বারো ঘন্টা প্লাস
(পঞ্চম পর্ব)
রাত দশটা ষোলো
প্ল্যাটফর্মের এইখানে বউটা বসে থাকত প্রতিদিন। ঠিক সেই দাগ-ধরা জায়গায় নিশ্চল হয়ে থাকে মীনকেতন। যেন স্কুলে তাদের নাটকের রিহার্সাল, নির্দেশক মেঝেয় চকখড়ির গোল এঁকে তার মধ্যে দাঁড়াতে বলে গেছেন। আশপাশের দোকানের ঝাঁপ ফেলা, শনিমন্দিরের বাক্স যদিও প’ড়ে, তার পেটটি শুনশান। শুধু শূন্য রাস্তায় শালিখ যেমন খাবার খোঁজে, প্ল্যাটফর্মের দূরে দূরে দু’একটা লোক কী যেন টুকিয়ে বেড়াচ্ছে।
মোবাইল বের ক’রে সে সময় দ্যাখে এবং সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যায়। আবার জ্বালায় ফোনটা। এবার ভুল হাত লেগে মেসেজ-বক্স খুলে গিয়ে আঁখির পাঠানো তিনটে এস এম এস (সে মোটেই দেখতে চায়নি) — নিজে সুইসাইড করবে এই ধমকি দিয়ে শুরু করে ‘তুমি কিছু করে ব’সো না’ এমন অনুরোধে অন্তিম। মেয়েটা ভয় পেয়েছে। খ্যাপাকে তো ভরসা নেই, মরেটরে গেলে সে নির্ঘাত ফাঁসবে। অফ কোর্স, আঁখি তাকে ভালোই বাসে। ‘কেন ভালোবাসো, সোনা’ এই প্রশ্নের উত্তরে সে জানিয়েছিল, যেহেতু ভালো থাকতে চাই। আর স্বার্থপরতার উদাহরণ তুললে স্লোগানকারীর গলায় বলত, সবাই স্বার্থপর।
আঁখিদের হাউজিং থেকে নেমে চারপাশ রক্তাক্ত করে রাখা বড় কৃষ্ণচূড়া গাছটা মনে পড়ছে। তারপর অনেকক্ষণ অন্ধ মাতালের মতো ঘুরতে ঘুরতে আবার সে চিনতে পারে — ফুটপাথের বকুলবৃক্ষ। ওহ, এটা তাহলে লোয়ার সার্কুলার রোড! কতদিন পার্ক স্ট্রিট থেকে ঢাকুরিয়া টানা হেঁটেছে দুজনে। আজ একা উজান বাইতে বাইতে সে ওই সবুজ হল্ট স্টেশনগুলো পার হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটা গাছের নিচে মীন হাঁটু মুড়ে বসে গোছাতো বকুল আর তার প্রিয় ভিজে করতল ভ’রে দিত ফুলে। তাদের কত আবশ্যক ঝগড়া মুছে দিয়েছে এই ছায়াগাছেরা…।
বন্ধ ঘরের মধ্যে চার ঘন্টা একটা ফড়িং তাড়া খেয়ে উড়লে তার উড়ানের গ্রাফ যে জটিলতম রেখারাশি দেবে, তেমন করে সে ঘোরে শহরটায়। …কেননা, কেউ চায় যে কোনও মূল্যে ভালো থাকতে। আর কেউ ‘ঠিক থাকা’-র বাইরে ভালো থাকতে জানে না। এইভাবে জীবন থেকে জীবন ছিঁড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।
ট্রেনে উঠে আবার সুলতানার কথা মনে আসে মীনের। রাত অনুযায়ী যথেষ্ট ঠাসাঠাসি কামরায় দাঁড়িয়ে প্রাণপণে ওর হাতদুটো ভাবতে চেষ্টা করে। ফ্যাকাসে রক্তহীন করতল ও তাতে গভীর কালো রেখা? ঝাঁকা ওঠাতে নামাতে হাতের রুগ্ন পেশি ফুলে উঠেছে, তাই না? কেন সে ভালো করে লক্ষ করেনি এতদিন! মজিলপুরের কোন গ্রামে মেয়েটি জীবিত হয়ে থাকবে, আর জানা সম্ভব নয়…!
আজ আঁখিদের টয়লেটে ঢুকেই তার রুম ফ্রেশনারের স্মৃতি ফিরে এসেছিল। প্রায় চার বছর আগে এমনই একদিন সে অফিস কেটে গিয়েছিল ওর ফ্ল্যাটে। তুমুল আদর-বিনিময়ের পর দুজনে যখন ভদ্রস্থ, আঁখি শোয়ার ঘরে ঢুকে নাক টানতে থাকে।
— গন্ধ পাচ্ছো না?
— কীসের গন্ধ?
