সেই বাড়ীটা

ঐ স্কুল থেকে আবার ফোন এল। আমি বাড়ীতে আসতে বললাম। ভেবেছিলাম আসবে না। অনেকেই করব বলে করে না, আসবে বলে আসে না। কিন্তু ওরা এসেই পড়ল। আমি দিঘীর পাশে রাস্তা দিয়ে ওদের আসতে দেখলাম। আগেই দুটো চেয়ার পেতে রাখলাম। আমি কমলালেবু আর খেজুর খাচ্ছিলাম। খেজুর খেতে ভালো লাগে কিন্তু দাঁতে যেন জড়িয়ে যায়।
এ-কি তুমি বেলা দশটায় ফল খাচ্ছো?
এর আগে চিনি দিয়ে একটা পাঁউরুটি খেয়েছি।
পাঁউরুটি? বলে দু-জনেই হাসতে থাকে।

রান্নার মেয়েটার শরীর স্বাস্থ্য দিন দিন ভালো হচ্ছে, কিন্তু মেজাজ তিরিক্ষি হচ্ছে। প্রায়ই বলে সে কলকাতায় কাজে যাবে, সেখানে অনেক বেশী মাইনে। অথচ কয়েক মাস আগেই দুশো টাকা বাড়ালাম। অবশ্য যুবতী মেয়ের কাছে দু-শো টাকার দাম খুবই সামান্য। ওকে এখন আবার চা করতে বললেই খ্যাচ খ্যাচ করতে থাকবে।
তোমরা একটু চা বিস্কুট খাও।

ওরা নীরবে হাসে। তার মানে করতে হবে। নীচে নেমে দেখি হেনা রান্নায় ব্যস্ত। আমাকে দেখেই বলল, ঠিক আছে আজ করছি কিন্তু রোজ রোজ এমন করা যাবে না।
এই বয়সে যদি রোজ করতে ভয় পাও তাহলে কবে তুমি করবে? এই বলে আমি নকল বিরক্তি প্রকাশ করি। আমার ধারণা ও যতই হুমকি দিক সহজে কাজ ছাড়বে না।
ধুধ না লাল। বানান ভুল লিখিনি ভাই ও দুধ কে সর্বদা ধুধ বলে। আচ্ছা, ধুধই করো।

ওপরে ওরা বসে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল। তোমাকে অফারটা ভেবে দেখতে বলছি—তুমি যা বলছ আমরা যা বলছি এর মাঝামাঝি একটা রফা করো।
চারিদিকে ফাঁকা মাঠ। মাঠের মধ্যে একটা কবেকার ভাঙ্গা বেড়ার ঘর। স্কুলের ছাদ থেকে ওই ঘরটা দেখা যায়। কাছেই একটা ডোবা। এই জায়গাটা এভাবেই পড়ে আছে দেখি। যদিও এই অঞ্চলের অনেক জায়গায় এখন প্রোমোটারদের থাবা পড়েছে। স্কুলে থাকার অসুবিধা হল। ছাত্রদের ঘরে বড় চেঁচামেচি। আমার একা থাকার অভ্যাস। ভোরে বা দুপূরে ওই জায়গাটা খুব ভালো লাগে। কিন্তু বিকেলের পরেই সব কেমন বিষন্ন হয়ে যায়। কাছাকাছি কোন দোকান পাট নেই। প্রায় দুশো মিটার দূরে পাকা রাস্তা। সেখান থেকে হুস হাস গাড়ি যায় কিন্তু কেউ থামতে চায় না।

এ-দিকে রোজগারের কথাও তো আমায় ভাবতে হবে। চাকরী বাকরীর চেয়ে এই ধরণের টেম্পোরারি কাজে বেশ বৈচিত্র আছে। ওরা আমাকে স্কুলের আবাসিক ইংরাজী শিক্ষক করতে চায়। এই আমার দুর্বল জায়গা। আমার ইংরাজী জ্ঞানের মর্যাদা যখন কেউ দেয় তখন আমি নরম হয়ে পড়ি।আবার ঐ স্কুলে ফেরার এই তো কারণ।

সময়টা নভেম্বরের ২৭ তারিখ হবে বোধহয়। পরীক্ষার পরে ছাত্রাবাস ফাঁকা হয়ে গেল।মনীর নামের এক রাজমিস্ত্রী স্কুলে থাকত। একটা খোলা বারান্দার এক কোণ ঘিরে একটা খাট পেতে তাতে মশারী টাঙ্গিয়ে শুতো। লোকটা রাতে মাল খেত। আমাকেও বোঝাতো যে মাঝে মধ্যে খেলে কোন দোষ নেই। এমন কী রোজ খেলেও শরীরের এবং মনের পক্ষে ভালো। এই তো সে খাচ্ছে তাতে কী তার কোন ক্ষতি হয়েছে? তবে মদ কথাটা শুনতে যেহেতু খারাপ, গাঁজা খাওয়া যেতে পারে। তার কাছে নিজের চাষ করা গাঁজা আছে—ভিটামিনে ভরপূর।

গাঁজা আমি খেয়ে দেখেছি। চিন্তা গভীর হয়, সময় আর দূরত্বজ্ঞানে কিছু গোলমাল হয়, আর ক্ষিদে পায়। সেদিন মনীর বলল ও একসের ভালো ঘন দুধ জ্বাল দিয়ে রেখেছে। আমি যদি গাঁজা খেতে রাজী থাকি যেন সন্ধ্যে সন্ধ্যেতে খেয়ে নি। সে হাফ দুধ আমাকে দেবে। অতবড় স্কুলে সেদিন আমরা দু-জন।

