গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

এক
রবীন্দ্রসংগীতের মধ্যে আমি সব সময় একটা “প্লিজ”কে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি।

রাতের লোডশেডিংয়ে বিছানা হাতড়ালেই যেমন টর্চ, মটরশুঁটির মধ্যে মটরের দানাগুলো, রবীন্দ্রগানের সবচেয়ে আহামরি অংশ এই “অনুগ্রহপূর্বক”। রবীন্দ্রনাথ অন্যের ধ্বজাকেই নিজের নিশানের ওপরে তুলে ধরেন, সেই অন্য পর-ই হোক, বা পরম (দুটো শব্দ একই মূল থেকে আসছে, দেবদত্ত পট্টনায়ক জানিয়েছিলেন My Gita-য়)।

এক কোটি পুনরাবৃত্তির ছপ্‌টি খেয়ে ধুলোয় গড়াচ্ছে, শুনলে আর কোনও ফিলিংই জাগে না, এমন গান হল “ওরে গৃহবাসী”। যদি আপনি আমার মতো বিধ্বংসী বাঙালি না হন, মানে আবিরপন্থী রবীন্দ্রধার্মিক ক্যাম্প-অ্যাট-শান্তিনিকেতন, গানটা একবার মুখে তুলেই ফেলে দিতে ইচ্ছে করবে। কোথাও তাকে ঠিকভাবে সংরক্ষণ করাই হয়নি, কোথাও বা এন্তারসে রাসায়নিক মিশিয়ে রেমন্ডস বা কেএফসি-র স্টিকার মেরে বাজারে ছেড়ে দিয়েছে।

শুধু আমার মতো অন্ধ-অবুঝের মনে হয়, এখনকার ইলেকট্রনিক জিনিসপত্তরের মতো রবীন্দ্রসংগীতেও অ্যান্টিভাইরাস, স্টেবিলাইজার, অ্যাডপ্টার সব বুদ্ধি ক’রে আগে থেকে ভ’রে দেওয়া হয়েছিল, আর “প্লিজ” সেই রকমই এক ইন-বিল্ট পরিকল্পনা।

গণসংগীতের জন্ম হয়েছে “আমাদের মানুষকে বোঝাতে হবে” — এই দৈব ঘোষণা থেকে। কাজেই গণসংগীতের রেসিপি হল অনুজ্ঞা, অনুশাসন, অণুসিদ্ধান্ত। আর রবীন্দ্রনাথ যে কথাগুলোকে আহ্বানের ঘাটে বেঁধেছিলেন, কবির নিজেরই সুর তাদের ভাসিয়ে নিয়ে দাঁড় করালো আবেদনের কিনারায়। ওরে গৃহবাসী গানটা উদাহরণ নাম্বার ওয়ান।

সৌজন্যে বা কারসাজিতে ওই প্লিজ-ই!

দুই
ভি-ওয়ান টাইপ বাসের পেছনের সিটগুলো উঁচুতে থাকে। সেই উচ্চতার আবার দুই ধাপ: মাধ্যমিক, হায়ার সেকেন্ডারি। হঠাৎ চিৎকার শুনে দেখি হাতদুয়েক দূরে একটা মেয়ে আমাকে আঙুল তুলে হিন্দি ভাষায় শাসাচ্ছে — কী হল, পেছনে অতোটা খালি জায়গা রেখে দাঁড়িয়ে আছেন, আর আমরা এখানে চাপ খেয়ে মরছি। এগোন ওপাশে!

অপমানিতের হাসি হেসে বললাম, ম্যাডাম ওই জায়গাটা উঁচু, দাঁড়াতে গেলে মাথায় আটকাবে, আপনিও পারবেন না।
— আপনি বুঝি সবজান্তা?
— তাহলে এসে দেখতে হয়।
— আপনার ঘাড়ের পর দিয়ে যাব নাকি? জায়গা দিন।
এই রে! পেছনে পেছন ঠেকিয়ে দুসারি লোক দাঁড়িয়ে আছি। আমার সামনেই আবার এক ভদ্রমহিলা ব’সে যার গণতান্ত্রিক অধিকারের দিকে আমাকে সব সময় সতর্ক নজর রাখতে হচ্ছে। তবু নৌলিমুদ্রা মনে ক’রে পেটে খাবোল দিয়ে ধনুক হলাম, সবাইকে গুঁতিয়ে আমার পেছন দিয়ে সেই বৃহত্তর গণতন্ত্র বোমারু বিমানের মতো পার হয়ে গেল। তার সঙ্গে সর্বভারতীয় মিডিয়ার কাছে “বুড়োগুলো ভয়ানক ধান্দাবাজ, নিজেরা একগাদা জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, অন্যকে এগোনোর সুযোগটুকু পর্যন্ত দেবে না, কত্তোবড়ো অসভ্য!” — এইরকম প্রেস রিলিজ।

কিন্তু উচ্চতর মাধ্যমিকের সিলেবাস দেখেই ফেল করল মেয়েটা, থেমে গেল সেই নিচের ধাপে, মানে আমার ঘাড়ের ওপর। প্রায় বেকেলাইটে তৈরি তার বগল-ব্যাগ শঙ্খ ঘোষের কবিতার পাঠক নিশ্চয়ই, আমার পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ না তুলে ছাড়বে না।

— ম্যাডাম, আপনি যে আমার জায়গাটায় দাঁড়িয়ে পড়লেন!
— ‘আমার জায়গা’ মানে??? ইয়ে আপকা খরিদাহুয়া জগা হ্যায় ক্যা???

