বাংলাদেশে পার্লার শিল্পের প্রসার

ঢাকাতে সর্বপ্রথম পার্লার প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৬৫ সালে তবে সেটা কোন বাংগালি মালিকানাধীন পার্লার ছিলোনা। স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭৭ সালে বাংগালি একজন মহিলা সর্বপ্রথম কাজ শুরু করেন বিউটিশিয়ান হিসেবে। উনার নাম জেরিনা আসগর। উনার প্রতিষ্ঠিত সেই পার্লারের নাম ছিলো লিভিং ডল। এরপর আশি থেকে নব্বইয়ের দশকের শুরু পর্যন্ত ঢাকা আর চট্টগ্রামের পার্লারগুলো পরিচালিত হতো বেশিরভাগ চাইনিজদের দ্বারা। চট্টগ্রামের লুসি এমন একটি পার্লার যা বহুদিন পর্যন্ত একচেটিয়া ব্যবসা করে গিয়েছে। চাইনিজ মালিকানাধীন এইসব পার্লার গুলো মধ্যবিত্ত শ্রেনীর নারীদের হাতের নাগালের মধ্যে ছিলো না কারণ তাদের ছিলো আকাশ ছোঁয়া সার্ভিস চার্জ।

মূলত এমন দামের কথা মাথায় রেখেই বাংগালি মালিকানাধীন পার্লারগুলোর পথ চলা শুরু হয়েছিলো নব্বইয়ের দশকে। উইমেন্স ওয়ার্ল্ড, গীতিস, ড্রিমস এমন বিখ্যাত কয়েকটি পার্লার যেগুলোর নাম মনে রাখার মতো। তারপর বলা যেতে পারে পারসনা, ফারজানা শাকিল এর কথা। সময়ের স্রোতে এখন বাংলাদেশে প্রায় কয়েক হাজারের উপর পার্লার আছে। শুধুমাত্র ঢাকা আর চট্টগ্রামে সীমাবদ্ধ নেই এই পার্লার ব্যবসা। সম্প্রতি একটি বিদেশি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে বাংলাদেশে যেসব মহিলাদের মাসিক আয় ৫০,০০০ থেকে ২,০০,০০০ টাকার মধ্যে তাদের মধ্যে প্রায় ৮৮.৩% রেগুলার পার্লার সেবা নিয়ে থাকে। তবে একথা সত্য গ্রামের মেয়েরাও এখন নিয়মিত পার্লারে যায়। গার্মেন্টস কর্মী থেকে শুরু করে বাসার গৃহকর্মী মোটামুটি সবার আনাগোনা থাকে সেখানে। উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তদের মতো দামি সেবা নিতে না পারলে ও ভ্রু প্লাক এর থ্রেডিংয়ের জন্য হলেও তারা যায়। বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গাতেই এখন পার্লার আছে নারীদের সৌন্দর্য রক্ষার জন্য। এক্ষেত্রে পুরুষরাও পিছিয়ে নেই, তাদের জন্য গড়ে উঠেছে বহু পার্লার।

যেসকল পার্লারগুলোতে সুযোগ সুবিধা বেশি থাকে সেগুলো মূলত উচ্চবিত্ত আর উচ্চ মধ্যবিত্ত নারীদের কথা মনে রেখেই গড়ে উঠছে। আর সেক্ষেত্রে এগিয়ে আসছে নারী উদ্যোক্তারা। ক্রমবর্ধমান চাহিদার কথা মাথায় রেখে পার্লার ব্যবসায় পুঁজি বিনিয়োগ করছে নারীরা। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চাকরি, সরকারি চাকরি ছেড়ে নিজের মতো করে মুনাফা লাভের আশায় এই ব্যবসায় বহু নারীরা এগিয়ে আসছে। আবার অনেকে মূল কাজের পাশাপাশি বাড়তি ব্যবসা হিসেবে রেখেছে ব্যবসাটাকে। টুকটাক বেসিক কাজ যেমন প্লাক, থ্রেডিং, ট্রিমিং এর কাজ শিখে স্বল্প পুঁজি দিয়ে অনেকে মহিলা স্বল্প পরিসরের এই ব্যবসা পরিচালনা করে। তবে সেক্ষেত্রে তাদের গ্রাহকরা মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত নারীরাই।

দেশের অন্যান্য জায়গায় বিভিন্নতা না থাকলেও ঢাকা আর চট্টগ্রাম শহরে হেয়ার স্টাইল, মেকাপ বিভিন্ন বিষয় মাথা রেখে বিশেষায়িত পার্লার গড়ে উঠেছে আর এসবের সবকিছুই হচ্ছে নারীদের চাহিদাকে মাথায় রেখে। তবে একটা ব্যাপার লক্ষনীয় যে যে কোন বিশেষায়িত পার্লারে আপনি যান না কেন সেখানে উপজাতি মেয়েদের কাজ করতে দেখা যায়। আর সেক্ষেত্রে মান্দি বা গারো মেয়েদের অংশগ্রহণ সবথেকে বেশি। মারমা, চাকমা, মনিপুরি, তংচইংগা মেয়েরা পার্লার পেশায় থাকলেও সেটা স্হানীয় পর্যায়ে। তবে বৃহত্ পরিসরে কাজ করে গারো মেয়েরাই। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, টাংগাইল, নেত্রকোণা জেলাতেই গারোরা বেশি বাস করে। প্রতিবছর হাজার হাজার গারো মেয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে আড়ি জমায় পার্লারে কাজ করার জন্য।

