গল্প : নেট প্র্যাকটিসের পর
সকালে দেবার্ক ফোন করেছিল। এই ক্যালানে, বিরাট কোহলিকে বল করবি?
— তুই কর। একটা রেস্টের দিন, ঘুমোতে দে শালা। আতা কোথাকার!
কাল মধ্যমগ্রাম সুহৃদ সংঘের “দিনরাত্রিব্যাপী” ছিল, ফাইনালে লং লেগে ডাইভ মারতে গিয়ে বাঁ হাতের কনুইটা ছ’ড়েছে। মোবাইল দেখলাম, সাতটা চৌতিরিশ। সুইচ অফ করে কম্বল টেনে নেওয়া যাক মাথার ওপর।
কিন্তু কপাল খারাপ হলে যা হয়, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাবা ঢুকে এলো। দেবুদা ফোন করেছিল, আধ ঘন্টার মধ্যে ইডেনের পাঁচ নম্বর গেটের সামনে হাজির হতে বলছে। যা যা, বিরাট রোহিতদের ঠ্যাঙানি খেয়ে আয়।
বাবা চায় না আমি ক্রিকেট খেলি, আমিও কি চাই! স্রেফ মার জেদাজেদি আর সেজদার মারের ভয়ে মাঠটা টেনে যেতে হচ্ছে। নিজেকে বুঝিয়েছি: রঞ্জি খেললে চাকরি পেতে সুবিধে, সামনের চার-পাঁচ বছরের মধ্যে একটা চান্স লাগল তো লাগল, না হলে বাবার চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি ফার্ম জিন্দাবাদ।
দুই
দেবুকাকু পিঠে আধা-চাপড় আধা-কিল গোছের কিছু একটা দিল, চাপড় টনিক আর কিলটুকু দেরি করার জন্যে। মাঠে ঢুকে দেখি, পাশাপাশি দুটো নেটের মুখে দুটো জটলা, সিএবি-র ফার্স্ট আর সেকেন্ড ডিভিশান মিলে প্রায় কুড়িখানা ছেলে — উত্তর পাড়ার বাবুন, বেহালা ইউথের রাজীব সামন্ত যার গ্রাউন্ড ফিল্ডিং আমাদের মালি পিচ্চাইদার ভাষায় “ব্যাংকর”, তারপর এবার অন্ধ্রা থেকে বাংলায় আসা স্টিফেন — কে নেই! রণদেব বাসুর লম্বা মাথাটাও দেখতে পেলাম। যাই হোক, বাঁদিকে নেট করবে ব্যাটসম্যানরা আর ডান দিকে বোলার সম্প্রদায়। আমার মতো কমজোরি দশটা ছেলেকে বোলারদের জন্যে বেছে তার থেকে ছ’জনকে মাঠে ডাকা হল। বাকি চারজন ইনক্লুডিং মি এক এক বোতল জল হাতে সাইড লাইনে।
পনেরোই ডিসেম্বরের কলকাতা যেমন হয়, আজকের মাঠ তেমন সুখীসুখী নয় কিন্তু। ঠান্ডা নেই, হাওয়া নেই, কুজ্ঝটিকাও। আমি হাফহাতা সোয়েটার খুলতেই যথারীতি অবাক হয়ে তাকাল পাশের ছেলেটা। হাইট পাঁচ ফুট সাড়ে নয়, ওজন মায়ের সপ্তাহে চোদ্দ বেলা অন্ডা-চিকেন কারির সৌজন্যেও ষাট কেজি ছোঁয়নি, হাওয়ার উল্টোদিকে দাঁড়ালে নিখুঁত ফার্স্ট ব্রাকেট হয়ে যাই। আমাকে সবাই চোখ হাঁ করে দেখে এবং বিনা দ্বিধায় বাতিল করে দেয়।
দু’বছর আগে অনিমেষ ডাক্তারের মেয়ে অনুশ্রী যেচে এসে আলাপ করলো এই ইডেনে; আন্ডার সেভেনটিনের কোয়ার্টার ফাইনাল ছিল; আমি শেষ ওভারে কী করে কে জানে তিনটে ছয় মেরে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ! দুদিন সিসিডি-তে বসা হল, একদিন হাফ টাইম পর্যন্ত নন্দন-এ দেবের সেই বক্সিংয়ের সিনেমা… তারপর থেকে মেসেজ পাঠাই, উত্তর আসে না। দুমাস বাদে নীলিমা ফোন করেছিলঃ কষ্ট পেয়ো না, অরিনদা। তুমি রোগা ব’লে নয়, আসলে তোমার কোনও উচ্চাশা না থাকাটা আমার বন্ধু মেনে নিতে পারেনি।