— এতক্ষণ যা করলে তার, ক্যাবলা-কেষ্ট! আসলে, তুমি ঘরেই রয়েছ বলে বুঝতে পারছ না। ছোটপিসি আসবে বললাম না একটু পরে? ঠিক টের পেয়ে যাবে। দাঁড়াও, ব্যবস্থা হচ্ছে।
চালাকিতে অন্যকে হারিয়ে দেওয়ার এক মহামহিম আনন্দ আঁখির চোখে লেগে ছিল। মীনের অভিজ্ঞতায় সেই প্রথমবার রুম ফ্রেশনারের ব্যবহার তার সামনা-সামনি। আর আজ দ্বিতীয়, তাকে দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে।
টলতে টলতে যখন সে বেরিয়ে যাচ্ছে, আঁখি আর আটকায়নি।
— আসলে কী জানো তো? তুমি অসাধারণ! আর আমি খুব সিম্পল মানুষ। তোমার কল্পনাশক্তির সঙ্গে তাল দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। ভালো থেকো বাবি, নিজগুণেই ভালো থেকো।
‘অসাধারণ’ শব্দের বিস্ময় সঙ্গে নিয়ে সে এতক্ষণ পথ ঘুরেছে। তারপর একসময় মনে হল, সবটা তো ব্যর্থ হয়ে যায়নি! তার মতো একটা হৃদয়হীন আত্মকেন্দ্রিক অগ্নিশুদ্ধাকে যখন প্রথম বলেছিল ‘ভালোবাসি’, ভাবতে পেরেছিল কথাটা একদিন কি অসহায় গোঙানিময় সত্যি হয়ে যাবে! ঘুম থেকে উঠে টেলিফোনে গলা না শোনা পর্যন্ত তার দিন থেমে থাকে। রাতে মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে যতক্ষণ না তাকে ফোন করছে আঁখি, পড়ার টেবিলে বসে ঝিমোয় সে। এই কি প্রেম? এটাই কি প্রেম নয়? মীন তবে সত্যিই প্রেমিক! তাহলে ভেবে দ্যাখো, অন্তত একটা জায়গা আছে জীবনে, যেখানে তুমি ফাঁকি দাওনি, বরং নিজেকে ছাপিয়ে যেতে চেয়েছ বারবার। দরজার ঠান্ডা হাওয়ার দিকে যেতে ইচ্ছে করে মীনকেতনের, আজ ঠিক যেভাবে সে অগ্নিশুদ্ধার শরীরে যেতে প্রস্তুত হচ্ছিল। কারণ আজই বুকের নিচে পাওয়া আনন্দমাখা নগ্নদেহকে বলত, কী চাও জীবনের কাছে স্পষ্ট করে ভাবো; আর সেটাই প্রকাশ করে দাও নিজের বানানো ইমেজ থেকে বেরিয়ে এসে।
তার সামনে গোল চেহারার অল্পবয়েসি একটা বউ দাঁড়িয়ে, গা-ঘেঁষে এক পুরুষ খুব তৃপ্তমুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কথা বলছে। বোঝা যায়, এদের মধ্যে কোনও মহাজাগতিক টেনশান নেই। তাই হয়তো বউটার বাঁকাঁধের নিচে বৃষ্টিফোঁটার মতো ঘামের তিনটে আঙুরবিন্দু অপেক্ষা করছে —- প্রেমিক কখন জিভের মরুভূমিতে তাদের শুষে নেবে। এবং তখনই এক ভীষণ ঝাঁকুনি পেয়ে মীন আবিষ্কার করে ওই ঘামবিন্দুর ঠিক নিচেই বউটার পিঠের ওপর বসে যাচ্ছে তার দাঁত। ফলে সে-বউও হুমড়ি খেয়ে পড়ল সামনের লোকের গায়ে, সামনের যাত্রী আবার…। ছোটবেলায় একটু ফাঁকা ফাঁকা ইঁট দাঁড় করিয়ে রেখে প্রথমটা ঠেলে দিলে যেমনটা হতো। কিন্তু প্রায় তৎক্ষণাত সারি-পতন থামিয়ে গোটা তিন-চার হাত তাকে টেনে সোজা করেছে।
‘শুয়োরের বাচ্চা, মা-বোনদের বডিতে হাত?’ বউটা হিস্টিরিয়া রোগির মতো তার চিৎকার থামাচ্ছে না, ফলে ওই আস্ফালন পরিবেশের সঙ্গে চমৎকার খাপ খেয়ে যায়। ‘চল বাঞ্চোত, আজ রাতটা জি আর পি-র লকাপে কাটাবি। নামা তো মালটাকে। না না, কেউ গায়ে হাত দেবেন না’। হাঁ-হতবাক মীনকেতন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পায়, একদল ছেলের ঘেরাটোপ তার পেছনে, পাখি ধরার আঠালো জাল যেন। ‘কী হয়েছে ভাই’ ব’লে যারা এগিয়েছিল, যুবকদের রহস্যময় সংগঠন দেখে উদ্যোগ হারাল।
