(তৃতীয় টুকরো)
বড়দিনের আগে এই অ্যানেকডোট দিয়েই শুরু করা যাক:
রোমের গির্জার সামনে হঠাৎ এক উন্মাদের উদয় হয়েছে। দাড়িভর্তি মুখের খেতে না পাওয়া চেহারা, এক টুকরো কাপড় শুধু কোমরে জড়ানো। সে বলছে: আমি যিশু! কথা দিয়েছিলাম না, দ্বিতীয়বার আসবো? স্বাভাবিকভাবেই লোকজন খুব আমোদ পাচ্ছে, কিন্তু আওয়াজ শুনেও চার্চের ভেতর থেকে কেউ বেরলো-টেরলো না।
বাচ্চা ছেলেমেয়েরা একটা খেলা ভেবেই শেষে তাকে ঢিল ছুঁড়তে শুরু করল; পাগল তখনও বলছে আমিই খ্রিস্ট, বিশ্বাস করো একবর্ণ মিথ্যে বলছি না। সন্ধে নামল এক সময়, রক্তমাখা অভুক্ত লোকটা বরফগুঁড়োর মধ্যে একা পড়ে থাকল উপাসনাস্থানের সামনেই।
রাত যখন প্রায় দুটো, গির্জার ফটক খুলে প্রধান যাজক পা টিপে বেরিয়ে এসেছেন, এদিক-ওদিক দেখে তিনি সেই আধমরা পাগলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। নিচু হয়ে ফিসফিস করে বললেন, চলো ভেতরে, কথা আছে।
ঘরে নিয়ে তাকে একটা ফারের কোট আর একবাটি গরম স্যুপে কমফোর্ট করতেই শুরু হল পুরনো ঘ্যানঘ্যানানি: আমি জিসাস ক্রাইস্ট, তুমি তো ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ সেবক, তাও ঈশ্বরের ছেলেকে চিনতে অসুবিধে!
পাদ্রি এক ধমক দিয়ে বললেন, কে বললো তোমাকে চিনতে পারিনি? না হলে কি আরও অনেক আগেই দয়া দেখাতাম না? কিন্তু তুমি হঠাৎ ফিরে এলে যে বড়!
— ফিরে আসব না, কী বলছো! সেই রকমই তো কথা দিয়েছিলাম। তবে কিনা একটু দেরি হয়ে গেল, অপেক্ষা করিয়ে রাখার জন্যে যারপরনাই দু:খিত।
— না না, কেউ ওয়েট-ফোয়েট করছিল না। একগাদা পুরনো ধারণা নিয়ে বসে থেকো না প্লিজ! এটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও যে খ্রিস্টকে আমরা চাই না, খ্রিস্টধর্মকে চাই, চাই গির্জাকে। তোমার কাজ সেরে তুমি ঠিক সময়ে রওনা হয়ে গেছ, এবার আমাদের শান্তিমতো দায়িত্বটা পালন করতে দাও।
ঈশ্বরপুত্র হাঁ করে তাকিয়ে আছে দেখে পাদ্রির বিরক্তি বাড়ল আরও।
আচ্ছা, তুমি কি খবর রাখো না এখন আমরা খ্রিস্টানরা পৃথিবী শাসন করি, আর রাষ্ট্রের সঙ্গে সঠিক বোঝাপড়া করে এগনোর জন্যেই এটা সম্ভব হয়েছে? এই মুহূর্তে চার্চের সম্পদ আর প্রভাব কতখানি তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। গোটা পরিকল্পনার মধ্যে যিশুর সেকেন্ড কামিং-এর কোনও জায়গা নেই। ওয়ান বাইবেল ইজ এনাফ। ওই একটামাত্র বইয়ের ওপরে এই বিশাল সাম্রাজ্য আমরা গড়ে তুলেছি — তাহলে ভেবে দ্যাখো কার কৃতিত্ব বেশি, যিশুর না গির্জার? তারপর তুমি পাগল মানুষ, হয়তো প্রেস বাইট-ই দিয়ে বসলে যে মেরি ম্যাগডালেনের সঙ্গে ঘুমিয়েছ বা এমনকি একটা বাচ্চাও হয়েছিল তোমাদের। কী লেভেলের কেলো হবে আইডিয়া করতে পারছ? তাসের ঘর হয়ে যাবে সবকিছু, এইসব লোককে বাবা একবিন্দু বিশ্বাস নেই!