তিন
ভুবনেশ্বর কুমারের স্ট্রেট ড্রাইভ ছুটে এল আমারই দিকে। সরল মনে কুড়িয়ে ফেরত পাঠাবো, দেখি একটা মোটা কালো লোক, মাছওয়ালার মতো চেহারা, ইশারায় ডাকছে। এই রে! বেশ ঘুমঘুম পাচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত গাধার খাটুনিই নাচছে কপালে। বাবা বলে, ইলেকশান ডিউটিতে রিজার্ভ আর ক্রিকেট মাঠে স্ট্যান্ড বাই, সবচেয়ে বাজে দুটো ভূমিকা।
আমার পাশের সেই অবাককুমার প্রথম ডেলিভারি দিল ভুবিকে, ভালো পেস, ভালো ক্যারি। হাত তুলে ছেড়ে দিল সে, তারপর পাশের নেটে শিখর ধাওয়ানের দিকে কী একটা ইশারা করে দুজনেই হাসতে হাসতে ছুটলো ড্রেসিং রুমের দিকে। নেটে এসে দাঁড়িয়েছে উমেশ যাদব।
আমি উমেশের ফ্যান, বোলিং তো বটেই ওর চেহারাও কম কিছু যায় না। গাভাসকার ভিভিয়ান রিচার্ডসকে নিয়ে লিখেছিলেন, ভিভ যখন শার্ট খুলে দাঁড়ায়, মনে হবে পেশিগুলো আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। উমেশও চেহারায় গায়ের রঙে পুরো ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান। আমার প্রথম বলটা গুড লেন্থে পড়ল, কত আর — একশো বাইশ-ফাইশ হবে। প্রথম বল বলেই বোধ হয় ব্লক করলো ব্যাটসম্যান, আমি ফলো থ্রু-তে কুড়োতে গিয়ে বললামঃ ইন্ডিয়া মেঁ সিরফ আপ হি জেনুইন ফাস্ট বোলার হো স্যার, ম্যায় আপকা বহোত কদর করতা হুঁ।
— ভাগ সালা! আয়া হ্যায় কদর করনে।
খেলোয়াড়দের মুখ ভালো হয় না, চরিত্রও নয়, কিন্তু মনটা জেনুইন। এই চার বছরে কতো যে খিস্তি শিখেছি। বোলিং রান আপে ফিরতে ফিরতে শুনলাম, কেউ চিৎকার করে বলছে ছোটা ফেঁকো। মনে হয়, মাছওয়ালাই।
পিচে প্রচুর সবুজ, থ্রি কোয়ার্টার লেন্থে মারতেই দুব্বোর গোড়ায় পড়ে লাফালো, সাঁই শব্দ শুনলাম যাদবের ব্যাটে, বল স্কোয়্যার লেগ বাউন্ডারি টপকে চলে গেছে।
পর পর পাঁচটা ডেলিভারির এক দশা। অবাককুমারের বলগুলো ব্লক করছে, আমারগুলো ওড়াচ্ছে। ভালো বলতে গিয়ে কি শত্রুতা করে বসলাম রে বাবা! খুব আশা করছি, মোটা লোকটা এবার আমায় অব্যাহতি দেবে। কোথায় কী! পঞ্চম ছয় মাঠ টপকে গ্যালারিতে চলে গেল আর এদিকে বল কুড়োতে বসে থাকা দুটো বাচ্চা র্যা ম্পে উঠতে দোনোমনো করছে। যাদবভাই এগিয়ে এলো ব্যাটটা আমার দিকে বাড়িয়ে। ক্যা রে খজুর, কৌন ওয়াপস লায়েগা গেঁদ, তেরা বাপ?
