈরির পেছনে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা আর পরিকাঠামো থাকে। মানুষকে জাগাতে গেলে ফুলের তোড়ার বদলে তরোয়ালের খোঁচা দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কাজেই জনগণের গানবাজনার সুর খাড়া হয়ে থাকবে, দিল্লি যাওয়ার ডাকের সঙ্গে নেতাজির ডানহাতের আঙুলটা যেমন, আর সেভাবেই এক শৃঙ্গ থেকে আরেক চুড়োর দিকে এক-বিঘত লাফে এগিয়ে যাওয়া। উদাহরণ তুলে নিন: “এসো মুক্ত করো” কিম্বা “শত শহীদের রক্তে রাঙা পতাকা”। গানের সুর শুরু থেকেই মোটামুটি প্রত্যেক লাইনের শেষে গিয়ে উঁচু নোট হিট ক’রে দাঁড়িয়ে পড়ে; যেহেতু এখানে গানের ভেতর দিয়ে নির্দেশ যাচ্ছে, একটা যুদ্ধ প্রবাহিত।
গণসংগীত নিজেকে সম্বোধন করে না কখনও। সে অপর-এর জন্যে তৈরি; সমূহ অপর (collective other) নয়, তবে তার বেশিরভাগটা। জনতার গানের সড়ক দিয়ে সুরের গাড়ি কথা বয়ে ছুটে যায় নিজের শীর্ষবিন্দুতে দাঁড়াবে ব’লে, ফিরে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করে না — যেহেতু এই গানের কোথাও একক শিল্পীসত্তা নেই। সমগ্রের তো কোনও অন্তর্মুখ হয় না। কেউ হয়তো জনতার গানের অ্যাড হক চরিত্রের কথা মনে করাতে পারেন, কিন্তু তাহলে রবীন্দ্রনাথও প্রচুর উপলক্ষ্যগীতি তৈরি করেছেন!
ওরে গৃহবাসী-তে ঘরে থাকা মানুষকে বাইরে ডাকা হচ্ছে, সেই হিসেবে এটা গণসংগীতের চেয়ে খুব দূরে দাঁড়িয়ে নেই। আবার আছেও, কেন না (ক) এই ডাক সব মানুষকেই, আর (খ) আবাহন মানবসমাজ নয়, প্রকৃতির তরফ থেকে।
সর্বহিতম মানে সব মানুষের মঙ্গল আর সর্বসংগ্রহ মানে গোটা পৃথিবীর ভালো যদি চেয়ে থাকি তবে আমিও বহিরাগত নই সেই যাচনায়।
তাই গানটাতে ঘরকুনো মানুষকে দরজা অনর্গল ক’রে বেরিয়ে আসার যে ডাক তা শুরুতে উচ্চকিত হয়ে শুদ্ধ ধৈবত ছুঁলেও ওই স্থায়িরই শেষবিন্দুতে রবীন্দ্রনাথ “দ্বার খোল দ্বার খোল” বলতে বলতে মাঝ-সপ্তকের ষড়জে নেমে আসছেন। গাইতে গিয়ে মনে হবে গৃহবাসী শুনতে পাবে তো এই আপনমনা ফিসফিস? তারপর আরও খেয়াল করি, কবি ঋতুদেহ বর্ণনা করতে যতটা উচ্ছ্বসিত; দখিন আর দখিনা শব্দের পাশাপাশি ব্যবহারে যে পরিমাণ সুপার স্পেশালিটি; কই, গৃহীকে আদৌ ততো চড়ায় ডাক পাঠাচ্ছেন না তো!
কয়েকবার সুরোচ্চারণের পর অনুভব হয়, আমার বহিরংশ যেমন, ভেতরেও তো তেমনি এক মোকাম। আমি নিজেকেও বেরিয়ে আসতে বলছি সেই আত্মনিকেতন থেকে। তখন আমার আবৃত্তি অস্ফুট, আর এইভাবে নিজের ভেতর দিয়ে ডাকটাকে অন্যের, মানে, ওই কালেকটিভ আদার-এর মনের দিকে বইয়ে দিলাম। বাইরে থেকে নয়, “পারি যদি অন্তরে তার ডাক পাঠাবো”, এ-তো রবীন্দ্রনাথের চিরকালেরই পছন্দ।
আত্ম-পরের এই বন্ধন তৈরি হয় বলেই রবি ঠাকুরের সুরের মধ্যে এত সৌজন্য, এত কনসার্ন, এত স্পর্শ স্বর আর মিড়, এত নতজানুতা। কবিকে আমন্ত্রণের আওতা থেকে কাউকে বাদ দিতে হচ্ছে না, শোষক-শোষিত ভেদ না থাকায় গানের সুর ওপরে-নিচে সমপ্রবাহী। তাই কথার উৎসাহিত আহ্বান শেষে গিয়ে ঠেকছে সুরের অনুনয়ে। আর অনুনয়, রবীন্দ্রনাথের প্রায় সব গানের মতোই, কোথাও মানুষের মনের অধরা অকারণ সৃষ্টিমুখী বেদনাকে ছুঁয়ে দিল।
লিঙ্গপুরাণের সেই শ্লোকটা পড়ে নিতে পারি:
যথা মদো নর স্ত্রীণাং যথা বা মাধবো দৃনিলঃ।
অনুপ্রবিষ্টঃ ক্ষোভায় তথা সৌ যোগ মূর্তিমান্।।
সমস্ত শিল্প তৈরি হওয়ার পেছনে একটা ব্যাকুল কষ্ট থাকে। নারী আর পুরুষের মনে এক এক সময়ে যে রসমত্ততা আসে কিম্বা বসন্তের বাতাস পৃথিবীর হৃদয়ে ঢুকে পড়ে জন্ম দেয় যে ব্যথা বা ক্ষোভ, তাই নতুন সৃষ্টির প্রেরণা।
লিঙ্গপুরাণের গল্পে নারদকে গান শিখিয়েছিলেন উলূক, যার নাম ছিল গানবন্ধু। আধুনিক সময়ে আমরা আরেক গানবন্ধুকে পেলাম, এটা কম কথা নয়।
বেড়ে চলল…
loading...
loading...
আপনার লিখা যতো পড়ি ততো মুগ্ধ হই। ততো শিখি। অনুপ্রাণিত হই প্রিয় চন্দন দা।
loading...
আপনার লেখার ধরণ এবং যুক্তি আমাকে ভীষণ ভাবে মুগ্ধ করে। নমষ্কার।
loading...