ছোটদের গল্প কুইন অ্যান এবং লাভা-র ভূত (শেষ পর্ব)

ছোটদের গল্প :
কুইন অ্যান এবং লাভা-র ভূত (শেষ পর্ব)

কাল থেকে চিরকুটটা একবারও দেখিনি, সকালেও না! মেনে নিচ্ছি, ভোরবেলা ঘুমচোখে আমার নজরে নাও পড়তে পারে। কিন্তু ঘরের সদর দরজা তো বন্ধ এখনও, আর পেছনের গভীর খাদ বেয়ে ব্যালকনিতে উঠে আসা কোনও মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। জিনিয়া ম্যাডামকে বলতেই জোরে জোরে মাথা নাড়াতে লাগলেন, “দো দিন পহলে ভী উসি রুম মেঁ বোর্ডার থা”।
গিজার খারাপ হতেই পারে না।

আমার পেছন-পেছন কাঠের সিঁড়িতে দুম-দুম করে পা ফেলে বিনোদ চলে এল। তারপর বাথরুমে ঢুকেই “কিসনে কিয়া ইয়ে বদমাসি” বলেই ছিঁড়তে গেছে গিজারের সুইচের গায়ে লাগানো সেই চিরকুট। আমার হঠাৎ কেন জানি না মনে হল, একটা ভয়ংকর ভুল করতে যাচ্ছে ছেলেটা যা পরে আর কিছুতেই শোধরানো যাবে না। পেছন থেকে ওর জামার কলার ধরে দিলাম এক হ্যাঁচকা টান। টাল সামলাতে না পেরে সে বাঁদিকে কাত হয়ে বাথরুমের উল্টোদিকের দেয়ালে ধাক্কা খেল। তারপর আর একটা পাক খেয়ে এসে পড়ল আমার গায়ের ওপর। আমি স্নানঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, চিৎপাত হলাম সোজা বেডরুমের মেঝেতে।

শোয়া অবস্থাতেই হাঁফাতে হাঁফাতে চিৎকার করছিলাম, “মত ছুঁয়ো! খবরদার”! ইলেকট্রিক মিস্তিরিকে ডাকো, তার আগে কেউ গিজারে হাত লাগাবে না।

এর পরের ঘটনা প্রমাণ করে দিল, বিনোদের শার্টের দুটো বোতাম ছিঁড়ে ফেলার বদলে আমি আজ ওর প্রাণ বাঁচিয়েছি। তুমুল বৃষ্টিতে শর্ট সার্কিট হয়ে সুচবোর্ডসুদ্ধু গিজারটা একটা মৃত্যুফাঁদ হয়েই ছিল। মিস্তিরি এসে যেখানেই টেস্টার ছোঁয়ায়, আলো জ্বলে ওঠে! আর তখন হোটেলে আমার খাতির দ্যাখে কে?

শুধু বিনোদ কেন, কুইন অ্যানের নতুন জীবন — সেও তো ঘড়িবাবার হাতেই পাওয়া!

কিন্তু এত হইচইয়ের মধ্যে মনে মনে অনেকগুলো অংক মেলাতে পারছি না। লক্ষ করলাম, সতর্কবার্তা লেখা কাগজটা সবাই খুঁটিয়ে জরিপ করছে, কিন্তু উল্টিয়ে পেছনের পাতায় নজর দিচ্ছে না। ওদের হাত থেকে নিয়ে কাগজের অন্য পিঠটা দেখতে গেলাম আর ওমনি আরও একটু গন্ডোগোল হয়ে গেল আমার মাথার ভেতরটা।

এদিকে মিসেস জিনিয়া রাই তো আমার কাছ থেকে ঘরভাড়া, খাবার বিল — কিছুরই টাকা নেবেন না। তাকে বললাম, ম্যাডাম বরং আপনার বাবার গল্প বলুন, শুনি। সেটাই হবে আমার পাওয়া সেরা উপহার।

