ছোটদের গল্প : আজকের ভগীরথ
“ওরে, আমি হচ্ছি ধূর্জটি সরখেলের ছেলে, সারা জীবন যার পোশাক বলতে ছিল বাইরে পরার জন্যে একখানি ধুতি আর ঘরে একটা গামছা, ব্যাস। সেই আমার কাছে তোরা সরস্বতীপুজোর চাঁদা চাইতে এসেছিস! তোদের সাহস দেখে দেখে, সত্যি, আর অবাক হতেও উৎসাহ পাই না।”
পাড়ার বিদ্যার্থী সংঘের ছেলেরা এসব জানে, তবু রামায়ণ-মহাভারত কি পুরনো হওয়ার জিনিস?
— আর তোমার ঠাকুরদার গল্পটা যেন কি, কপালজেঠু?
— আদিনাথ সরখেল ভুল করে একবার একটা অমৃতি কিনে ফেলেছিলেন। তারপর টানা দশদিন হররোজ সকালে সেই অমৃতির একটা করে পাপড়ি ভেঙে তাই দিয়ে মুড়ি মেখে খেতেন।
— ঠাকুরদা বোধ হয় মারা গেছিলেন ডায়রিয়ায় ভুগে আর তোমার বাবা নিউমোনিয়ায়, তাই না গো?
— কী করে জানলি? এসব খবর তো কাউকে দিই না আমি!
দুই
তো, কপালজেঠু গতকাল টেলিফোন অফিসে গিয়েছিল বিলের টাকা জমা দিতে। ঠিক পাশেই জেলা হাসপাতাল, আর রাস্তার অন্য ফুটে ওষুধের দোকান, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার এইসব। কপালজেঠু ফিরতি অটো ধরবে বলে সেখানে দাঁড়িয়ে, এমন সময় মিনিমাম সত্তর বছর বয়েস হবে এক খুনখুনে বুড়ি এসে — “ও ছেলে, পাঁচটা ট্যাকা দাও না, একটা সন্দেশ কিনি। কিছু না কিনলে দোকানদার এক গেলাস খাবার জল দিতে চাইছে না। এদিকে হাসপাতালের কলগুলো সব শুকনো। সকাল থেকে নাইনে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে তেষ্টায় আমার জিভ বেঁকে গেছে গো ছেলে!”
অন্যমনস্ক ছিল তাই, নাকি বহু যুগ পরে কারও মুখে “ছেলে” ডাক শুনে গলে গিয়ে থাকবে, পকেট থেকে তুলে ঝপাত করে একটা পাঁচ টাকার কয়েন ফেলে দিল বুড়ির হাতে।
দিয়েই মনে হল, হায় এ কী করলাম আমি! তিল তিল করে এগিয়ে কিপটেমি-সাধনার যে উচ্চমার্গে নিজেকে স্থাপন করেছিলাম সারা জীবনের চেষ্টায়, সেই আসন মুহূর্তের ভুলে ধুলোয় টেনে নামালাম! এতবড় বংশমর্যাদার কথাও একবার মনে পড়ল না? ধিক্কার!
তারপর দ্বিতীয় চিন্তায় মনে হল, টাকাটা আজ বেমক্কা খসেছে বুড়ি মানুষটা সকাতরে চাইল বলেই না? না-চেয়ে তার উপায়ই বা কী ছিল? গোটা হাসপাতালে অঘোষিত খরা চলছে যেকালে। কাজেই এই ক্ষতির দায় সরকারি স্বাস্থ্যপরিষেবাকেই নিতে হবে। দাঁড়াও, দেখাচ্ছি।
হনহন করে গেট দিয়ে ঢুকে একটু এগোতেই কপালজেঠুর সামনে এক নার্স, ঘাসের উঠোন পেরিয়ে এ-ওয়ার্ড থেকে সে-ওয়ার্ডে যাচ্ছে।
— এই যে দিদি, আপনাদের হাসপাতালে একফোঁটা খাবার জল পাওয়া যায় না কেন?
নার্স খুব বিরক্ত হয়ে ঘুরে তাকাল।
— নাম কী আপনার? কোত্থেকে আসছেন?
— ইয়ে, কপাল…
— না না, কপালের চিকিৎসা এখানে হবে না, এটা হার্ট। আপনি ওই ছাতিমগাছের পাশ দিয়ে ডানহাতে…।
— কী মুশকিল, আমার নামই তো কপাল, মানে কপালেশ্বর সরখেল।
“পোড়া কপাল আমার”, নার্স ফিক করে হেসে ফেলে আবার গম্ভীর:
— ওদিকে অফিসে গিয়ে জিগ্যেস করুন। আমি এখানে জলসত্র খুলে বসিনি আপনার জন্যে।
তিন
লম্বা, ইঁটপাতা রাস্তার শেষ মাথায় পুরনো বিল্ডিংয়ে বসেন সুপারিন্টেন্ডেন্ট। ছোট্টখাট্টো চেহারার পিওন হাত নেড়ে ভীষণ বারণ করল: এখন ঢুকবেন না, স্যার টিফিন করছেন।
অগত্যা সরু বেঞ্চিটায় বসে থাকল কপালজেঠু। পাঁচ টাকা মানে যে পুরো পাঁচশো পয়সা, ক’জন ভেবে দেখেছে, বলো? পাঁচ টাকার অর্থ আড়াইখানা গরম ফুল সাইজের বেগুনি বা ভ্যান রিকশায় বালিশা মোড় থেকে বিড়া স্টেশান অথবা সাইকেল টিউবের লিকে তাপ্পি লাগানো। এমনকি বিদ্যার্থী সংঘের লটারি প্রতিযোগিতায় একখানা টিকিটের বিনিময়ে প্রথম পুরস্কার একুশ ইঞ্চি কালার টিভি পর্যন্ত…“ও দাদা, ভেতরে যান। একদম টাইম লাগাবেন না, স্যার বিজি।”
সুপারের চোখদুটো ফোলাফোলা। ছোট্ট হাই তুলে সেই চোখেই মেপে নিলেন ভিজিটারকে।
— কী চাই?