খুব কী ভয় পেল মীন? নাকি সারাদিনের ক্লান্ত পাদুটো ওই বালা-পরা হাতের শ্রেণীতেই ভর দিয়ে দাঁড়াক কিছুক্ষণ! এবং পরের স্টেশনে যখন ট্রেন থামছে, পাশের ছেলেটাই, নামাতে সুবিধে হবে ভেবে হয়তো, তাকে আচমকা চড় কষাল।
মাথা ঘুরে ওঠে মীনকেতনের, আঘাতের শক্তি আর অপমানে। আর কী আশ্চর্য, আবার পেয়ারার গন্ধ মনে পড়ে যায়, শুকদেবদার গাছের পেয়ারা। গরমকালে স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে তাদের নিয়মিত টার্গেট ছিল স্কুল-পাঁচিলের সীমানা-ঘেঁষা গাছটা। শুধু এক কার-মুখ-দেখে-উঠেছিলাম দুপুরে শুকদেবদা দৌড়ে বেরিয়ে এসে তাকে ধরে ফেলে, টেনে বাগান-লাগোয়া ছোট্ট খুপরিঘরে নিয়ে যায় এবং আর কিচ্ছু করে না, শুধু শরীরের সমস্ত ক্ষমতা জড়ো করে পঁচিশ বছরের জোয়ান তার জীবনের শ্রেষ্ঠ চড়টি দশ বছরের বালকের গালে বসিয়ে দেয়।
স্টেশনে নামিয়ে তাকে উলটো দিকে ঠেলে নিয়ে চলেছে যে যুবগোষ্ঠী, তার সদস্যসংখ্যা দশের অর্ধেক হবে। ইতিমধ্যে এদের একজন খুব যত্ন করে তার পুরুষাঙ্গ কেটে নেওয়ার ইচ্ছে জানিয়েছে। ছেলেটি সম্ভবত কথা বলতে ভালোবাসে। তাই, ‘বাঁড়া, গাছেরও খাবি, তলারও কুড়োবি’ বলার পর যুক্তিপূর্ণভাবে শুরু করে, ‘তুমি শালা ভদ্দরলোক হয়ে যদি ছোটলোকের সঙ্গে ন্যাকড়াবাজি করতে যাও…’ এবং এই পর্যন্ত এসে, হয়তো কারও ইশারায়, শিক্ষাদান থামিয়ে দেয়। প্ল্যাটফর্ম শেষ হলে এবার রেললাইনের খোয়ার ওপর দিয়ে সগৌরবে হাঁটানো হচ্ছে মীনকেতনকে। দূরে লাল-সবুজ সিগন্যালের চোখ গড়িয়ে জল নামল কি? এমন ভাবুক ও অত্যাচার-প্রত্যাশী ভিকটিম জীবনে পাওয়া যায়নি বলে সবাই খুব উৎসাহিত, ‘একটু চেঁচাল না মাইরি, যেন জামাইষষ্ঠী খেতে যাচ্ছে’।
বলো, কেন সে আওয়াজ ওঠাবে? কে আছে এই পৃথিবীতে যে নিজের ইচ্ছে মতো জীবন কাটানোর সুখের চেয়ে তার ভালোবাসার মানুষটাকে বেশি গুরুত্ব দেয়? যে শিক্ষিত লোকজন গুছিয়ে পোষাক পরে চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার সঙ্গে কোথায় তফাত এই চার-পাঁচটা মাতাল-মস্তানের? আজ দুপুরে তার মন ধ্বংস হয়েছিল, এই রাতে শরীরের বিনাশ হবে, তফাত এইটুকুই তো?
মাথার ওপরে যেন দড়ি দিয়ে ঝোলানো ভাঙা চন্দ্রমা, নিচে জনা চারেক ছেলে তাকে আধাচাঁদের মতোই ঘিরে ধরে মুখে ঘুষি চালাচ্ছে, আর দুহাতের আড়াল দিয়ে মীনকেতন কোনওমতে ঠাকাচ্ছে আঘাতগুলো। নিখুঁত পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে এবার একজন একটু দূরে সরে গেল, এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিয়ে চট করে হাত ঢোকাল প্যান্টের পেছনের পকেটে। ওমনি মীনের তলপেট গুটিয়ে ছোট হয়ে গেছে, কেঁপে উঠে কাঁটা দিল সমস্ত শরীর। ফুলে ওঠা চোখে জীবন আর স্পৃহা-র বিখ্যাত জুটিকে এবার যেন সে আবছা দেখতে পেয়েছে। দুটো বাড়তি হাত মীনের এখুনি দরকার নিজের পাকস্থলি বাঁচানোর জন্যে। অথচ ঠান্ডা ভিজে শ্যামবর্ণ দুই করতল সে আর এ-জীবনে পাবে না।
(শেষ)
loading...
loading...
গল্পের প্লট, পাত্রপাত্রী এবং সংলাপ গল্পটিকে নিয়ে গিয়েছে স্বতন্ত্র এক মাত্রায়। স্বভাব সুলভ বর্ণনা শৈলী এবং গল্প শেষের পটভূমি নিবিড় পাঠকের বহুদিন মনে থাকার কথা।
শুভেচ্ছা এবং সম্মান প্রিয় চন্দন দা। এভাবেই শব্দনীড় এর পাশে থাকুন। ধন্যবাদ।
loading...