পর্যটকের ডায়েরীঃ ইন্ডিয়াতে ট্রেনে ভ্রমণ (শেষ পর্ব)

দ্বিতীয় পর্বের পর…
সকাল হয়েছে। ধীরে ধীরে জেগে উঠলো সবাই। ট্রেনেই বেসিনে হাত মুখ ধোয়ার ব্যবস্থা ছিলো। একটু সকাল হতেই ট্রেনের বিশেষ বেয়ারা আসলো নাস্তার অর্ডার নিতে। অবশ্য আমরা সকালবেলার নাস্তা আমাদের সাথে থাকা সুস্বাদু বিস্কেট, পাওরুটি, শুকনো খাবার, চিপস, কলা ইত্যাদি দিয়েই সেরে ফেললাম, এবেলা আর ট্রেনের খাবার খাই নি। নাস্তার সময় ভারতীয় দিদিমনিকে খাবার সাধলাম। উনি প্রথম বারেই নিঃসংকোচে খাবার নিলেন। একটুপর উনিও শুকনো খাবার বের করলেন। পিঠে জাতীয় এক ধরনের প্যাঁচানো শুকনো খাবার আমাকে সাধলেন। এবার আমি বিপদে পড়লাম। গতরাতে তার দেয়া খাবার নেই নি, অথচ সকালে উনি আমারটা নিয়েছেন। এবার না নিলে খুব দৃষ্টিকটু হয়ে যায়, তাই নিলাম। বন্ধুবর তো রেগে গিয়ে মাতৃভাষায় বলেই ফেললো- কেন নিলি? যদি কিছু মিশিয়ে দেয়? আমি শুকনো পিঠে চিবুতে চিবুতে বোঝালাম- এবার আর না করাটা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তাকেও শুকনো পিঠে দিলাম। বাহ! এবার দেখি বন্ধুবরও পিঠে চিবুচ্ছে।


পাহাড়ি এলাকায় ট্রেন থেকে মোবাইলে তোলা ছবি।

ওদিকে মাঠ-ঘাট-জনপদ-প্রান্তর বেয়ে ট্রেন অবিরাম ছুটে চলছে। এ ছোটার যেন শেষ নেই। রেললাইনের দু’পাশে বিস্তৃত খালি প্রান্তর পড়ে রয়েছে। খালি প্রান্তের মাঝে ফসলি জমি আর কৃষকের বাড়িও রয়েছে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রাম এবং শহরতলী পেরিয়ে যাচ্ছি। বার কয়েক ট্রেনের দরজা খুলে দাঁড়ালাম। কিন্তু এত জোরে ট্রেন চলছে যে, দাঁড়ানোটা বেশ বিপদসংকুল মনে হলো। মাঝে মাঝে কোন কোন ইস্টিশনে মাত্র দুই-এক মিনিটের জন্যে ট্রেন থামছে। নানান ভাষার মানুষ উঠছে, আবার অনেকেই নামছে। পুরো কামরা জুড়ে ভারতীয়রা নিজ নিজ প্রদেশের ভাষায় গল্প করছে। মজার ব্যপার হলো ভারতের এক প্রদেশের মানুষ আরেক প্রদেশের ভাষা তেমন একটা বোঝে না। তাই খুব প্রয়োজন না হলে, তাদেরকে অপরিচিতদের সাথে কথা বলতে দেখলাম না। হয়তো এক দেশে থেকেও এদের কাছে অপর প্রদেশের মানুষকে ভিনদেশী অনুভব হয়। অপরিচিতদের সাথে পারস্পারিক যোগাযোগের সময় এরা সাধারণত হিন্দি ব্যবহার করে। একসময় বড় একটি স্টেশনে ট্রেনটি থামলো। সে সময় আমাদের পানির খালি বোতল স্টেশন থেকে ভরে নিলাম।

দুপুর বেলায় ট্রেনের বেয়ারা খাবারের অর্ডার নিতে আসলো। এই ট্রেনে ভাত, মুরগি, ডিম, ডাল সহ বিভিন্ন পদের খাবার পাওয়া যায়। যেহেতু আল্লাহর নামে জবাই না করা পশুর গোশত খাওয়া মুসলিমদের জন্যে নিষিদ্ধ, তাই আমাদেরকে ‘ডিম-ভাত’ এর প্যাকেজই অর্ডার করতে হলো। প্রায় দেড়-ঘন্টা পর বেয়ারা একে একে সবার খাবার দিয়ে গেলো। খাবার দেয়া হয়েছে ওয়ানটাইম ট্রে তে করে। ট্রে টা মূলত খোপ খোপ সিস্টেমের। দেখলাম এক খোপে সাদা ভাত, আরেক খোপে ডাবল ডিমের তরকারি, একটাতে ডাল, একটাতে ছোট কালো মিস্টি রয়েছে। খাবারের সাথে ওয়ানটাইম চামচ এবং এক প্যাকেট পিকল দিলো। খাবার দেখতে ভালো হলেও খেতে হোস্টেলের খাবারের বিস্বাদই লাগলো। দম চেপে খেয়ে নিলাম। বাঙালি খাবারের সেই চিরচেনা স্বাদের জন্যে জিহ্বাটা যেন হাহাকার করে উঠলো।

