(গি দ্য মোঁপাসা একজন ফরাসি সাহিত্যিক। খুব ছোটবেলায় তাঁর লেখা একটি ছোট গল্পের বংগানুবাদ পড়েছিলাম যা আমার মনে এখনো দাগ কেটে আছে। আমার আজকের গল্পটা সেই গল্পের ছায়া অবলম্বনে আমার মতো করে লিখার চেষ্টা করছি)।
কলি অপূর্ব সুন্দরী একজন মেয়ে, বয়স হবে ২০ কি ২১। কলির বাবা একজন স্বল্প বেতনের সরকারী কর্মচারী। কলি বুঝে আর জানে সে অপূর্ব সুন্দরী আর তার জন্য খুব অহংকার কাজ করে তার মধ্যে। সে কখনো মেনে নিতে পারেনা নিজেদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা আর দৈন্যতা। বরাবর সে চেয়েছে বড়লোক পরিবারের মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব বজায় রাখতে। কলির চাহিদা পূরণের জন্য তার মা-বাবাকে করতে হয় অনেক কষ্ট, কলি কোনদিন ও ছাড় দেয়না তার ছোট বোন মলির কথা চিন্তা করে। বড্ড জেদি আর স্বার্থপর মেয়ে কলি।
কলি লেখাপড়ায় বিশেষ মনোযোগী না আর তা হবেই বা কেনো। সে তো জানে সে মহা সুন্দরী, পাড়ার ছেলেরা তার জন্য সব পাগল ভালো বিয়ে ওর এমনিতেই হবে। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর ভালো কোথাও চান্স না পেয়ে সে তার বাবাকে চাপ দিতে লাগলো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর জন্য। কলির গরীব বাবা উপায় না পেয়ে দেশের কিছু জমি বিক্রি করে আনলো মেয়ের প্রথম সেমিস্টারের টাকা দেয়ার জন্য আর চেষ্টা করছিলো আরো কিছু জমি বিক্রি করার পরের সেমিস্টারের টাকা দেয়ার।
এর প্রায় ৫ কি ৬ মাস পর কলিদের পরিবারে ঘটে গেলো এক বড় দুর্ঘটনা। কলির বাবা হঠাত্ করে মারা যান। কলির মা আফরোজা পড়ে যান বিশাল বিপাকে। কি করে চালাবেন তিনি সংসার, সরকারী বাসা ছেড়ে ভাড়া বাসায় দুই মেয়ে নিয়ে কেমন করে থাকবেন এই ঢাকা শহরে! আফরোজার ভাই আফতাব এসে তাদের নিয়ে গেলেন দেশের বাড়ি নরসিংদিতে। মলিকে ভর্তি করে দিলেন সেখানে স্কুলে। কিন্তু কলি তার কি হবে? যা হবার তাই কলির বাবা মফিজ মিয়ার পরিবার রাজি হলোনা আর কোন সম্পত্তি দিতে তাদের কথা আগেই তাদের ভাগের জমি বেচে টাকা নিয়ে গিয়েছে মফিজ। অগত্যা পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেলো কলির। আফতাব উঠে পড়ে লাগলেন কলির বিয়ে দেয়ার জন্য।
কলি খুব সুন্দরী বলে আফতাবের কষ্ট হলোনা ভালো পাত্র পেতে। ইশতি নামের এক ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হলো কলির। মাস্টার্স পাস ছেলে, একটা ভালো ওষুধ কোম্পানিতে রিপ্রেসএন্টেটিভের চাকরি করে। যে আয় তার কলিকে নিয়ে ঢাকা শহরে খেয়ে পরে ভালোই থাকবে। কলির এই বিয়েতে তেমন মত ছিলোনা। তার তো স্বপ্ন ছিলো অনেক বড়লোকের ব উ হবে, দামি কাপড় গয়না পরবে কিন্তু ইশতির সাথে বিয়ে হলে তো মামুলি জীবন কাটাতে হবে। কি আর করা উপায়ন্তর না দেখে ইশতিকেই বিয়ে করলো কলি।
ইশতি ভদ্র ছেলে, নম্র। কলিকে খুব ভালোবাসে। তবে কলির কাছে এই বিয়েটা একটা সমঝোতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ইশতি সামর্থ্যনুযায়ী কলিকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়, কাপড় কিনে দেয় তাতে কলির সন্তুষ্টি আসেনা। দুইজন মানুষের ঘরের কাজ তাও সে করে না পাছে তার রং কালো হয়ে যায়, হাতের আংগুলে কড়া পড়ে যায় পাছে চেহারাতে ক্লান্তির ছাপ আসে!