চার
গ্যালারির নিচেটা কেমন শান্তমতো; ছেঁড়া পোস্টার, সিগারেটের খালি প্যাকেট, চায়ের কাপ — উৎসব শেষের চিহ্ন সব। আর প্রভূত নামধাম লেখা কংক্রিটের গায়ে — শীলা প্লাস অমিত, দুর্জয় প্লাস রেহানা, মাহি (পাশে লাভ সাইন)। ভাগ্যিস অনুর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, নইলে আজকের এই ক্যালানি খাওয়াটা নির্ঘাত খবর হয়ে যেত। অনু প্রেম করছে রাজর্ষির সঙ্গে, আমার চেয়ে দু’বছরের সিনিয়ার, মোহনবাগানের প্রথম পনেরোয় থাকে। একই দেহে রাজা এবং ঋষি, নিশ্চয়ই ওর মধ্যে উচ্চাশার কোনও অভাব পায়নি মেয়েটা।
বল নিয়ে ফেরার সময় চোখে পড়ল ড্রেসিং রুম থেকে বেরিয়ে দুলকি চালে মাঠে পদার্পণ করছেন নীল টি-শার্ট সাদা শর্টস ভুঁড়িযুক্ত সুদূর লম্বা রবি শাস্ত্রী। কেননা প্রথম নেটটায় ঢুকেছে রাহানে, এই মুহূর্তে ফর্ম হাতড়ানো একমাত্র ভারতীয় ব্যাটসম্যান। সঞ্জয় বাঙ্গার বল ছুঁড়ে দিল অ্যালবার্ট স্টিফেনকে।
রাগ মানুষকে দিয়ে কতো ভালো ভালো কাজ করিয়ে নেয়, অথচ আমার রাগটাই হয় না। তবে পরের বলগুলোর একটাতেও ছক্কা খেলে চলবে না। বোলিং মার্কে ফিরতে গিয়ে দেখে নিয়েছি লং অফ গ্যালারির থামের আড়ালে একটা চেনামুখ উঁকি দিচ্ছে — দেবুকাকু।
রান আপের শুরু পিছিয়ে দিলাম পাঁচ পা। যাদবভাই আমাকে দেখিয়ে মাছওলাকে কিছু বলছে এবং দুজনে হাসছে যৌথ উদ্যোগে। আমি বিড়বিড় করে বললাম, কাকে বললাম কোনও আইডিয়া নেই — একটা একশো চল্লিশ দিও, ওয়ান ফট্টি, কেমন? আর শুরু করলাম দৌড়।
পুল মারবে বলে আগে থেকেই শরীর বাঁদিকে মুড়ে নেওয়ায় ডান হাত এক্সপোজড হয়ে গেছিল যাদবের। ফটাস করে শুধু একটা আওয়াজ শুনলাম, আর্ম গার্ডের ঠিক নিচে লেগেছে বলটা, ওই কাল আমার যেখানে ছেলে গেছিল। মুখ দিয়ে কাতরোক্তি বের হল, হুড়মুড় করে উইকেটের ওপর ভেঙে পড়ল ভারতীয় ফাস্ট বোলার।
(চলবে)
loading...
loading...
স্পোর্টস। পুরোপুরি আলাদা মানের লিখা উপহার প্রিয় চন্দন দা। অভিনন্দন।
loading...
প্রথম অংশ পড়লাম কবি দা। বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য লেখাটা সামান্য কঠিন মনে হতে পারে। প্রণাম।
loading...