সম্পর্ক ডাউনলোডেড

বেঙ্গালুরু থেকে আলোদ্যুতি লিখে পাঠিয়েছে:-

“বাসে মেয়েটার পাশের সিটে একটা ছেলে এসে বসল। প্রথমে তো মেয়েটা শরীর গুটিয়েটুটিয়ে সরে গেছে জানলার দিকে, মুখে কোঁচকানো বিরক্তি। আর পুরুষ মনে মনে অপ্রস্তুত। কিছুক্ষণ যায়, বাসের আচারমাখা ঝাঁকুনিতে ঢিলে হয়ে আসে বিভাজন, মেয়েটার শ্লথ হাত এসে পড়ল ছেলের কোমরের কাছে।

ছেলেটার মনে বেড়ালের গুড়গুড়ুনি শুরু এবার। নিশ্চয়ই ইশারা দিচ্ছে ওপক্ষ, চাইছে আমি সক্রিয় হই — ভেবে যেই একটু তেমন-কিছু-না করতে গেছে, মানে দুটো পায়ের মধ্যে অ্যাঙ্গেলটা কুড়ি ডিগ্রি মতো বাড়িয়ে ডানহাতের কনুই সাইড ওয়াইজ ছ’ইঞ্চি ওপরে তোলা, মেয়েটা ধড়ফড় করে আবার “প্যারেড সাবধান” হয়ে গেল, হল পুনর্কুঞ্চিত ভ্রূ।

সে তো ভয়ে ভয়ে সরেই বসেছিল, পাশের খালি চেয়ারে দাড়িগোঁফ উদিত হোক কি মসৃণকামানো গাল, বিরক্ত তাকে করবেই। তারপর যখন দেখা যায়, ছেলেটা ভদ্রমুখ, মোবাইলব্যস্ত, নিশ্চিন্ত হয়ে নিজেকে একটু কমফোর্ট দিতে চেয়েছে। ব্যস, ওমনি ভুল অনুবাদ, গলত উদ্ধৃতি। আবার তড়াক করে সিয়াচেন গ্লেসিয়ারে রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে পড়তে হল মেয়েটাকে”।

আমার মনে পড়ল কোন হিন্দি সিনেমায় যেন বোমান ইরানি অল্প পরিচিত বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে এইরকম এক আশায় জামাপ্যান্ট খুলে শুধু অন্তর্বাসে সোফায় বসে পড়েছিল।

আলোদ্যুতিকে লিখলাম, ছেলেদের এই আচরণের পেছনে শুধু যে পুরুষতন্ত্র কাজ করছে, এমন তো নয়; তার যৌন-মনস্তত্বও তাকে ভাবাচ্ছে এভাবে। স্পিসিস হিসেবে প্রকৃতিতে তার ভূমিকাই হল রক্তদানের চেয়ে অনেক স্বতঃস্ফূর্তভাবে শুক্রানুদানের জন্যে তৈরি থাকা। সেখানে গ্রহীতার মান কেমন তা বিবেচনাতেই আসছে না। তার ওপর যদি সে মনে মনে পুরুষতন্ত্রের শক্তপোক্ত ধারক হয়ে থাকে, তবে গ্রহীতার অনিচ্ছেকেও এক চুটকিতে উড়িয়ে দেবে। শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণের অবির্ভাব হচ্ছে এখানে। পুরুষের যৌন-আচরণের এই দুটো ভাগকে (প্রকৃতিনির্দিষ্ট ভূমিকা আর অত্যাচারী ভূমিকা) আলাদা করে না বুঝলে সমস্যাটাকে মেটানো সহজ নয়। দ্যাখো, এখানে মেয়েটার রিল্যাক্সড হয়ে বসার একটা গলত মানে করেছে ছেলেটা। কেন? কারণ, সে নিজে ইচ্ছুক বলে ভাবছে অপরপক্ষও ইচ্ছে করবে। এটা কিন্তু জেন্ডার নির্বিশেষে সাধারণ মনস্তত্ব। আমরা প্রত্যেকেই ধারণা আর আশা করি, বাকি মানুষেরা আমার মতো হবে। না হলে বিরক্ত হই, তাকে ভুল প্রমাণ করি, পাল্টাতে চাই।