এমন করে চলে যাচ্ছিল তাদের দিনগুলি। এমন সময় ইশতি একদিন অফিস থেকে এসে বললো যে তাদের কোম্পানির মালিক সব স্টাফদের জন্য একটা বড় পার্টি দিবেন কোম্পানির অনেক লাভ হয়েছে বলে।
ব্যস শুরু হয়ে গেলো কলির চিন্তা। এতো বড় পার্টি আর এমন হোটেলে সে কোনদিন ও যায়নি। সে এতো সুন্দরী এটাই হবে সুযোগ সবার কাছে নিজেকে প্রকাশ করার। সে ইশতিকে বললো মার্কেটে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ইশতি নিয়ে যেতে চাইলো নিউমার্কেটে তাতে কি আর কলির মন ভরে।
অগত্যা সে গেলো তার এক বান্ধবীর বাসায় তার নাম ফারাহ, যে কয়দিন ভার্সিটিতে পড়েছিলো ফারাহর সাথে তার বন্ধুত্ব তৈরী হয়েছিলো। কলি ফারাহকে তার সমস্যার কথা খুলে বললো। ফারাহ আলমারি থেকে তার ভালো কিছু শাড়ি আর গয়না বের করে দিলো কলিকে।
ফারাহ: তোর যেটা ভালো লাগে তু দেখে নে।
এর মধ্যে ঝকমক করছে একটা গলার হার আর একজোড়া কানের সেট দেখে খুব লোভ হলো কলির। সেটটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে খুব দামী। সে হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো আর এও খেয়াল করলো ফারাহ কেমন জানি ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে কলির সেটা নেয়া দেখে। কলি বেশ বুঝতে পারলো সবকিছুর সাথে এটাও বের হয়ে গিয়েছে অজান্তে তবে ফারাহ দিতে চাচ্ছেনা।
কলি বেশ লোভী সে ভাবলো নিবো যখন ভালোটাই নেই একদিনের জন্যই তো।
কলি: আমি কি এটা নিতে পারি, ঠিক দিয়ে যাবো ফেরত। তুই ভাবিস না একদম।
ফারাহ (একটু ইতস্তত করে): ঠিক আছে নে তবে আমার খুব শখের জিনিস রে। তোর ভাইয়া আমার ম্যারেজ ডেতে গিফট করেছে, সাবধানে পরিস।
কলি: তুই ভাবিস না এটার কোন ক্ষতি হবে না।
এরপর কলি চলে গেলো সব নিয়ে। অনুষ্ঠানের দিন পার্লার থেকে সেজে আসলো আর ফারাহর জিনিসগুলো পরলো। অপূর্ব লাগছিলো কলিকে, একেবারে নায়িকা। সেই পাঁচতারকা হোটেলে সবাই ঘুরে ঘুরে দেখছিলো কলিকে, সবাই তো অবাক ইশতির বউ এতো সুন্দর এ যেন গোবরে পদ্মফুল।
সব বড় বড় লোকরা কলির সাথে কথা বলতে চাইছিলো, কলি বোকা তাদের মনোবাসনা বুঝতে না পেরে তাদের সাথে খুব করে গল্প করছিলো। ইশতি সব বুঝতে পেরে রাতের ডিনার শেষ হওয়ার কিছু পরেই অসুস্হতার নাম করে কলিকে নিয়ে বাসায় আসলো। আর কলির কি রাগ তাতে।
বাসায় এসে কাপড় আর গয়না ছাড়তে ছাড়তে কলি গলায় হাত দিয়ে দেখে হারটি নেই। চিত্কার দিয়ে উঠলো। ইশতি পাগলের মতো ছুটে গেলো হয়তো ক্যাবেই পড়ে গিয়েছে। আবার ছুটে গেলো হোটেলে সে পেলোনা, ক্যাবের নাম্বার জানেনা, অন্ধকারে ড্রাইভারের চেহারাটাও মনে নেই। ভীষণ বিপদে পড়ে গেলো তারা।
তার একদিন পর ফারাহ ফোন দিয়ে বললো জিনিসগুলো ফেরত দিতে কারণ সামনে একটা বিয়ের অনুষ্ঠান আছে লাগবে সব। কলি আর ইশতি উপায় না দেখে অনুষ্ঠানের কলির এক ছবি নিয়ে গেলো জুয়েলার্সের দোকানে। জুয়ালার্সের লোক বললো ছবি দেখে যে যে সোনা আর হীরা দিয়ে তৈরী এই হারের দাম পড়বে মজুরি সহ তিন লাখ টাকার মতো। ওদের তো মাথায় বাজ। তাও তারা রাজি হয়ে গেলো, এক সপ্তাহের মধ্যে বানিয়ে দিতে হবে তো। অনেক কষ্টে আড়াই লাখে রাজি হলো দোকানদার।