— এটা আপনার জেলা হাসপাতাল না নির্জলা হাসপাতাল, বলতে পারেন? টাকা জলে না দিলে জল খাওয়া যায় না যেখানে!
প্রথম ডেলিভারিটাই বাউন্সার। দুতিন বছর আগে পেলেও নিখুঁত রিফ্লেক্সে কোমর হালকা বাঁয়ে ঘুরিয়ে বলটাকে মিড উইকেট বাউন্ডারির বাইরে ফেলে দিতেন। কিন্তু রিটায়ার করতে বাকি মাত্র সোয়া তিনমাস। এখন পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে কোনও শট খেলা উচিত হবে না। টেস্ট ম্যাচে দিনশেষের আধ ঘন্টায় শচীনও এম এল জয়সীমা হয়ে যেত, তাই না? আর এখুনি যেন কী বলল লোকটা? বাইরে টিউবয়েলের জলও বিক্রি হচ্ছে? সর্বনাশ! চোখমুখ দেখে আদৌ গরীবগুর্বো মনে হয় না, গ্রেটা গার্বোর ভাইপো হলেও হতে পারে। তাহলে পাঁচ টাকার জন্যে অদ্ভুতপূর্ব শোকের উৎস কী?
লোকটার হাফ-পাঞ্জাবির বুকপকেটও ভারিভারি ঠেকছে। গোপন ক্যামেরা না হোক, পুঁচকে টেপ রেকর্ডার বাসা বাঁধতেই পারে। সুপার মাথা নামিয়ে যেতে দিলেন বাউন্সারটাকে।
— না না, আপনি একেবারেই ঠিক বলেছেন। আরে, দাঁড়িয়ে কেন, বসুন না! আসলে কি জানেন, হাসপাতাল আমরা মানে স্বাস্থ্য দপ্তর চালাই বটে, জলের ব্যবস্থা কিন্তু করে পিএইচই মানে পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং। এটা সবার জানার কথা নয়, বিশেষ করে তারা তো খোঁজই রাখে না যারা পরের ইয়েতে নজরদারি…।
সুপার নিজের নিরীহ ডেলিভারিটায় গুগলির উলটো মোচড় আনতে চাইলেন ঠিকই, কিন্তু কপালেশ্বর তাতে কপাল, সরি কান করল বলে মনে হয় না।
— এটা একটা জবাব হল? বাসস্টপে দাঁড়িয়ে শুনলাম ছ’মাস এখানকার কলগুলো খারাপ, আপনারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন নাকি?
আর সন্দেহ থাকে না সুপারমশাইয়ের, এ-লোককে লাগিয়েছে তার কোলিগ বীজেশ চক্রবর্তীই। ওপর মহলে অনেক ধরে-করে একই গ্রামের বাসিন্দা বিজুকে ডিঙিয়ে বাড়ির কাছাকাছি পোস্টিংয়ে এসেছিলেন। সে-বুড়োর রিটায়ার করতে বাকি বোধ হয় আর দিন দশ-পনেরো। যাওয়ার আগে একটা বিষ-কামড়ের ছক সাজাবে না? কে জানে, আরও কি কি দুসরা বেরোবে হাতের কপাল, ধুস, কপালের হাত থেকে। কাজেই ভাই, বলের লাইনে গিয়ে মাথা নিচু করে পরিষ্কার ডেড-ব্যাট পাতা আছে।
— ছি ছি, আমরা ঘুমিয়ে পড়ব, এটা কল্পনায়ও আনবেন না। যেদিন থেকে চাকরিতে এলাম, ঘুমটুম সব হোল্ড-অলে বেঁধে বাড়ির বড় আলমারিতে তুলে রেখেছি। রিটায়ার করে ফিরে আবার তাক থেকে ধুলো ঝেড়ে নামাতে হবে — ব’লে সুপারিন্টেন্ডেন্ট টেবিলের ওপর রাখা ফিনফিনে নীল ফাইলের বুকে টোকা দেন। এই দেখুন, কত কত চিঠি দিলাম পিএইচই-কে, অন্তত পনেরোটা, কিন্তু ওরা শুনলে তো!
— কোথায়, ফাইলে তো অত কাগজই নেই!
— ও, নেই? আসলে নানা রকম ফাইল থেকে চিঠি ছাড়া হয় তো। দাঁড়ান। সহদেব?
শিশুসুলভ শরীরের সেই পিওন দরজা খুলে ঠিক মুখটুকু ভেতরে আনল।
— পি এইচ ই-এ ফাইলগুলো নিয়ে এসো দেখি।
— সে তো আন্নার টেবিলের ওপরেই।
— আহা না। ওদের চিঠি পাঠিয়েছি খাবার জলের কল সারিয়ে দিতে। সেই সব ফাইল চাই। বুঝতে পারলে?
— খুব বুজিচি স্যার।
সহদেব দরজা ভেজিয়ে দিল। তারপর সোজা হাসপাতালের কম্পাউন্ড পার হয়ে রাস্তার উল্টোদিকের চায়ের দোকানে ঢুকে বসে পড়ল ঠ্যাং ছড়িয়ে।
( গড়িয়ে চলবে… )
loading...
loading...
বড় গল্পের শুরুবাদ হিসেবে লিখাটি অবাধ্য এ মগজে ধরে রাখলাম প্রিয় চন্দন দা।
শুভদিনে এভাবেই ( গড়িয়ে চলুক… )
loading...