মূল গল্পটা আছে দস্তয়েভস্কি-র ব্রাদার্স কারামাজোভ উপন্যাসের “দি গ্র্যান্ড ইনকুইজিটার” অধ্যায়ে। নিজের মতো করে খানিক মজা জুগিয়ে লিখলাম।
কিন্তু আমি বুঝতে পারি না “এইসব লোক”-এর লিস্টে কে কে পড়বেন? হজরত, বুদ্ধদেব, রবীন্দ্রনাথ, জাঁ পল সার্ত্র…? আচ্ছা, আজ সকালেই যদি মহম্মদ জাগ্রত হয়ে মক্কায় অবতরণ করতে চান, আমরা নিশ্চয়ই আশা করতে পারি, সব সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী নিজ-নিজ কর্মসূচী স্থগিত রেখে একজোট হয়ে তাকে তন্মুহূর্তে উড়িয়ে দেওয়ার পবিত্র ইসলামিক কাজে হাত লাগাবে? অথবা ভাবুন গুগাবাবা-র মতো গৌতমবুদ্ধ ফিরে এল! তিনি তো প্রথম মউ স্বাক্ষর করবেন তালিবান জঙ্গিদের সঙ্গে, “ভাই, তোরা সারা পৃথিবীতে আমার যেখানে যত স্ট্যাচু আছে একটু কষ্ট করে ভেঙে দে না!” কেননা, মৃত্যুর আগে শিষ্যদের নির্দেশ দিয়ে গেছিলেন: যেন কোথাও আমার কোনও প্রতিমূর্তি তৈরি না হয় (এবং সেই জন্যেই বৌদ্ধরা সারা বিশ্বে সব ধর্মগুরুর চেয়ে বেশি বুদ্ধদেবের মূর্তি বসিয়ে তবেই শান্তিলাভ করেছে)।
আমি নৈতিকতা প্রসঙ্গেই এই কথাগুলো ভাবছিলাম। আমার ধারণা, জ্ঞান থেকেই এথিকস উৎসারিত, যে জ্ঞান বিবেকবোধের উপাদান। কিন্তু নৈতিকতার বোধসম্পন্ন জ্ঞান (wisdom বলতে চাই একে) কখনও শক্তিকেন্দ্রের দিকে ধাবিত হয় না। জ্ঞানই শক্তি, কিন্তু সূক্ষ্ম নলেজকে স্থূল পাওয়ারের দিকে বয়ে যাওয়া থেকে আটকায় তার নৈতিকতা।
রবীন্দ্রনাথকে বিচার করতে গিয়ে রাজনৈতিক অস্তিত্বগুলোর যে-ধরণের সমস্যা হয়েছে তার একটা উদাহরণ দিয়েছিলাম আগের অংশে। এরপর জাঁ পল সার্ত্রের অবস্থানের ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানের সংকট নিয়ে আমার সামান্য মাথায় যা এসেছে বলতে চাইবো।
(আরও একটা কি দুটো টুকরো বাকি)
loading...
loading...
জ্ঞানই শক্তি, কিন্তু সূক্ষ্ম নলেজকে স্থূল পাওয়ারের দিকে বয়ে যাওয়া থেকে আটকায় তার নৈতিকতা।
loading...
হতাম যদি তোতাপাখি সিরিজটির আলোচনা একটি ভারিক্কি চালে এগিয়েছে বিধায় পাঠক সাড়া কম। তাতে ক্ষতি বৃদ্ধি হয়নি। মন্তব্যের চাইতেও কতজন পড়েছেন সেটাই বিবেচ্য। শুভেচ্ছা প্রিয় চন্দন দা। শুভ হোক দিন।
loading...