মাঝখানের এক জংশনে ট্রেনের এঞ্জিন বদল করা হলো। দুপুর পেরিয়ে সূর্য্যি মামা বিকেলের দিকে এগুচ্ছে। ঝিক ঝিক করে ট্রেন চলেছে পাহাড়ী পথ ধরে। দু’পাশ জুড়ে বিশাল পাহাড় এবং উপত্যকা শুয়ে রয়েছে। মাঝে মাঝে পাহাড়ের পাদদেশে চমৎকার সব জনপদ দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের কোল ঘেষে নানা রঙের ছোট ছোট বিল্ডিং ছড়িয়ে রয়েছে। পশ্চিম দিগন্ত হতে সূর্য্যি মামা তার নরম-কোমল রোদ ঢেলে দিচ্ছে জনপদের উপর। আমার মন চাচ্ছিলো সব ছেড়ে নেমে যাই এই ছোট্ট জনপদে। ছোট্ট একটি ঘরে ঠাঁই নেই এবং এখানেই পাহাড়ের কোলে থেকে যাই।

দিন গড়িয়ে রাত নেমেছে, চিরচেনা একরাশ আঁধার নিয়ে। বাইরের কালো আঁধারের দিকে তাকালে বুকের মাঝে যেন এক বিশাল শূণ্যতা হাহাকার করে উঠে। একেলা আমি, আর এই আমার ছুটে চলা, জীবনের টানে।

রাতে ভারতীয় দিদিমনি আমাকে তার ভাষায় কি যেন জিজ্ঞেস করলেন। ইশারায় বোঝালাম- বুঝি নি। তারপর দিদিমনি বললেন- মাম্মি, ড্যাডি? বুঝলাম আমার সাথে বাবা-মা কেন নেই, তারা কোথায়- সেটা জানতে চাচ্ছে। তখন চেন্নাইতে কেন যাচ্ছি, সেটা ইশারা ইংগিতে বোঝালাম। কতটুকু বুঝলো আল্লাহ মা’লুম। সন্ধ্যা পেরুতেই বেয়ারা রাতের খাবারের অর্ডার নিতে এলো। এবার ডিম আর চাপাতি (পরোটা) অর্ডার দিলাম। কিন্তু রাতের খাবারের এই প্যাকেজে চাপাতি, ভাত, ডিমের তরকারি, ডাল, পিকল ও মিস্টান্ন ছিলো। একটা জিনিস বুঝলাম, খাবারের পর মিস্টান্ন খাওয়াটা ভারতীয় ঐতিহ্যেরর অংশ। রাত ক্রমশ বেড়েই চলছে। গত রাতের মত সবাই তৈরি হচ্ছে ঘুমানোর জন্যে। একসময় আমরাও বিছানা করে নিলাম। খুব ভোরে ট্রেন পৌঁছবে চেন্নাইতে, তাই বেশী রাত না করে শুয়ে পড়লাম।

তবে গত রাতের মতোই ট্রেনে খুব একটা ঘুম হলো না। ভোররাতে বন্ধুবর আমাকে ডেকে তুললো। চোখ মেলে দেখি চেন্নাইয়ের কাছাকাছি চলে এসেছি প্রায়। ট্রেন গতি কমিয়ে দুলকি চালে এগিয়ে চলছে। দাঁত ব্রাশ করে হাত মুখ ধুয়ে রেডি হয়ে বসলাম। প্রায় ঘন্টাখানেক পর ভোর চারটার দিকে আমাদের ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি ‘চেন্নাই সেন্ট্রাল রেল স্টেশনে’ প্রবেশ করলো। দীর্ঘ ২৮/ ২৯ ঘন্টার ট্রেন যাত্রা শেষ হলো। এটিই ছিলো ট্রেনটির শেষ স্টেশন। ধীরে সুস্থে ট্রেন থেকে নামলাম। এরপর প্ল্যাটফর্মে বসে রইলাম আরো এক ঘন্টা। অচেনা দেশ, তাই আলো ফোটার আগে হুট করেই স্টেশনের বাইরে বের হলাম না। ভোরের অপেক্ষায় ঘুম জড়ানো চোখে বসে আছি আমরা দু’জন। অপেক্ষায় আছি এক অচেনা শহরের সাথে নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে। (সমাপ্ত)

পরবর্তীতে আসছে: আমার চোখে চেন্নাই শহর

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৮ টি মন্তব্য (লেখকের ৪টি) | ৪ জন মন্তব্যকারী

  1. সুমন আহমেদ : ০৪-০৫-২০১৯ | ২১:১৩ |

    সার্থক ভ্রমণ অভিজ্ঞতা। ভালো লেগেছে। ধন্যবাদ কামাল উদ্দিন মেহেদী ভাই। 

    GD Star Rating
    loading...
  2. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ০৪-০৫-২০১৯ | ২১:১৮ |

    ভ্রমণ বৃত্তান্তের পাশাপাশি পাহাড়ি এলাকায় ট্রেন থেকে মোবাইলে তোলা ছবিটি অসাধারণ। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    GD Star Rating
    loading...
  3. রিয়া রিয়া : ০৪-০৫-২০১৯ | ২১:২১ |

    সুন্দর লিখেছেন দাদা। 

    GD Star Rating
    loading...
  4. মুরুব্বী : ০৪-০৫-২০১৯ | ২১:৪০ |

    ট্রেনে ভ্রমণের আপাত সমাপ্তি পড়লাম। অভিনন্দন মি. কামাল উদ্দিন মেহেদী। ধন্যবাদ। Smile

    GD Star Rating
    loading...