আমিই সেই আহীরী
এক
ঘরের দুটো জানলাই কখনও একসঙ্গে খুলে দিই না আমি। সহ্য করতে পারি না প্রেসক্রিপশান-বহির্ভূত অতটা আলো, যারা তাদের দোলখাওয়া সবুজ ঘরবাড়ি থেকে ছুটে এসে আমার চোখের তারাদুটো খেয়ে নেবে, মমি বানিয়ে দেবে মুখটাকে।
কিন্তু আজ নিরপরাধ অঘ্রাণ-সকালের হলুদ দীপ্তির মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি হাট করে দিলাম আমার দ্বিতীয় ফুসফুস। হেমন্তের মচকা তাত শরীরে এসে লাগল। সুতো-সুতো খুশি জড়ালো ঘুমহীন হাসপাতালে ছোটা থেকে অফিসের পেপার-ওয়েটের নিচে চাপা পড়া এ-পর্যন্ত আমার সবক’টা আত্মায়।
আমার মনে পড়ল তোমাকে।
নাকি তুমিই ছুটে এলে আমার ভেতরে, অতীতসঞ্চার? যেমন বেড়াতে নিয়ে যাবে শুনলে এ-কোল থেকে ও-কোলে ঝাঁপিয়ে যায় শিশু!
দুই
আজও শেষরাতের ঘুম ভেঙে ভারশূন্য ঋদ্ধিশূন্য মাথা অন্ধকার ঘরে ধড়মড় করে উঠে খাট থেকে পা নামিয়ে চপ্পল খোঁজে। খুব দেরি হয়ে গেল, বুঝি! তোমাকে সকালের ফোন করতে হবে না? তারপর মনে পড়ে, সতীদাহ বা গুটিবসন্তের মতো বহুদিন সে-প্রথা আমরা নির্মূল করেছি। তখন মাথা ঝুঁকিয়ে বসে থাকা কিছুক্ষণ। সকালের চলাফেরা একগাছি খড়ের বাঁধন খোলা পালংপাতার মতো বারবার এলিয়ে যেতে থাকে।
তিন
আজ এই হালকা গলা-ব্যথার রবিবার বাজারে গিয়ে মাংসের দোকানের সামনে দাঁড়ালাম, নতুন ক’রে দেখে নিই ইতরের মুন্ডু ঝরে যাওয়া। তাকে দুজন লোক যখন দোকানের বধ্য-বারান্দায় নিয়ে আসছে, খাসির ভাঙা গলার চিৎকার হ’ল নষ্ট হওয়ার আগে সম্পর্ক তাক করে ছোঁড়া কাচের শেষ বাসনগুলো। এবার ছুরিতে দুফাঁক ক’রে দেওয়ার পর গলার নলির একমুঠো টগর আর চারপাশে রঙ্গনের উৎসারিত ঢেউ তার সারা শরীরে গণবিক্ষোভ ও সত্যাগ্রহের জন্ম দিচ্ছে, মণিপুরী নগ্ন মেয়েদের আইন অমান্যের মতো। এখন শক্ত করে ঠেসে ধরা চাই আমার শরীর — দুটো পা সাইকিয়াট্রিস্টকে দিয়ে দিন, এবং আরেক মনোবিদের কাজ হল নজরে রাখা পেশেন্টের হাত দুখানাও যেন খোলা বাতাসে ছড়িয়ে না যায়।
লক্ষ করুন, এই প্রতিরোধের ডোজ একদম ঠিকঠাক পড়েছে বলেই আমার ক্রমহ্রাসমান তলপেট এখন নিজের রক্তের বিছানায়, যার ওপর ওই রক্তেরই বেডকাভার, আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়তে আগ্রহী। বিড়বিড় করে বলছে ‘শান্তি, আত্মসমর্পণ’, কিন্তু চালচিত্রে একটা সাদা পতাকার অভাবের জন্যে কেউ আমার সন্ত্রাসবিরোধী মনোভাবে খুব একটা আস্থা রাখতে পারল না — না চিকিৎসক, না সাইকোথেরাপিস্ট। শেষপর্যন্ত গায়ের লোম খ’সে, চামড়া খুলে যখন ছাগল থেকে এক নির্মীয়মান খরগোশের দিকে চলে যাচ্ছি, এই প্রাণকে তামাদি ঘোষণা করা হয়। কারণ জীবন মানেই ‘ইশ্ছা’, যেমন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস বলেছিল, সুতরাং অসন্তোষও, আর সেখান থেকে জন্ম নেওয়া পালটা-আক্রমণ। অন্যদিকে অসুস্থতা মোক্ষের কাছাকাছি, এবং মরণ হল পরমগতি। যে মরহুম, ধরে নেওয়া হচ্ছে তার ব্যাধিও মারা গেছে। তাই অভিযুক্ত টেঁসে গেলে প্রশাসন যাবতীয় অপরাধের তালিকা ও শাস্তির সুপারিশ ফিরিয়ে নিয়ে থাকে।
