ছোটদের গল্প কুইন অ্যান এবং লাভা-র ভূত ৩য়

ছোটদের গল্প
কুইন অ্যান এবং লাভা-র ভূত।

হোটেলের দরজা ঠেলে ঢুকছি, তখনও বুক ধড়ফড়! রিসেপশানে রাই পরিবার সার দিয়ে ব’সে টিভিতে হিন্দি সিনেমা দেখছিল, হইহই করে উঠল: এতক্ষণ কোথায় ছিলে? বলেছিলাম না, রাতের খাবার আমরা সেভেন থার্টিতে সার্ভ করি?
— ও হো, আটটা বেজে গেছে! সরি সরি, আমি একেবারেই…।
— আচ্ছা ঠিক আছে, ঘরের চাবিটা দাও — সেই বৃদ্ধা মালকিন বললেন মিষ্টি হেসে। বিনোদ, তুমি ডিনারটা হটপটে করে ওনার ঘরে রেখে এসো। আসলে, এই দুর্যোগের রাতে ছেলেটাকে দু’কিলোমিটার রাস্তা পার করে বাড়ি পৌঁছোতে হবে তো!
— এখন যাবে? একা!
বিনোদ হেসে ফেলল: যাব মানে? প্রত্যেকদিনই তো ফিরি।
— কোনও বিপদ নেই পথেঘাটে? চিতা বা ভালুক? তারপর…জানোয়ার ছাড়াও কত কিছু আছে!
— কুছ ভী নেহি হ্যায়। এবার বিনোদের হাসিতে যোগ দিল সবাই, এমনকি তানিয়ার বয়েসি বৃদ্ধার সেই সুন্দরী নাতনিও।

লজ্জা পেলাম খুব। মাথা থেকে ভয়ের বোঝাটাও নেমে গেল পুরোপুরি। সেই খুশিতে ওয়ালক্লক থেকে এযাত্রা আর চোখ সরিয়ে নেওয়াও হল না। ম্যাডাম রাই-কে জিগেস করলাম, কুইন অ্যান কতদিন হল অচল পড়ে আছে?
— বাহ, তুমি ঘড়িটার নাম জানো দেখছি! তা, দশ বছর তো বটেই। এটা আমাদের বাড়িতে এসেছিল যখন আমার বয়েস…।

কথায় বাধা দিতে হল। শক্ত কাঠের ফ্রেমে গাঁথা এই ভারি-ভরকম বস্তুটি দেয়াল থেকে নামানো আমার একার কর্ম নয়। ম্যাডামকে বললাম, প্লিজ বিনোদকে বলুন ঘড়িটা আমার রুমে তুলে দিতে। একবার চেষ্টা করে দেখতে চাই।

যা আশা করেছিলাম, ভদ্রমহিলা একেবারে আপ্লুত। “ওমা, তুমি ঘড়ি সারাতে জানো! আহা কী ভালোই না হবে যদি সামনের ক্রিসমাসে এটা সময় দেখাতে পারে।”

ছুঁয়েছ কি মরেছ!

হোটেলের ঘরে ঢুকে ভাবলাম, সকাল থেকে এই ঠান্ডায় দৌড়ঝাঁপ তো কম হল না, গরম জলে হাতমুখ ধুয়ে কাজে লাগি। বাথরুমে ঢুকে দেখি আয়নার ওপর খয়েরি রঙের এক পাহাড়ি মথ বসে আছে। গিজারের সুইচ অন করতে যাব, হঠাৎ বিচ্ছিরি রকম উড়তে লাগল সেটা। এমন বোম্বাই সাইজের বেপরোয়া উডুক্কু মথ জীবনেও দেখিনি বাবা! আর সে ঘুরে ফিরে খামোখা আমার গায়েই বা বসতে চাইছে কেন? পোকা-মাকড় মেরে ফেলা আমার ধাতে সয় না, ভয় হল এটা আমার পিছুপিছুু শয়নঘরে ঢুকে পড়লে তো কাজ আর ঘুম দুইয়েরই দফারফা। সাবধানে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে এসে লাগলাম ঘড়ির পেছনে।

এ-ঘড়ি, যাকে বলে বড্ডো অভিজাত। কেসটা পাক্কা চেরি কাঠে তৈরি, পেন্ডুলামের দণ্ডটিও কাঠের। ফুট তিনেক লম্বা ঘড়ি-মহাশয়ার বয়েস হেসেখেলে একশো বছর তো হবেই। যে রানি অ্যানের নামে এই যন্ত্র, তিনি অবিভক্ত ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড আর স্কটল্যান্ডের অধীশ্বরী ছিলেন আঠেরো শতকের শুরুতে। লন্ডনের সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের সামনে তার মূর্তি রয়েছে আজও।

কুইন অ্যানকে আমি কোনও ছবিতে হাসিমুখে পাইনি, এই ঘড়ি অবশ্য আমাকে দেখা পর্যন্ত মাঝে মাঝে স্মাইল দিচ্ছে। যেখানেই যাই, যন্ত্রপাতির একটা ছোট্ট কিট আমার সঙ্গের ব্যাগে থাকে। প্রথমে ঘড়িটা খুলে পার্টসগুলো লোশানে চুবিয়ে রাখতে হবে ঘন্টাখানেকের জন্যে। কাজ করতে করতে চোখ চলে যাচ্ছিল বাইরের কুয়াশা-ঢাকা শুনশান বাসস্ট্যান্ডের দিকে। আচ্ছা, হিমে ভেজা বেঞ্চটার ওপর কেউ কি বসে আছে কালো কোট, কালো ট্রাউজার, বো টাই…?