আলোদ্যুতি আমার ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত হল: হ্যাঁ, এটাই প্রাইমরডাল পুরুষ। তার বলপ্রয়োগ আটকাতে গেলে তাকে যে শিক্ষা দিতে হবে সেটা মানবিকতা আর সিভিল রাইটসের। কিন্তু পুরুষের দাতাকর্ণভাব থামাতে তার মাথায় এই কথাটা গজাল-পোঁতা করা দরকার যে তুমি যেভাবে যৌনতাকে দ্যাখো, উঠল বাই তো কটক যাই, সেভাবে একটা মেয়ে ভাবে না। কাজেই নারীর যৌন-উদ্দীপকে সাড়া দেওয়ার এই মনগড়া কাহিনিগুলোকে ফেলে না দিলে পারস্পরিক বিশ্বাসের জায়গাটাই শুধু নষ্ট হবে।

আমি প্রশ্ন করলাম, তোমার কি মনে হয় না মেয়েরাও নিজের প্রাচীন চরিত্রগত কারণে একইভাবে ছেলেদের বুঝতে ভুল করে? যদি তা না ভাবো, বলতে বাধ্য হব যে নারীবাদ মেয়েদের ‘ফার্স্ট সেক্স’ প্রমাণ করার চেষ্টায় আছে।

আলোদ্যুতি হাসিমুখের ইমোটিকন পাঠালো: আরে দাঁড়াও দাঁড়াও, কথা এখনও শেষ হয়নি। মেয়েরা যেহেতু গ্রহণকারী, তাকে নিষিক্ত ডিম্বানুটাকে বহন করে সন্তানের জন্ম দিতে হবে, বাঁচিয়ে রাখতে হবে, বড় করতে হবে, তাই তার পক্ষে নির্বিচারে শুক্রানু আহ্বান করা সম্ভব নয়। নারী এমন পুরুষই খুঁজবে যে তার সংসার আর সন্তানকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা আর রিসোর্স যোগাতে পারে। কাজেই তার পক্ষে পূর্বরাগ খুব দরকারি ব্যাপার। এই সময়টাতে আসলে সে গুগল সার্চ করে বুঝে নিতে চাইছে, এই পুরুষ তার সন্তানের বাবা হওয়ার যোগ্য কতটা। কাজেই নারীর পক্ষে সমস্ত বিবেচনা শেষ হওয়ার পর, অন্য সব সিদ্ধান্ত মোটামুটি পাকা হয়ে গেলে যৌনতার অবির্ভাব হয়। এই প্রবণতা থেকে মেয়েরাও ছেলেদের ‘সেক্স ফার্স্ট’-এর মনোভাবকে দেহসর্বস্ব ও ধান্দাবাজির ঘটনা বলে মনে করে। মজার ব্যাপার হল, দু’দলেরই প্রবণতাগুলো এত গাঢ় মনস্তাত্বিক যে, যেখানে যৌনসম্পর্কের লক্ষ্য সন্তান উৎপাদন নয়, সেখানেও একই অধিনিয়ম লাগু থাকবে।

আমি জানালাম: ঠিকই বলেছ। কোনও সফটঅয়্যার ডাউনলোড করার সময় যেমন নেক্সট লেখা তীরচিহ্ন দ্যাখায়, তেমনি ছেলেদের বেলাতে পদ্ধতি হচ্ছে প্রেম থেকে যৌনতা, বা যৌনতা থেকে প্রেম থেকে যৌনতা। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রেম থেকে যৌনতা থেকে সংসার থেকে সন্তান থেকে সংসার। আমি এই চেইনের শেষ মানে “ফিনিশড” অবস্থানটাকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, যা ছেলেদের বেলায় যৌনতা আর মেয়েদের জন্যে সংসার।
— সংসার মানে কি ফ্যামিলি?
— হুঁ, পরিবার শব্দটাও বসানো যেতে পারে।
— আমার মতে যৌনতা ফিনিশিং পয়েন্ট নয় পুরুষের। সে এসে থামে সম্পত্তির ধারণায়। যৌনতা থেকে প্রেম থেকে সম্পত্তি।