আকারে যত বড়ই হোক খাঁচা হচ্ছে খাঁচা। চারিদিকে গ্রীল কপাট দিয়ে ঘেরা এই স্কুল কেন সন্ধ্যেবেলা আমাদের আত্মা বন্দী করে রাখবে? ঘোৎ ঘোৎ করে মনীর ঘুমোচ্ছে দেখে ওর বালিশের তলা থেকে চাবি বার করে গেটটা খুলে দিলাম। শীত যে কোথায় খুঁজেই পেলাম না। নেশা হয়েছে বটে।কিন্তু মনীরের মত অতটা হয় নি। পুকুরের দিকে তাকিয়ে মনে হল জলের চেয়ে নরম আর সুন্দর কিছুই নেই।

এই ফুরফুরে মেজাজে এখন কি করা যায়?
একা একা স্কুলের ছাদে উঠলাম। মাঠের মধ্যে সেই ভাঙ্গাচোরা বাড়ীটার দিকে তাকিয়ে আমার অদ্ভূত লাগল। আরে! এই সময় কারা যাচ্ছে ওখানে। একজন পুরুষ আর একজন মহিলা বেশ বোঝা যাচ্ছে। স্পষ্ট দেখলাম ওরা ভগ্নস্তূপের আড়ালে হারিয়ে গেল। মনীরকে ডাকা দরকার।
অনেক কষ্টে মনীরকে ব্যাপারটা বোঝানোর পরে ও আতংকের চোখে আমার দিকে চেয়ে ইঙ্গিতে বারণ করেই আবার ঘুমিয়ে পড়ল। গ্লাসে আর দুধ নেই। বেশ খিদে খিদে পাচ্ছে। যাই দেখি আবার ছাদে ব্যাপারটা কী হচ্ছে।

ঠিক দেখেছি। ওখানে বেশ কয়েকবার টর্চের আলো জ্বলেই আবার নিভে গেল। হঠাৎই আতংকের একটা স্রোত নেমে গেল আমার মেরুদন্ড দিয়ে। বাড়ীটার দিকে লক্ষ্য করতে করতে ছাদের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি আমি।এই সময় বাতাসের মধ্যে একটা তীব্র চীৎকার ভেসে এল, আরো একবার, আরো একবার। আর তারপর সব চুপ। এই চীৎকার এলো ঐ মাঠের ভাঙ্গাবাড়ী থেকে। ঠিক ওখান থেকেই ওটা এসেছে আমি নিশ্চিত হলাম।

গেটের সামনে ভয়ংকর মূর্তিতে মনীর দাঁড়িয়েছিল। ওর চোখ টকটকে লাল। কেন খুলেছো তুমি গেট? আমি বললাম মনীর ঐ ভাঙ্গাবাড়ীটায় কেউ বিপদে পড়েছে। চীৎকার শুনেছো তুমি? এক ধাক্কায় মনীর আমাকে পেছনে হটিয়ে গেট আটকে দাঁড়িয়ে রইল। খবর্দার! আগে চাবি মারো গেটে।
আরে বাবা! মারছি বলে চাবি বার করে গেটের দিকে গিয়েই আমি দৌড় মারলাম মাঠের দিকে। বাড়ীর কাছা কাছি পৌঁছতে বেশ হাঁফিয়ে গেলাম। হাঁফাতে হাঁফাতে জায়গাটাকে বোঝার চেষ্টা করলাম। বুনো গাছপালার ঝোপের মধ্যে বেড়া সমেত মুখ থুবড়ে পড়েছিলো বাড়ীটা। তবু মেঝের জায়গাটা এখনও বেশ উঁচু আছে। আরে উঁচু কোথায়—গোটা বাড়ীটা ঠিকই আছে। টিনের দরজা। উপরে অ্যাসবেস্টস। তাহলে দূর থেকে এটাকে ভাঙ্গাবাড়ী মনে হয় কেন? বারান্দায় উঠে টিনের দরজাটা ধাক্কা মেরে খুলতেই—আমি স্পষ্ট দেখেছি একটা কেরোসিনের ল্যাম্প জ্বলছিল ঘরে আর রক্তের মধ্যে ছাপা শাড়ী পরা একটা গলাকাটা মেয়ে গোঙ্গাচ্ছিলো। তারপরে কেউ পেছন থেকে আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল—এই পর্যন্ত আমার মনে আছে। আর যতবার আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে এই ছবিগুলো দেখে আমি ঠিক ঠাক কথাই বললাম।

কিন্তু মনীর আর আমাকে দু-জনকেই বলা হল এসব ঘুণাক্ষরে কাউকে না বলতে। কেননা এসব কিছুই আসলে হয় নি সবই নেশার ভুল।

এর অনেক পরে মনীর আমাকে বলেছিল সে গিয়ে আমাকে উদ্ধার না করলে আমার গলাও কাটা হত। ব্যাপারটা ভুতুড়ে না মানবিক সেটা আমাকে একদিন না একদিন সমাধান করতে হবে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৪ টি মন্তব্য (লেখকের ২টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৮-০১-২০১৯ | ০:৪৭ |

    গতিশীল একটি লিখা পড়লাম। ধন্যবাদ এবং স্বাগতম মি. বাসু দেব। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • বাসু দেব : ২১-০১-২০১৯ | ২০:৫৪ |

      অনেক ধন্যবাদ!

       

      GD Star Rating
      loading...
  2. নূর ইমাম শেখ বাবু : ১৯-০১-২০১৯ | ২০:৫৮ |

    চমৎকার কাহিনী।

    ভালো লাগলো।

    অনেক ধন্যবাদ।

    GD Star Rating
    loading...
  3. বাসু দেব : ২১-০১-২০১৯ | ২০:৫৪ |

    ধন্যবাদ তো আমারই দেবার কথা।

    GD Star Rating
    loading...