মূলত কমিউনিটির মধ্যে সহযোগিতা সুলভ মনোভাবের জন্য তাদের এই বিস্তার। একজনের কাজ থেকে আরেক জন ব্যক্তিগত ভাবে কাজ শিখে নেয় তারা। কাজের ক্ষেত্রে ও একজন আরেকজন কে সাহায্য করে চাকরি পেতে। তা ই বলা যেতে পারে গারো মেয়েরা অনেকটা একচেটিয়া পার্লার গুলোর কর্মী হিসেবে। মূলধারার বাংগালি মেয়েরা আগে কম কাজ করলেও আজকাল তারা ও আসছে এই পেশাতে কারণ লাভজনক একটি সেক্টর এখন এটি।

বাংলাদেশ সরকারের একটি আইন অনুসারে পার্লারের মেয়েদের সর্বনিম্ম মজুরি ধরা হয়েছে মাসিক ৩৩০০ টাকা কমপক্ষে। এই মজুরি গার্মেন্টস কর্মীদের থেকে বেশি। বিভিন্ন পার্লার ঘুরে দেখা গিয়েছে যে মেয়েরা এর থেকে বেশি অর্থ উপার্জন করে। যে মেয়েরা ভালো কাজ করে তাদের কে মালিক পক্ষ বেশি মজুরি বা সুবিধা দিয়ে রাখে কারণ তাদের জন্য আছে গ্রাহকদের চাহিদা। আর বেশি মজুরিতে অন্য পার্লারে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় তারা মজুরি বেশি হাঁকানোর সুযোগ ও পেয়ে থাকে।

পার্লারের প্রতুলতা, আন্তর্জাতিক মিডিয়ার প্রভাব, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি নিজেকে সুন্দর করে দেখার মাঝে মূলত পার্লার প্রসারের কারণ। এটি একটি লাভজনক খাত। আর বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী গারো সম্প্রদায় এবং তাদের সাথে সংশ্লিষ্টরা অন্যান্যরা আর্থিক ভাবে লাভবান হচ্ছে যা তাদের জীবনযাত্রার মান বাড়াচ্ছে। তাদের ছেলেমেয়েরা তুলনামূলক ভালো জীবনের সাথে পরিচিত হচ্ছে, লেখা পড়া করছে যা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। তবে অনেক ক্ষেত্রে হাইজিন মেইনটেন, ভালো প্রডাক্ট ব্যবহার না করায় গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। কর্মীদের আর মালিকদের স্বার্থ বিঘ্নিত হয় অনেক সময়। সরকারের আরেকটু সুস্পষ্ট নীতিমালা, সুলভ সার্টিফিকেশন কোর্স, কারিগরি শিক্ষায় বিউটিফিকেশনকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে পার্লার ব্যবসা আরো অনেক দূর অগ্রসর হতে পারবে। গার্মেন্টস একটি খাত যা নির্ভর করে আন্তর্জাতিক বাজারকে সামনে রেখে। সেই নারী ভিত্তিক আরেকটি খাত এটি। সম্পূর্ণ দেশী পরিসর নিয়ে এই সেক্টর। এই সেক্টরের উন্নয়ন নিঃসন্দেহে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক অবদান রাখতে সক্ষম।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৩ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ৩ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২২-০৬-২০১৮ | ৯:৪৪ |

    "সরকারের আরেকটু সুস্পষ্ট নীতিমালা, সুলভ সার্টিফিকেশন কোর্স, কারিগরি শিক্ষায় বিউটিফিকেশনকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে পার্লার ব্যবসা আরো অনেক দূর অগ্রসর হতে পারবে। এই সেক্টরের উন্নয়ন নিঃসন্দেহে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক অবদান রাখতে সক্ষম।" ___ নিবন্ধের বক্তব্যের সাথে একমত।

    GD Star Rating
    loading...
  2. রিয়া রিয়া : ২২-০৬-২০১৮ | ১৪:৪৮ |

    যে কোন শিল্প অথবা উদ্দীপনা এমনকি পার্লার শিল্পের প্রসারেও যে কোন দেশের নিজস্ব পৃষ্টপোষকতা অতি জরুরী। যতটুকু আপনার পোস্টে জানলাম তাতে তো বাংলাদেশের জন্য এই শিল্পের পাশে এখনই সরকারকে দাঁড়ানো উচিত। শ্রমজীবি  মেহনতি কিছু মানুষের সঠিক আয়ের সুযোগ তো অন্তত বাড়বে।

    GD Star Rating
    loading...
  3. সাইদুর রহমান১ : ২৩-০৬-২০১৮ | ১৩:২২ |

    পার্লার সম্বন্ধে অনেক গল্প শুনে থাকি বন্ধু মহলে আড্ডাকালে কিন্তু বাংলাদেশে তার জন্ম বৃত্তান্ত এবং এর বৃহৎ ব্যপ্তির অপার সম্ভাবনাটা আজকে অনুভব করলাম। যার উপর সরকারের সু-দৃষ্টি দেয়া এখন সময়ের দাবী।

    GD Star Rating
    loading...