সেই পদ্মা নদীর মাঝি
খুব ছোটবেলায় স্কুলে যখন পড়ি তখন বিটিভিতে কোন এক শুক্রবার দেখিয়েছিল ”পদ্মা নদীর মাঝি” সিনেমাটি। আমার আম্মা আর বড়বোনের আগ্রহ দেখে তখন বুঝেছিলাম যে সিনেমাটি বিশেষ কিছু, তবে আমার যথেষ্ট রকম বিরক্ত লেগেছিল সেইসময় সিনেমাটি দেখে কারণ সেটা বোঝার মত বয়স আমার ছিলোনা। এরপর কেটে গেলো কয়েক বছর এইচ এস সিতে পড়ার সময় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কালজয়ী উপন্যাসটি ছিলো আমাদের পাঠ্যসূচির অন্তর্গত। আমাদের বাংলার শিক্ষিকা খালেদা আপা আমাদের উপন্যাসটি পড়াতেন আর আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। সত্যি বলতে কি তখনো পরিপক্ব ভাবে উপন্যাসটিকে বুঝিনি কেমন জানি কুবেরের উপর রাগ হতো আমার। যাহোক অসংখ্যবার উপন্যাসটি পড়েছি যাতে পরীক্ষায় প্রশ্নের যথার্থ উত্তর করতে পারি তাই। একটি লাইন ভাব সম্প্রসারণের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো বলে মনে পড়ে সেটি হলো “ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্রপল্লীতে…” ।
মানসিক পরিপক্বতা নিয়ে যখন সিনেমাটি দেখি আমার এক অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছিলো। ছোটবেলা থেকে আমার বই পড়ার অভ্যাস তেমন নেই পাঠ্যসূচির বাইরে। তারপরো টুকটাক যা পড়েছি তার ভিত্তিতে যেসব সিনেমা বা নাটক দেখেছি এই সিনেমাটি সবথেকে ভালো লেগেছে আমার। ঠিক যেমন পড়েছি তেমন সব কোন অন্যথা নেই। তবে যেই কুবেরকে আমি মালার প্রতারক ভাবতাম এইচ এস সিতে পড়ার সময় তাকে পরে একটু অন্যভাবে চিনলাম। কপিলার মতে কুবের সেই হায় রে পুরুষ যার মধ্যে দায়িত্ব, কর্তব্য, পিতার মন, কামের আকাঙ্ক্ষা, হিংসা সব কাজ করে। এতো কণ্টকময় জীবনে তার মনের খোরাক কপিলা যাকে নিরবে ভাবতে সে ভালোবাসে, পেতে চায় তবে পারিবারিক-সামাজিক দায়বদ্ধতা তাকে আটকে ধরে। যত ব্যাপারটাকে খারাপ লাগুক না কেন এটাই স্বাভাবিক কারণ মালার হাঁটার ক্ষমতা নেই। কুবের তো একজন মানুষ, তার মনের তো কিছু চাহিদা আছে যা সে মালার মাঝে না পেয়ে কপিলার মাঝে খুঁজেছে। স্ত্রী হিসেবে মালাকে নিয়ে সে বেশ ভালো আছে একটার পর একটা সন্তান জন্ম দিয়েই যাচ্ছে তারা তারপরো কুবেরের মন অশান্ত। আপাতদৃষ্টিতে ভাবলে কুবেরকে ভালো মানুষ মনে না হওয়ার কথাই তো। তাই বইয়ের পাতা থেকে টেলিভিশনের পর্দায় না দেখলে কুবেরকে তার অন্তর্নিহিত কথাগুলো সেভাবে আমি অন্তত বুঝতাম না।
আর তাই অসংখ্য শ্রদ্ধা গৌতম ঘোষের জন্য। কি চমৎকার উপস্থাপনা, একেবারে অসাধারণ। মানিক বাবু যদি দেখে যেতে পারতেন তবে কত না খুশি হতেন সিনেমাটি দেখে। যৌথ প্রযোজনার ছবি নিয়ে যেখানে বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী বাছাই নিয়ে ঝড় চলছে এখন সেখানে এই সিনেমাটি একটি আদর্শ হতে পারে। বাংলাদেশের কত শিল্পী এতে অভিনয় করেছে আর অসম্ভব ভালো সবার অভিনয়। বাংলাদেশের শিল্পীরা আর্ট ফিল্মে অতটা পারদর্শী না অনেকে মনে করে তবে পদ্মা নদীর মাঝি দেখলে তেমনটা বলার আর কারো জো থাকবে না আমার বিশ্বাস। পরিশেষে এই বলবো সব মানুষের মন আছে আর সেই মনে চলে হাজারো কথা কখনো সেই কথাগুলো রয়ে যায় অব্যক্ত অনুভূতি হিসেবে। জীবন-সংসার সব কিছুর চাপে মানুষ ভুলে যেতে চায় তার নিজের কথা কারণ ভুলতেই হয়।
কুবেরের মতো অনেকের মনেই থাকে কপিলা তবে কয়জনের সুযোগ থাকে ময়নাদ্বীপে পালিয়ে যাওয়ার? মালা নিয়েই থাকতে হয়, বাবা হিসেবে গোপীকে ভালো পাত্রস্থ করায় চিন্তায় ব্যস্ত থাকতে হয়, সংসার নামক যন্ত্র দ্বারা পরিচালিত হতে হয়, সামাজিক দায়বদ্ধতার মুখোমুখি হতে হয়। আর এটাই উপন্যাসের সাথে মানুষের বাস্তব জীবনের তফাত। খেটে খাওয়া, পানিতে ভেজা, চরম দারিদ্র্য নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষ যুগে যুগে ছিলো আর আজো আছে। জীবনযুদ্ধে পরাজিত মানুষগুলো আদিখ্যেতা করে প্রভুকে ডাকার অবকাশ হয়তো পায়না কারণ পেটপূজা করার জন্য প্রাণপণে তাদের ছুটতে হয়। প্রেক্ষাপট বদলেছে তবে মানিক বাবুর সেই কালজয়ী উপন্যাসের পটভূমি আজো গ্রামবাংলার চিরাচরিত দৃশ্য। পদ্মানদীর মাঝিরা কখনো হারিয়ে যায় না। যতদিন পদ্মানদী াছে ততদিন সেই কুবেররা ও থাকবে সেই জেলেপাড়ার (হায়রে)পুরুষদের মাঝে।
_________
বৈতরণী হক।
loading...
loading...
অসাধারণ আলোচনা হয়েছে দি ভাই।
loading...
এটা আমার পাঠ্য ছিলো, স্কুল কি কলেজে ঠিক মনে নেই। তাই প্রথমে পড়েছি, ছবি দেখেছি পরে। পড়ার সময় ছিলো দায়, তাই ছবি দেখে আসল মজাটা পেয়েছি।
loading...
জীবনযুদ্ধে পরাজিত মানুষগুলো আদিখ্যেতা করে প্রভুকে ডাকার অবকাশ হয়তো পায়না কারণ পেটপূজা করার জন্য প্রাণপণে তাদের ছুটতে হয়। প্রেক্ষাপট বদলেছে তবে মানিক বাবুর সেই কালজয়ী উপন্যাসের পটভূমি আজো গ্রামবাংলার চিরাচরিত দৃশ্য।
loading...
"পদ্মানদীর মাঝিরা কখনো হারিয়ে যায় না। যতদিন পদ্মানদী আছে ততদিন সেই কুবেররা ও থাকবে সেই জেলেপাড়ার (হায়রে)পুরুষদের মাঝে"

loading...
* সুন্দর সমালোচনা …
শুভরাত্রি।
loading...