ইশতি অনেক সুদে তাড়াতাড়ি করে একটা লোনের জোগাড় করলো। তারপর গয়না আর বাকি সব জিনিস কলি ফেরত দিয়ে আসলো ফারাহকে। কিন্তু লোনের টাকা দেয়ার জন্য কলিকে করতে হলো অনেক ত্যাগ। খরচ কমানোর জন্য কাজের মানুষ ছাড়িয়ে দিলো নিজেই সব কাজ করে এখন, রেস্টুরেন্টে যাওয়া তো দূর বাসায় সপ্তাহে দুইদিন মাছ বা মাংস রান্না হয়, গত দুই ঈদে নিজে কোন কাপড় নিতে পারেনি এমনকি খরচ হবে বলে তারা বাড়ি পর্যন্ত যায়নি। এমন করে কেটে গেলো দুই বছর। লোনটা ও শেষ প্রায় আসলে সুদের জন্য এতো দেরি হচ্ছে।
ফারাহর সাথে ইচ্ছা করেই যোগাযোগ আর রাখেনি কলি ভয়ে পাছে ফারাহ কোনভাবে টের পায় আসল ঘটনা। এমন একদিন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো কলি। ফারাহ তাকে দেখে গাড়ি থামাতে বললো ড্রাইভারকে।
ফারাহ: আরে কলি কেমন আছিস? একি চেহারা তোর? কোন যোগাযোগ রাখিস না, ফোন করলে ধরিস না কি হয়েছে তোর?
কলি: নারে তেমন কিছুনা। তুই কেমন আছিস?
এমন টুকটাক কথার পর ফারাহ কলিকে জোর করে নিয়ে গেলো কফি শপে। তারপর জানি কি মনে করে কলি সব বললো ফারাহকে। ফারাহ শুনে তো অবাক।
ফারাহ: একি করেছিস তোরা। আমি বলেছি জিনিসটা দামি তবে এটা অনেক দামি ইমিটেশনের গয়না। তোর ভাইয়া বোম্বে থেকে এনেছে। এইসব জু্য়েলারি নায়িকারা পরে। এটা তো সোনাও না বা হীরা না। একবার কানের দুল দিয়ে চেক করে নিতে পারতি। আমাকে কেনো তুই সাহস করে বললিনা?
কলির মাথায় বাজ পড়লো। না জেনে, বুঝে সে নিজে কষ্ট করলো আর ইশতি ও কত কষ্ট করে তার ভুলের জন্য। রিক্সাতে না উঠে, বাসে না চড়ে হাঁটে, খাবারের কষ্ট করে, বাড়ি যায়না খরচের ভয়ে। কলি আজ বুঝতে পারলো তার এতো দিনের ভুল। তার লোভ, অতিরিক্ত মাত্রায় অপ্রয়োজনীয় উচ্চাংক্ষা তার এই পরিণতির জন্য দায়ী। বড় লোভী মানুষ সে, লোভের কারণে সে তার মা-বাবা, বোন, স্বামী সবাইকে কষ্ট দিয়েছে। এটা তার প্রাপ্য ছিলো।
এতোদিন পর সে অনুধাবণ করলো যে কথাটা আসলে মিথ্যা নয়- লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু।
loading...
loading...
আমাদের দেশের উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের জন্য লিখাটি শিক্ষণীয় হয়ে থাক। শেয়ার করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। একটা কথা বলি; আপনার লিখায় যথেষ্ট পরিপক্কতা এবং দক্ষতার ছাপ রয়েছে, আমরা পাঠক হিসেবে আরও আরও বেশী করে আপনার লিখা পড়তে চাই। শব্দনীড় এ আপনাকে নিয়মিত দেখতে চাই।
loading...
মোপাশার মুল গল্পটির নাম ছিল 'নেকলেস'। অনেক বিখ্যাত একটি গল্প। আকাশবাণী থেকে নাটকও শুনেছি। আপনার গল্প পড়লাম। শুভ কামনা রইল।
loading...
অসাধারণ।
loading...