বারো ঘন্টা প্লাস
(তৃতীয় পর্ব)
— এই, না না। আমাকে একটু দিদির ফ্ল্যাটে যেতে হবে। বেরবো বলেই শাড়ি বের করছিলাম, ফোন ধরতে এলাম এ-ঘরে। নেক্সট উইকে একটা ডেট করো। আহ, আবার কলিং বেল বাজছে। এখন বেরনোর সময় কে মরতে এল! একটু রাখো, আমি ব্যাক করছি।
— দরজা খুলে কাকে দেখতে পাবে, আন্দাজ করো।
— এই-ই, তুমি নাকি! কী আশ্চর্য! দাঁড়াও, দাঁড়াও, ঘরটা যা অগোছালো করে রেখেছি। বলে আসতে হয় তো।
আঁখির গলার স্বর আবার দূরে চলে গেছে। মীনের অপেক্ষার মুহূর্তগুলো অনন্তে না হোক, চাঁদে পৌঁছোয়। ফ্ল্যাটের মধ্যে কিছু একটা উলটে পড়া আর আঁখির বিরক্তির শব্দ একসঙ্গে কানে এল। শেষ পর্যন্ত দরজা খোলে সে, ঘামা-নাওয়া, বিভ্রান্ত আর একটুখানি খুশিও। তার দীঘল শ্যামরঙ শরীর থেকে বডি লোশনের গন্ধ বন্দুক তুলে আছে। সোফায় বসতে বসতে মীন টের পায়, গন্ধটা আসলে রুম ফ্রেশনারের।
—বাব্বাঃ, ঘর যে আমোদিত! এটাও কি নতুন ওভ্যেস?
বলতে বলতে মীনের নজরে পড়ে, তার মা যেমন দামি শায়ার ঝুলে লেস বসাতেন, আঁখির নাইটির গলায়, দুহাতে আর পায়ের দিকে এমব্রয়ডারি-করা লেস লাগানো। যে কোনও নতুন পোষাকেই আঁখিকে অপ্রতিরোধ্য সুন্দরী লাগে, কিন্তু সে কথা থাক…।
—তুমি যে বললে দিদির বাড়ি যাওয়ার জন্যে শাড়ি পরে ফেলেছ?
অগ্নিশুদ্ধার চোখের কোনে রাগ ছোট ট্রেলার দেখিয়েই বিষন্নতায় বদলে গেল। ওর তো জানাই, অবিশ্বাসপরায়ণ প্রেমিক এই প্রশ্নগুলোই করবে।
— মীন, আমি তোমাকে বলেছিলাম, শাড়ি পরছি, শাড়ি পরে ফেলেছি একবারও নয় কিন্তু। নিজের মনগড়া কথা আমার মুখে বসানো কি ঠিক? আরও বলছ, রুম ফ্রেশনার নাকি ব্যবহার করি না। ইউজ করব না যদি, শুধু শুধু কিনে আনলাম? ছোট ছোট ব্যাপারেও এত সন্দেহ জমিয়ে রাখলে ভালোবাসবে কখন, সোনা!
স্কটিশের ইংলিশ অনার্স, ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাংকের টেলর কাউন্টার সামলানো মেয়েটার পরিশীলন দেখবার মতো। রিনরিনে মিষ্টি গলার এই অদা-ই মেরেছে মীনকেতনকে। সে প্রশ্ন করে না, ভেতরের ঘরে শাড়ি পরতে থাকলে দেড়খানা রিংয়ের মধ্যেই বসার ঘরে এসে ফোন ধরা কীভাবে সম্ভব? অভিজ্ঞতা বলছে, সমাধান কোনও সমস্যাই নয় আঁখির কাছে। নিখুঁত যুক্তি আউড়ে মীনকে সে চুপ তো করাবেই, গাইবে সেই ধুয়োটাও — এত সন্দেহবাতিক নিয়ে চললে আমাদের ঝগড়া কোনওদিনও থামবে না! সোনা, তুমি কি প্লিজ একটু কাউন্সেলিং করাবে?
আঁখি উঠে গিয়েছে রান্নাঘরে আর তক্ষুনি “একদিন তেরি বাহোঁ মেঁ” বেজে উঠল চিৎকার। মীন বেল বাজালে সে যেমন বিরক্ত হয়েছিল, তেমনি গজগজ করতে থাকল।
— ঠিক দেবযানী বৌদি। আর ফোন করার সময় পেল না। এখন ধরলে মিনিমাম চল্লিশ মিনিট।
—তাহলে বলে দাও যে ব্যস্ত আছো।
— না বাবা, ধরবোই না।
কিন্তু মীনকে উঠে আসতে দেখেই সে দ্রুত ডাইনিং টেবিলে পৌঁছে মোবাইল তুলে নেয়। মীন তার হাতের ওপর থেকে চোখ সরায় না বলে বুঝতে পারে, আঁখির ডানহাতের বুড়ো আঙুল অ্যাকসেপ্ট বাটন ছোঁয়ার ভঙ্গি করে রিজেক্ট নব টাচ করল, গান থামা মাত্র বলল ‘হ্যালো’ এবং একই নিঃশ্বাসে, ‘যাহ, কেটে দিয়েছে’।
গত একবছরকাল মীনের উপস্থিতিতে সে ফোনটা বন্ধ বা মিউট করে রাখে। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, গোপনীয়তা সম্পদে অনেক ধনী অগ্নিশুদ্ধা। তাই উন্মোচনবিরোধী। জীবনকে নানা ঘর, তল আর গবাক্ষে ভাগ করে রেখেছে, যার এক বাতায়নের খবর অন্য কুলুঙ্গি জানে না। আর ঘর থেকে ঘরে অনুপ্রবেশের মুখে শক্ত করে তোলা মিথ্যের দেয়াল। এই মুহূর্তে তেমনই কোনও এক বাসভূমিতে সে মীনের সামনে নামাল লিকার চায়ের কাপ। মীনের চোখে ঝলসাতে থাকল তার শ্যামবর্ণ বাহুমূল, কনুই থেকে অপ্রশস্ত নিচের হাত আর ছোট নাজুক কবজি। সিনেমা হলের অন্ধকারে যতবার আঁখির পাতলা ভিজে ভিজে প্রচুর কাটাকুটিময় করতল নিজের হাতে তুলে নিয়েছে, ততই নিজেকে মনে হয়েছে ষোল বছরের এক কিশোরির প্রেমিক। এবং ভেবেছে, তার স্বপ্নের ডানা এরাই। এখন চায়ে প্রথম চুমুক দিয়ে মীনকেতন পাশের সোফা দেখাল।
— একটু বসবে? কথা ছিল…।
(চলছে)
loading...
loading...
শ্বাস থামিয়ে থামিয়ে পড়লাম। আপনার গল্প বা কবিতা বা জীবন ঘেঁষা সম্পৃক্ত লিখা সব সময়ের জন্য অনন্য এবং অনবদ্য প্রিয় চন্দন দা। আপনি স্বতন্ত্র। স্যাল্যূট।
loading...