মহা উৎসাহে বৃদ্ধা শুরু করলেন: আমার বাবা প্রকাশ লিম্বু আঠারো বছর বয়েসে পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ সেনা বাহিনির গোর্খা রেজিমেন্টে হাবিলদারের পদে যোগ দেন। বাবা পঞ্চম রেজিমেন্টের চতুর্থ ব্যাটালিয়নে কাজ করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজের হয়ে আড়াই লাখেরও বেশি গোর্খা লড়াই করেছিল। সাহসিকতার জন্যে তাদের মধ্যে দু’হাজার সাতশো চৌত্রিশজন মেডেল পান। জানো, আমার বাবা জাপানের বিরুদ্ধে বার্মার জঙ্গলে যুদ্ধ করে নিজের জন্যে একটা পদক জিতে নিয়েছিলেন। তারপর যে বছর দেশ স্বাধীন হল — আমার জন্মও ওই ঊনিশশো সাতচল্লিশে — বাবা ভারতীয় সেনাবাহিনির এক নম্বর গোর্খা রাইফেলস-এ জয়েন করেন। অনেকে বোঝাল, ব্রিটিশ আর্মিতে থেকে যাও, ওখানে মাইনেকড়ি অনেক বেশি। বাবা বলেছিলেন, এতদিনে নিজের দেশের জন্যে লড়ার সুযোগ পেয়ে ছেড়ে দেব, এতবড় গদ্দার আমি নই।

আমি কমেন্ট করলাম যে, মিস্টার লিম্বুর মতো নির্লোভ মানুষের জন্যে আমাদের গর্ব হওয়া উচিত। আচ্ছা, উনি ঘড়িটা পেলেন কীভাবে?

মিসেস রাই উত্তর দিলেন, গোর্খা রেজিমেন্টে বাবার মেজর ছিলেন উইলিয়াম অসবর্ন নামে এক সাহেব। বাবাকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসতেন এই ভারতপ্রেমিক। শেষে এক নেপালি মহিলাকে বিয়ে করে লোলেগাঁও-এ সংসার পাতেন। তো, সেই অসবর্ন সাহেব তার কুইন অ্যান দেয়ালঘড়ি বাবাকে গিফট করলেন। বাবাও ততদিনে রিটায়ার করে এখানে ছোট্ট রেস্তোঁরা খুলেছেন। বাবার যত্নে ঘড়ি চলতও খুব ভালো। কিন্তু তারপরই অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটে গেল…।

আর মিনিট পনেরোর মধ্যে আমার বাস এসে যাবে। প্রচুর ধস নেমে শিলিগুড়ি যাওয়ার সব রাস্তা একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে ইচ্ছে না থাকলেও আজই সমতলে নেমে যেতে হবে। কিন্তু বিদায় নেওয়ার আগে পর্যন্ত বরফ-সুন্দরী লাভা যেন তার মায়াবী ধাঁধাঁটার জবাব কিছুতেই জানাবে না। আর ফিরে যাওয়ার সময় যত এগিয়ে আসছে, আমিও নাছোড়বান্দার মতো সমাধান কুড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি নানা সূত্র জোড়া দিয়ে দিয়ে।

জিগেস করলাম, মিস্টার লিম্বু কি ঊনিশশো সাতাশিতে মারা যান?
— হ্যাঁ, ঠিক একত্রিশ বছর আগে। কিন্তু তুমি কী করে জানলে!

উত্তর না দিয়ে ওর টেবিল থেকে পেনটা তুলে ওরই প্যাডের কাগজে একটু আঁকিবুকি কেটে তুলে ধরলাম চোখের সামনে:
— দেখুন তো কার সই?
এতখানি অবাক বোধ হয় ম্যাডাম জীবনেও হননি।
— আমার বাবার! তুমি নিশ্চয়ই জাদুবিদ্যা জানো?
কথা ঘোরানোর জন্যে থেমে যাওয়া কাহিনির সুতো ফের ধরিয়ে দিলাম:
— আপনার আপত্তি না থাকলে দুর্ঘটনার কথাটা বলুন, শুনি।