কিন্তু অনেক সময় আলাদা কিছু ঘটে যাওয়াও বিচিত্র নয়। যেমন, আমাকে সুশ্রীমতো ধুয়ে-মুছে উলটো করে বাস্তবের মাটিতে লটকে দেওয়ার পরেও দেখা গেল, যেখানে আগে কলিজা ছিল এবং বর্তমানে লেপচাজগত-এর আচমকা ধসনামা শূন্যতা, তিরতির করে কাঁপছে সেই সিনাঅঞ্চল। কাজেই, শিশুদিবসের সকালের বাচ্চারা তাদের অভিভাবকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, “দ্যাখো বাপি, কতক্ষণ বেঁচে আছে ছাগলটা”! জীবিত থাকার ছদ্মবেশে এই চিউইংগাম কায়দায় দেহত্যাগ মেগা সিরিয়ালকেও লজ্জা দেবে ব’লে তৈরি, যখন গ্যাস ওভেনের উপর কড়াইতে খাসির ঠ্যাং ছেড়ে দিয়ে সভয়ে পিছিয়ে আসে বাড়ির নতুন বউ, “ও মাগো, এখনও নড়ছে যে”!
এই লেখাটাকেও এক জাতিস্মর স্নায়ুতাড়না ভাবতে পার তুমি।
চার
খুব মনে পড়ে, মনকষাকষি হলেই বলতে: আমাকে তুমি মোটেও ভালোবাসোনি। ভালোবেসেছ শুধু প্রেমের একটা আইডিয়াকে।
কিন্তু প্রেমকে প্রধানত ধারণা ছাড়া আর কীই বা ভাবতে পারি, বলো? যেন নার্সারি থেকে আনা গাঁদাফুলের চারা — মাটিতে বসালে তবেই না সে উদ্ভিদ!
ধারণা আর আধার — এই দুইয়ের যোগসাজসেই হয়তো সম্পর্ক গড়া হতে থাকে। স্বীকার করছি, নিজেকে কোনওদিন একতিল বাস্তবতা ভেবে শান্তি পাইনি, বরং হাতে-ধরা আমি-র চেয়ে আয়নায় প্রতিফলিত ছায়াই চিরদিন বেশি আদরের ছিল নিজের কাছে। এই শরীরকে যখন আত্মপরিচয়ের বদলে অঘ্রাণ মাস ভাবি, পাইনগাছের মাথার কুয়াশাপাগড়ি ভাবি, বা দু’পা পঙ্গু ভিখিরির ময়লা হাতের কয়েন একটাকা-দুটাকা, ফুরফুর করে ওড়ে কপালের ওপর আমার মাথার চুল।
সবাই জেনে গেছে, তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না কোনওদিন। দুটো মানুষ মনে-মনে ইচ্ছে না করলে তাদের তো ইহজীবনে দোকানদারি হয় না! তবু একটা পছন্দের রূপকথা আছে আমার, প্রেমের পেয়ারাডাল ভেঙে ধরাশায়ী সব প্রেমিকই বুঝি জাতিস্মর মোটর নিউরোনের তাড়নায় কেঁপে উঠে স্বপ্ন দ্যাখে — প্রেমের ওপর সে নিজস্ব কায়দায় শোধ নেবে, ছোটবেলায় পড়া গল্পের গরীব গয়লানির মতো। মাথায় দুধের মট্কি নিয়ে মেয়েটা রোজ বাজারে যেত। তো, একদিন হাঁটতে হাঁটতে ভাবছে, এই দুধ বেচে লাভ ক’রে আরও বেশি দুধ কিনে সেই দুধ বিক্কিরি করে অসীম মুনাফা অর্জনের পর সে এমন অনাস্বাদিতপূর্ব বড়লোক হয়ে যাবে যে দেশের রাজপুত্রও বিয়ে করতে চাইবে তাকে। কিন্তু মেয়ে তখন ঘচাং করে খারিজ করে দেবে নবাবজাদাকে। মাথা নাড়িয়ে বলবে, না না না …।
আমিও ভাবি, কস্মিনকালে দেখা না হয়েও একদিন অকস্মাৎ মুখোমুখি পড়ে তো যেতে পারি আমরা। গিরিশ পার্ক মেট্রো স্টেশানে? বেশ, তাই হোক।
তুমি এগিয়ে এসে ইতস্তত গলায় বললে, কেমন আছো!