ধুস, কি পাগলামি করছি! উঠে গিয়ে জানলার পর্দা টেনে দিলাম। বলতে ভুলে গেছি, এই ঘরে ঢোকার দরজার ঠিক উল্টোদিকে বড় দুটো কাচের জানলা আর তার মাঝখানে মোটা প্লাইউডের আরও এক দরজা রয়েছে। দরজা খুলে বাইরে বেরোলে ছোট্ট ব্যালকনির গা ঘেঁষে গভীর খাদ আর বাঁদিকে বাস-গুমটি। রাতের খাওয়া সেরে নেওয়া যাক ভেবে হাত বাড়ালাম হটপটের দিকে।

মা বলল, এবার আমাদেরও চা-পানের বিরতি।

ঘড়িকাকুর গল্প অ্যানাসথেশিয়ার মতো, মার কথায় যেন শরীরে সাড় এল! চায়ের কাপ কোলের কাছে টেনে নিয়ে উনি আবার বলতে লাগলেন:

অনেক রাতে শুয়েছিলাম সেদিন, আলোটালো না নিভিয়েই। কিন্তু খুব ভোরে মাথার যন্ত্রণা আর বন্ধ-নাক নিয়ে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি ঘরের ভেতরটা চাপচাপ মেঘে ভীষণরকম আবছা আর টিউবলাইট জিরো পাওয়ারের বাল্বের মতো মিটমিট করছে। উঠে জানলার সামনে যেতেই… ও হরি, ব্যালকনির দরজা হাট করে খোলা যে! কী আশ্চর্য, গতরাতে ছিটকিনি হাঁসকল সব লাগিয়েই তো বিছানা নিয়েছিলাম!

তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে ওষুধ বার করতে হল, তারপর চট করে বাথরুম ঘুরে এসে আবার পড়লাম আমার পেশেন্টকে নিয়ে। কাল রাতেই লোশান থেকে তুলে সুতিকাপড় আর পেগ-উড দিয়ে মুছে পরিচ্ছন্ন করে রেখেছিলাম পার্টসগুলো। এবার স্প্রিং, পিনিয়ন, লিভার, পিভট, হুইল ট্রেন — একটা করে বসাতে লাগলাম যথাস্থানে। তোমাকে হয়তো বলেছি সিদ্ধার্থ, এই সময়ে আমার এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়। যন্ত্রাংশের ঠিকঠাক লেগে যাওয়া, জায়গামতো বসে যাওয়া যেন সংকেত পাঠায় মনের মধ্যে — আগে থেকেই বুঝে নিতে পারি ঘড়িটা সেরে উঠছে কিনা। আসলে সব ঘড়িই কিন্তু চায় সর্বক্ষণ চালু থেকে আমাদের সময় দেখাতে। আর, একটু ভালোবাসা পেলে মানুষের মতো ঘড়িও কখনও বিগড়োয় না!

ঘড়িকাকু এবার গলা নামিয়ে বললেন, একটা গোপন খবর দিই। সুস্থ করে তোলার পর প্রত্যেকটা ঘড়ি আমাকে চুপিচুপি ধন্যবাদ জানায়। আজও চাবি ঘুরিয়ে পুরো দম দিয়ে সোজা করে ধরতেই কুইন অ্যান মিষ্টি স্বরে বলল “থ্যাংক ইউ”, তারপর চলতে শুরু করল তার একশো বছরের চেনা সময়-পথ ধরে।

ঘড়ির কাজ সেরে নিজের কাজ মনে পড়ল — স্নান সারতে হবে। ওষুধ খেয়ে শরীরটা ঝরঝরে হয়েছে, সকালে দেখেছি বিদেয় হয়েছে সেই হাড়-জ্বালানি মথটাও। তো, বাথরুমে ঢুকে যেই গিজারের সুইচ অন করতে যাব… আরে, এ আবার কী! সুইচবোর্ডের গায়ে এক টুকরো কাগজ সাঁটানো আর তাতে লেখা:

DON’T TOUCH! DANGEROUS!!

( আবার আসছি… )

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২২-০৮-২০১৭ | ১৩:৫৩ |

    শ্বাসকে যতটা সম্ভব আটকে রেখে পুরো ৩য় অংশবিশেষ পড়ে নিলাম। যদিও ভৌতিক গল্প শব্দটি শুনলেই আমার পিলে চমকে উঠে প্রিয় চন্দন দা। তারপরও আপনার বর্ণনার জাদুতে লিখাটিকে ভালোই বেসে ফেললাম। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Confused.gif.gif

    GD Star Rating
    loading...
  2. দীপঙ্কর বেরা : ২২-০৮-২০১৭ | ২৩:৫০ |

    খুব ভাল

    GD Star Rating
    loading...