—সে ভীষণ মর্মান্তিক ব্যাপার! অবসর নেওয়ার পর বাবা সকাল-বিকেল দুবেলা নিয়ম করে হাঁটতে বেরোতেন। ঊনিশশো সাতাশির শীতের সন্ধ্যায় লাভা-কালিম্পং রুটের একটা জিপ ওকে ধাক্কা মেরে খাদে ফেলে দেয়। আর্মির লোকজন মানে বাবার ডিপার্টমেন্টের সহকর্মীরাই দেহ উদ্ধার করে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিল।

ম্যাডাম জিনিয়ার গলা ভারি হয়ে এসেছে। এদিকে হাতে সময় বড্ড কম। একটু অপেক্ষা করে বললাম, এবার শেষ ম্যাজিক। আপনার কাছে বাড়ির সদস্যদের ছবির অ্যালবাম থাকলে একটু নিয়ে আসবেন, প্লিজ?

যেতে যেতে…

বাসে অন্তহীন ভিড়। দুর্যোগ মাথায় নিয়ে সেনাবাহিনির কর্মীরা এখানে-ওখানে রাস্তা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। আমার ঘুরে ফিরে কেবল মনে পড়ছে গতরাতের ঘটনা আর জিনিয়া রাইয়ের হতবাক চোখদুটো। যখন বাড়ির ষোল সদস্যের গ্রুপ ফটো থেকে আমি নিজেই ওর বাবার ছবিটা বেছে দিই, উনি কথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না।

প্রাচীন শ্যাওলামাখা জল-টুপটুপ ঝাউসারির ভেতর দিয়ে বাস নামছে। আমি পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করলাম যার একপিঠে আমারই লাল ইংক পেন ব্যবহার করে ইংরেজিতে লেখা হয়েছে, “স্পর্শ ক’রো না! বিপজ্জনক!!” কাগজটা ওল্টালে বোঝা যায়, সেটা ছয় জুন ঊনিশশো সাতাশি সালে কাটা একটা রেস্তোঁরার বিল। রেস্তোরাঁ-মালিকের সইও আছে নিচে — পি লিম্বু। আজ একটু আগে বিনোদ খুব লাফঝাঁপ দিয়ে একটা উইন্ডোসিটের ব্যবস্থা করেছে। এই পাহাড়ি ছেলেটা হয়তো সারা জীবন আমার ‘আভারি’ হয়ে থাকবে যেহেতু তার প্রাণ বাঁচিয়েছি। কিন্তু আমিও যে একইভাবে অন্য একজনের কাছে কৃতজ্ঞ রয়ে গেলাম, ইহলোকে যাকে বিনোদের মতো ধন্যবাদ জানানোর সুযোগ পাবো না?

পাহাড়-ঘুরে-নামা পথ অনেক দূর থেকে নজরে পড়ছে মেয়েদের চুলের ভাঁজকরা রিবনের মতো। হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে বাঁ দিকের নিচু রাস্তায় ফুটে উঠল গতকাল বিকেলের সেই ছবিটা। এক বৃদ্ধ — কালো কোটের ভেতর থেকে সাদা শার্টের হাতা উঁকি দিচ্ছে — হাতে ছড়ি নিয়ে ঝুঁকে হেঁটে মিলিয়ে গেলেন পাইনবনের আড়ালে! যতক্ষণ দ্যাখা যায়, আমি তাকিয়ে থাকলাম।

“থ্যাংক ইউ, মিস্টার লিম্বু।”

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২৪-০৮-২০১৭ | ১৩:৩৪ |

    আজকাল খুব জনই শিশুদের নিয়ে লিখছেন দেখছি।
    আপনার লিখাটি প্রথম থেকে শেষাবধি পড়েছি। আমার কাছে বর্ণনা অসাধারণ লেগেছে।

    অভিনন্দন প্রিয় চন্দন দা। শুভেচ্ছা জানবেন।

    GD Star Rating
    loading...