আমি বললাম, প্রচুর ধন্যবাদ। মনে হচ্ছে, একদম ঠিক বলেছ। এবার এই ভাবনাগুলোকে প্রয়োগ করার জন্যে আমরা বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের ভাঙন নিয়ে এগোতে পারি। চিড় খাওয়া বিবাহজ সম্পর্কের উদাহরণ নেব না কারণ সেখানে রাষ্ট্র আর সমাজের চাপ আর অন্যান্য নানা কারণ ভাঙা হাড়ে প্লাস্টারের কাজ করে।

তুমি দেখবে, দুটো বিবাহিত মানুষের মধ্যেকার প্রেম ভেঙে যাওয়ার একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আছে। মেয়েটা কিছুদিন পরেই অনুভব করবে, তার প্রেমিক আসলে ভালোবাসে নিজের স্ত্রীকেই। তার কাছে বউই প্রায়োরিটি, প্রেমিকাকে শুধু যৌনসঙ্গী হিসেবে বা অন্য কোনও উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে। আমার ধারণা, একটা মেয়ে বিশ্বাসই করতে পারে না কোনও পুরুষ নিজের সংসারে বাস করেও মানসিকভাবে বিযুক্ত থাকতে পারে, যেহেতু সেটা সে নিজে খুব কম পারে।

আলোদ্যুতি লিখল, একই ভাবে কোনও ছেলে বিবাহিত মেয়ের সঙ্গে প্রেম শুরু করলে কিছুদিন পরই তাকে প্রমিসকিউয়াস ভাবতে শুরু করবে। পুরুষের কাছে যেহেতু এন্ড পয়েন্ট হল মেয়েটিকে নিজের সম্পত্তির বানিয়ে ফেলা যার মূলে তার যৌন-সতীত্বের ধারণা কাজ করছে, সেখানে বিবাহিত মেয়েকে নিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া খুব মুশকিল। ছেলেটা প্রথমে ভাবে, মহিলা মিথ্যে বলছে, হাজব্যান্ডের সঙ্গে সব রকম সম্পর্কই আছে এর। তারপর আবিষ্কার করে মেয়েটি একই সঙ্গে আরও নানা পুরুষে আকৃষ্ট, মানে আপামাথা ‘চরিত্রহীন’।

আমার শেষ মন্তব্য ছিল: তাহলে আলোচনার বাইরের দরজায় পৌঁছে আমরা বলতে পারি — নারী বা পুরুষের জৈব-বাস্তবতা বা বায়োলজিক্যাল রিয়ালিটি থেকেই প্রাথমিকভাবে তার দেহ-মনস্তত্ব গড়ে ওঠে। আর সেই দেহ-মনস্তত্বই তার যৌন-আচরণকে গড়ে দেয়। এর ওপর সামাজিক শক্তিগুলোর প্রভাব থাকে ভীষণ রকম। এইভাবে বুঝতে পারলে ছেলে বা মেয়ে কাউকেই তার সেক্সুয়াল বিহেভিয়ারের জন্যে অতিরিক্ত দায়ি করার দরকার পড়বে না। জেন্ডার-স্পেসিফিক শোষণগুলো থেকে মেয়েরা মুক্তি পেলে সামাজিক চাপের কারণে দুজনের আচরণের যে তফাত, সেটা ঘুচে যাবে। তারপরেও থাকবে দেহ-মনস্তত্বের পার্থক্যটুকু।

আলোদ্যুতি লিখল: কোনওদিন মেয়েদের গর্ভে বাচ্চা নেওয়ার প্রথা বন্ধ হলে দেহকেন্দ্রিক মনোভাবের বিভিন্নতাও অনেকখানি ঘুচে যাওয়ার কথা। তখন এক-আধটা ছুটকো ঘটনা নয়, পুরুষকর্তৃক মেয়েদের ছেড়খানি করার কমপ্লেইনের মতোই ভুরি ভুরি আদম-টিজিংয়ের অভিযোগে উপচে পড়বে থানাগুলো।

— হুঁ, সাম্য আসা মানেই নৈতিক হয়ে ওঠা নয়। কাজেই, সমতার পরিবেশ শোষণও বন্ধ করে না। তবু সেটাই প্রথম পদক্ষেপ। তার সঙ্গে মিথ-মিথ্যে-কুসংস্কার সরিয়ে নারী-পুরুষের একে অন্যকে চিনতে পারা, যেটা তথ্যের কাজ, জ্ঞানের কাজ।