মুগ্ধ হয়ে গেলাম! চোখের ওপর গাঢ় হল ন’-হাজার ফুট ওপরের সূর্যাস্ত, যেখান থেকে একের পর এক কুয়াশার ফিতে নেমে পাইনবনের মাথা জড়িয়ে ধরছে…। ওই প্রকৃতির যেমন কোনও ব্যাখ্যা চলে না, তেমন এই যুক্তিরও। ডোকরা শিল্প অথবা পটের ছবির মতো বিরল হয়ে ওঠা জটিল মেয়েলিপনার চিহ্ন পেয়ে আমি ভালো ক’রে তাকিয়ে দেখি গনগন করছে তার নাকের পাটা, গোল তরোয়ালের মতো ঝলসাচ্ছে হাতের কব্জি।

কয়েক নিঃঝুম মুহূর্ত পার হয়।

অচ্ছা চলতা হুঁ দুয়ায়োঁ মে ইয়াদ রখনা
মেরে জিক্‌র কা জুবাঁ পে সুয়াদ রখনা

প্রথমে বাসের কেউ কিছু খেয়াল করে না, ইনক্লুডিং মাইসেলফ।

দিলকে সন্দুকো মেঁ মেরে অচ্ছে কাম রখনা
চিট্‌ঠি-তারোঁ মেঁ ভি মেরা তু সলাম রখনা

তারপর দু’একজন কান থেকে হেডফোনের রিসিভার খুলে আমার দিকে বিচিত্র চোখে তাকায়। তখন বুঝতে পারি, গান গাইতে শুরু করেছি! সর্বনাশ! এই বাসেই আমার চার-পাঁচজন কোলিগ, অফিসে রাষ্ট্র হলে…? নিজের আবেগকে দ মানে দমন করো, কিন্তু গান ততক্ষণে আমাকে চিৎ করে বুকের ওপর চেপে বসেছে।

সুতরাং একদিকে “সন্দুকোঁমেঁ” শব্দে তার-ষড়জ থেকে লোলেগাঁওয়ের দড়ির সেতুর মতো এক ঝুলন্ত মিড়ে কোমল নিষাদে গিয়ে দাঁড়াই, অন্যদিকে আমার মন বিড় বিড় করতে থাকে: এই নাও, কথাসুরের করুণা পান করো। কেন এত রাগ তোমার জানি না। নির্যাতিত শিশু, বাড়িতে স্বাধীনতা না পাওয়া, অফিসে হয়রানি নাকি প্রেমিক উধাও? অথবা তুমি এই রকমই এক কোপে মুন্ডু নামানোয় বিশ্বাসী! যে হও সে হও, দ্যাখো শুধু তোমারই জন্যে কেউ লিখে গেছে, কেউ গেয়ে রেখেছে…

অন্ধেরা তেরা ম্যায়নে লে লিয়া
মেরা উজলা সিতারা তেরে নাম কিয়া

শোনো গান আরও বলছে কতবার তার সকালকে তোমার উঠোনে বসে বসে সন্ধে করেছে সে। গুনেগেঁথে নাও গানের “ও পিয়া” ডাকের ভেতর যত লক্ষ প্লিজ-প্রজাপতি উড়ে বেড়ায়!

মেয়েটার চোখে খুব আস্তে আস্তে জ্যোৎস্না ফুটছে দেখতে পাই। চিবুকের সব খর-রেখা মরে যাচ্ছে, দুটো ঠোঁট মুখের মধ্যে মুড়ে নিয়ে বাসের ছাদে কল্পিত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে…।

(স্টপেজ আসেনি)

রবীন্দ্রনাথের গান: কখন ‘জাগে’, কখন ‘জাগে’ না
রবীন্দ্রনাথের গান: কখন ‘জাগে’, কখন ‘জাগে’ না (শেষাংশ)
উপরের লেখা দুটো পড়ে দেখতে পারেন।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ৩০-০৪-২০১৮ | ২২:৩৭ |

    আপনার সমসাময়িক নিবন্ধ গুলোন পড়লে আমি মুগ্ধ হই। কী অসাধারণ বাচন ভঙ্গীমা … আর যথেষ্ঠ যুক্তি পড়ে আপনার জানার পরিধি যে অসম্ভব রকমের পরিধিতে থাকে সেটা স্বীকার না করার কলম শক্তি আমার থাকেনা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_smile.gif.gif 

    GD Star Rating
    loading...
  2. রিয়া রিয়া : ৩০-০৪-২০১৮ | ২২:৪৭ |

    অসাধারণ লাগলো কবি দা। ভাল বিশ্লেষণ।।

    GD Star Rating
    loading...