রোগা হয়ে গেছ এতটা? নিশ্চয়ই এখনও না খেয়ে অফিসে চলে যাও?
আহা, আমার ওপর রাগ করে কবিতা লেখাই বন্ধ করে দিলে!
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম, যদিও আমার স্বভাব সিগারেট ও নীরবতাবিরোধী। তুমি আরও একটু অস্থির: আচ্ছা বাবি, সব ঝগড়া ভুলে আবার প্রথম থেকে শুরু করা যায় না! ধরো (গলা ধ’রে এসেছে) মাঝখানের দশ বছর মিথ্যে, দুজনে ফিরে গেছি শুরুর দিনটায়। তুমি আমার হাতে সদ্য বেরনো কবিতার বই তুলে দিচ্ছ, আর সেই আগের মতো আমি দেমাক দেখিয়ে বললাম, ‘পড়ব নিশ্চয়ই, কিন্তু মতামত দিতে অনুরোধ করবেন না, প্লিজ’!
না গো, বলব না। পুরনো ভুলগুলো আমরা কেউ করবো না আর কখনও, দেখো তুমি।
তখন মনে হল, আমার গায়ের রঙ পরিপক্ক চাপা, টলটলে স্বাস্থ্যের ওপর হলুদ ডুরে শাড়ির গাছকোমর। আমার মাথায় গাগরিভর্তি ছলছলাৎ। আর সামনে তুমি — ফর্সা, উচ্চাকাঙ্খী এক অস্ত্রসমাবেশ! এবার বহু বছর ধরে রিহার্সিত সেই ছোট পংক্তির ডায়লগ বের করে আনছি চিত্রনাট্য থেকে, এক্সপ্রেশানে গন্ডোগোল না করে বসি, যেন প্রতিটা অক্ষরে সমান জোর পড়ে:
না বাবি, এখন আর সেটা সম্ভব নয়”।
বাক্য শেষ। এবার সান্নাটা! ড্রপসিন আপেলের মতো পতনমুখী। “এখন আর সম্ভব নয়” বলতে বলতে আকাশ থেকে পাখির ঝাঁক উধাও হচ্ছে। “সম্ভব নয়” — যাত্রাপালায় ঝাঁঝর বাজল তুলকালাম “ঝং” করে। দন্ত্য স, ম আর অন্তস্থ য়-এর ভেতরের সেলাই খুলে গিয়ে তিনটে পোকায় কাটা আলাদা দাঁতের টুকরো…।
আমার মাথা থেকে খসে প’ড়ে, প’ড়ে চুরমার হয়ে, হ’য়ে ভরপুর মৃত্যুর মধ্যে মিশে যাচ্ছে ওরা দুজন — ধারণাপূর্ণ দুধ আর মাটির কলসাধার।
loading...
loading...
একান্তই মুগ্ধ পাঠ। বর্ণনা এবং সচরাচর যে শব্দ বা অনুভব গুলোন প্রকাশ খুবই জটিল
… আপনার কলমে সেটাই উঠে আসে। প্রত্যেকটি লিখাই অসম্ভব প্রাঞ্জল।
শুভেচ্ছা জানবেন প্রিয় চন্দন দা। চলুক সাহিত্যের নিবিড় চর্চা। এভাবেই।
loading...