— আর একদিন এই দিকটা নিয়ে নয় কথা বলব আমরা।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৯ টি মন্তব্য (লেখকের ৪টি) | ৪ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২৮-০১-২০১৭ | ২৩:৩৪ |

    সচরাচর আপনার লিখন শক্তির প্রতি আমার সমীহ কাজ করে। আপনার লিখা বরাবরই অসাধারণ। এই লিখাটিকেও আমি আলাদ করবো না। বরং সম্মান দেখাবো।

    কেননা আমি মনে করি প্রত্যেক পাঠকের প্রয়োজন হবে লিখাটি বারকয়েক পড়া।

    সত্য যে, ‘প্রকৃতিনির্দিষ্ট ভূমিকা আর অত্যাচারী ভূমিকা আলাদা করে না বুঝলে বিদ্যমান কোন সমস্যাকেই মেটানো সহজ নয়। কখনও সম্ভবও নয়।’ ধন্যবাদ চন্দন দা।

    GD Star Rating
    loading...
    • চন্দন ভট্টাচার্য : ৩১-০১-২০১৭ | ২২:২২ |

      আপনি লেখার একদম মূল জায়গাটা ধরেছেন। এই হচ্ছে জহুরির চোখ। অনেক কৃতজ্ঞতা।

      GD Star Rating
      loading...
      • মুরুব্বী : ৩১-০১-২০১৭ | ২২:৪২ |

        ধন্য হলাম প্রিয় চন্দন দা।

        GD Star Rating
        loading...
  2. মামুন : ২৯-০১-২০১৭ | ১:০৪ |

    নারী বা পুরুষের জৈব-বাস্তবতা বা বায়োলজিক্যাল রিয়ালিটি থেকেই প্রাথমিকভাবে তার দেহ-মনস্তত্ব গড়ে ওঠে। আর সেই দেহ-মনস্তত্বই তার যৌন-আচরণকে গড়ে দেয়।

    GD Star Rating
    loading...
    • চন্দন ভট্টাচার্য : ৩১-০১-২০১৭ | ২২:২১ |

      হ্যাঁ মামুনভাই, আমার তেমনই অনুভব। ভুল হলে শুধরে দেবেন আপনারা।

      GD Star Rating
      loading...
  3. মোঃ সাহারাজ হোসেন : ২৯-০১-২০১৭ | ২:৩৪ |

    অনেক শিক্ষণিয় পোস্ট।
    ধন্যবাদ পোস্টির জন্য।
    শুভেচ্ছা জানবেন

    GD Star Rating
    loading...
  4. নাজমুন নাহার : ২৯-০১-২০১৭ | ৯:২০ |

    এই যে রিলেশন খুব এমন যে নারী এবং পুরুষের – এটা প্রকৃতিরও কিন্তু খেলা ।
    পুরুষ নারীর এই আকর্ষন – কারণ প্রকৃতি চায় তার সন্তানরা টিকে থাকুক ।
    কিন্তু এই যে হৃদয়ের টান সেটা কি প্রকৃতি কিভাবে ব্যাখ্যা করবে ।
    পোষ্ট ভালো লাগলো /

    GD Star Rating
    loading...
    • চন্দন ভট্টাচার্য : ৩১-০১-২০১৭ | ২২:১০ |

      না, হৃদয়ের টান মিথ্যে নয় নিশ্চয়ই।

      আমার মনে হয়, প্রেমের বেলায় প্রেমিকা তার প্রেমিকের মধ্যে আমরা খালি চোখে যা দেখছি তার চেয়ে বেশি কিছু গুণ আবিষ্কার করে। তাই রোগা কালো রোজগার না থাকা একটা ছেলের সঙ্গেও একটা মেয়ে পালিয়ে চলে যায়। ভালোবাসে বলে ছেলেটির দুর্বলতাকেও তার জোরের জায়গা মনে হতে থাকে। এমনও হয়, দুজনে মিলে যুগ্মশক্তি হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখে।

      কাজেই পুরুষসঙ্গী নির্বাচনের যে প্রাকৃতিক নিয়ম, প্রেমের বেলাতেও নারী মানসিকভাবে তার বাইরে যাচ্ছে না বলেই আমার ধারণা।

      GD Star Rating
      loading...