গত জানুয়ারী মাসে আমার অভিজ্ঞতা হয়েছিল জীবনের দীর্ঘতম ট্রেন ভ্রমনের। ব্যক্তিগত জরুরী একটি কাজে ঢাকা থেকে কোলকাতা হয়ে চেন্নাই যেতে হয়েছিল। ট্রেন ভ্রমনের সেই অভিজ্ঞতাই তুলে ধরছিঃ
ভারতের শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষই দূরের যাত্রায় ট্রেনে চলাচল করে। বিস্তৃত এই দেশের রেলওয়ে ব্যবস্থাপনাও ব্যাপক পরিসরের। ঢাকা থেকে আন্তর্জাতিক বাসে কোলকাতার মারকুইস স্ট্রীটে পৌঁছানোর পর, চেন্নাই যাবার জন্যে রেলওয়েই বেছে নিলাম। অবশ্য কিভাবে যাবো তার প্ল্যান দেশ থেকেই করা ছিল। প্ল্যান ছিল কোলকাতায় একদিন থাকবো, কারন ভারতে দিনের টিকেট দিনে পাওয়া খুব কঠিন। কিন্তু আল্লাহ সহায় ছিলেন বলে, সেদিন রাতের “চেন্নাই এক্সপ্রেস” ট্রেনের টিকেট পেয়ে গেলাম। সময় লাগবে ২৮ ঘন্টা, পথের দুরুত্ব ১৭০০ মাইল। আমার ভ্রমন সাথী ছিলো আমারই এক বন্ধুবর।
দুপুর একটায় কোলকাতায় পৌছেছিলাম, আর ট্রেন ছাড়ার সময় ছিলো রাত সোয়া এগারোটায়। মাঝের এই সময়টুকু কোলকাতা শহরে ঘুরে ফিরেই কাটালাম। ভারতীয় ট্রেনের টিকেট সাধারণত ৩ ধরনের হয়। কিছু টিকেট আগে থেকেই ছাড়া হয়। কিছু টিকেট যেদিন ট্রেন যাবেন, সেদিন সকালে ছাড়া হয়- এ টাইপ টিকেটের নাম- তৎকাল টিকেট। আর কিছু টিকেট ‘রিজার্ভড/ সংরক্ষিত’ (সৈনিক, বিদেশী ইত্যাদি কোটার)। অনলাইন ও রেলওয়ে স্টেশন থেকে- দুই ভাবেই টিকেট কাটা যায়। স্টেশনে টিকেট পাওয়া কঠিন, তাই অনলাইনেই টিকেট কিনেছিলাম। যেহেতু আমাদের ইন্ডিয়ান বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট কার্ড নেই, তাই একটা ট্র্যাভেল এজেন্সির মাধ্যমে টিকেট কেটেছিলাম। ওরা নির্দিস্ট রেটের চেয়ে ৩০০/ ৫০০ রুপি বেশী রাখে। তবে কোলকাতা হলো চিটারদের শহর। এই শহরের মানুষ যে কি পরিমান চিটার, তা আপনার ধারনারও বাইরে। তাই আপনাকে কয়েকটা ট্রাভেল এজেন্সি ঘুরে, টিকেটের আসল দাম জেনে, দরদাম করে টিকেট কাটতে হবে।
গরুর গোশত দিয়ে পেট পুরে রাতের খাবার খাওয়ার পর (গরুর গোশতের কেজি ১৫০ রুপি মাত্র), ট্যাক্সিতে করে হাওড়া স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। স্টেশনে পৌঁছে দেখি- সে এক এলাহি কারবার! সুবিশাল স্টেশন, হাজার হাজার মানুষে ঠাসা। বিভিন্ন ভাষাভাষির মানুষ (ভারতে প্রায় ৫০টির মত ভাষা আছে, অফিসিয়ালি সম্ভবত ১৮ টার মত)। কেউ বসে আছে, কেউবা পরিবারসহ বিছানা বিছিয়ে শুয়ে আছে। ট্রেন আসছে-যাচ্ছে, মানুষ বিভিন্ন ভাষায় কোলাহল করছে, গমগম করছে পুরো স্টেশন। ভারতের অনেক স্টেশনেই দেখলাম গুগল হাই স্পীডের ফ্রি ওয়াইফাই সেবা দিয়ে রেখেছে। স্টেশনে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা আছে। আমরা প্রায় এক ঘন্টা আগে পৌছেছি।
স্টেশনে বসে যখন আড্ডা দিচ্ছিলাম, তখন ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর একজন যাত্রীর সাথে আলাপ হলো। সে বাংলা বোঝে না, আমি আবার হিন্দি বুঝি না। তাই আলাপটা ইংরেজীতেই করতে হলো। তবে আলাপ খুব বেশি জমলো না, কারন সে ইংরেজী বুঝলেও খুব বেশি বলতে পারে না। তবে সে ছিল একদম অল্প বয়েসের। আমি বিদেশী এটা জানার পরও বোকার মত, অথবা নিজেকে জাহির করতে গিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলো- আমার পাসপোর্ট আছে কিনা? আমি পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম- পাসপোর্ট না থাকলে সীমান্ত পেরিয়ে আমি এখানে কিভাবে এলাম (তোমাদের কাস্টমস-বিএসএফ কি আমার খালু)? বেচারা সেখানেই লা-জবাব।
ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢোকার বেশ আগেই দেখলাম প্ল্যাটফর্মের একটা বিশাল নোটিশবোর্ডে যাত্রীদের তালিকা আটকে দেয়া হলো। অনেক খুঁজে আমাদের নাম বের করে নিশ্চিত হলাম- আমরা যাচ্ছি। নির্দিস্ট সময়ের আগেই ট্রেন প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করলো। দুপুর থেকে এ পর্যন্ত কয়েক জন বাংলাদেশীর সাথে পরিচয় হয়েছিলো, তারা যাবে ভেলোরে (চেন্নাই থেকে প্রায় ৫০০ কি.মি পরে)। একই সাথে টিকেট কেটেছিলাম আমরা। যাহোক ট্রেন ও বগি নাম্বার মিলিয়ে উঠে পড়লাম সবাই।
চেন্নাইতে যাবার সময় আমরা ‘থ্রি টায়ার’ টিকেট কেটেছিলুম। ‘থ্রি টায়ার’ মানে কামরার প্রতি সাইডে ৩টি করে শোবার বিছানা। নীচে একটি, মাঝে একটি এবং উপরে একটি। আমার সীট পড়েছে ডানপাশের নীচের টায়ারে আর বন্ধুবরের বাম পাশের নীচের টায়ারে। কিন্তু আমাদের সহযাত্রী ছিলো অন্ধ্র রাজ্যের এক দম্পত্তি। স্বামী ভদ্রলোকটি বন্ধুবরকে অনুরোধ করলো যাতে সে নীচের সীট ছেড়ে একদম উপরের সীটে যায়। এতে করে উনারা স্বামী-স্ত্রীর নীচের ও মাঝের- এই দুটোতে শুতে পারবেন। উনার ভাষা তেমন বুঝি নি, তবে ইশারা ইঙ্গিতে বুঝেছি। ভদ্রলোকের অনুরোধ রাখা হলো।
একদম নির্দিষ্ট টাইমে ট্রেন ছেড়ে দিলে, নো লেট। দেখলাম বাংলাদেশী ট্রেনের তুলনায় প্রায় তিনগুন স্পীডে চলছিল ট্রেনটি। যতটুকু জানি, ভারতের বেশীরভাগ ট্রেনই ইলেক্ট্রিসিটিতে চলে। রেল লাইনের পাশ দিয়ে শত শত মাইল জুড়ে ইলেক্ট্রিসিটির লোহার থাম। রেললাইনের উপরে ঝুলে থাকা তার হতে বিদ্যুত আহরন করে সজোরে চলছে ট্রেনটি। রাতের আঁধারে জানালার কাঁচ দিয়ে বাইরের দৃশ্য অস্পষ্ট লাগছে। অচেনা প্রান্তর বেয়ে ছুটে চলছি…। (স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ছেলে বেলার সেই ছড়াটা মনে পড়ছে… )
ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে অই।
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই ?
একটু জিরোয়, ফের ছুটে যায়
মাঠ পেরুলেই বন।
পুলের ওপর বাজনা বাজে
ঝন ঝনাঝন ঝন।
দেশ-বিদেশে বেড়ায় ঘুরে
নেইকো ঘোরার শেষ।
ইচ্ছে হলেই বাজায় বাঁশি,
দিন কেটে যায় বেশ।
থামবে হঠাৎ মজার গাড়ি
একটু কেশে খক।
আমায় নিয়ে ছুটবে আবার
ঝক ঝকাঝক ঝক।
(চলবে… )
loading...
loading...
আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় একটি পাঠ হচ্ছে ভ্রমণ।
সুযোগ পেলে আজও আমি গোগ্রাসে গিলি। ভীষণ ভালো লাগে। চলুক …
loading...
ধন্যবাদ প্রিয়
loading...
সুন্দর বর্ণনা। সিরিজটিতে নিয়মিত রাখার অনুরোধ করছি।
loading...
জ্বি
loading...
ভালো শুরুবাদ। নিয়মিত উপহার দিন এর পরের অভিজ্ঞতা।
loading...
ধন্যবাদ দাদা
loading...
ট্রেন ভ্রমনের সেই অভিজ্ঞতা আরও জানতে চাই।
loading...
loading...