একদিন কোলকাতায়

২০১২ সালের ডিসেম্বরের এক কনকনে শীতের রাত। স্থান, ভারতের কোলকাতাস্থ নন্দন। প্রধান ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশে সাজ সাজ রব। উপলক্ষটা ছিল ‘চিলড্রেন ফিল্ম ফ্যাস্টিভাল’। নানা রঙে সেজেছে নন্দন। চারিদিকে উজ্জ্বল আলোকসজ্জা, বিভিন্ন রকমের অলঙ্করণ। শিশুদের উৎসব বলে কথা, কোথাও মিকি মাউসের প্রতিকৃতি কোথাও টম এন্ড জেরি চার্লি চ্যাপলিন তো কোথাও আবার বাঙালির গুপী বাঘা ফেলুদা তো আছেই! সাথে শিশুকিশোরদের চিত্তাকর্ষক ছোট বড় নানান অস্থায়ী ভাস্কর্য। আমরা বড়রাও দিব্যি উপভোগ করছিলাম। আরেকটু পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী আসবেন। অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে সবাই। সেদিনই মুখ্যমন্ত্রী উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন সপ্তাহব্যাপী উৎসবটি। সাদা ইউনিফর্ম পরা পুলিশে ভরে গেছে চারপাশ।

এ সময় সেখানে পশ্চিম বাংলার বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী লোপামুদ্রা মিত্র এলেন (নিশ্চয়ই তিনি আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে এসেছিলেন)। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালেন দরজার সামনে। কিছু আনুষ্ঠানিক কারণে তার অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশে বিলম্ব হচ্ছিল। বোধহয় খানিকটা আগেই এসে পড়েছিলেন। সে যাই হোক লোকজন বেশ কৌতূহলভরে দেখছিল লোপামুদ্রা মিত্রকে। আমিও ছিলাম সেই কৌতূহলীদের দলে। হা হা হা। লোপামুদ্রা মিত্রকে টিভিতে অনেকবার দেখেছি, কিন্তু কখনওই তেমন সুন্দরি বা আকর্ষণীয়াও মনে হয়নি বরং বেশ সাধরণ চেহারা; তেমন সাজগোজও তাকে কখনও করতে দেখিনি। তিনি আসলে ঠিক অমন স্বভাবের নন। মানে খুব অনাড়ম্বর সাদামাটাভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করে থাকেন ক্যামেরার সামনে। যারা তাঁকে চেনেন, তারা জানেন ব্যাপারটা। কিন্তু সেদিন সরাসরি দেখে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে, আমার কেন যেন খুব ভাল লাগছে তাঁকে দেখতে। কী এক আশ্চর্য মাধুরীময়তা, লাবণ্যতা লুকিয়ে আছে তাঁর চেহারায়। তন্ময় হয়ে দেখছিলাম। বলা বাহুল্য তখনও তেমন কোনও সাজগোজ করেননি, বেশ সাধারণভাবেই এসেছিলেন। পরনে রঙিন ঝলমলে একটি শাড়ি, তার উপরে একটা কার্ডিগান। মুখে খুব হালকা কিছু প্রসাধন থাকলেও থাকতে পারে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে সময় তিনি স্থানীয় সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিভিন্ন পরিচিত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছিলেন। তাঁর থেকে মাত্র দুতিনহাত দূরে দাঁড়িয়ে দারুণ শীতে মুখ দিয়ে শো শো শব্দ করতে করতে হা করে মুগ্ধ চোখে দেখছিলাম আমার খুব প্রিয় এই গায়িকাকে।

এ সময় একজন ইয়া লম্বা, মোটাসোটা যুবককে ঘটনাস্থলে আবিষ্কার করলাম। ওকে যুবক বলাটাও বোধকরি ঠিক হচ্ছে না। আকার আকৃতিতে অমন দৈত্যাকার হয়ে উঠলেও সে সময় ওর বয়স আঠার’র বেশি হয়তো ছিল না। ছেলেই বলি ওকে, নিতান্তই কিশোর, মুখে চিকন গোফের রেখা, মাথাভর্তী দীর্ঘ এলোমেলো চুল। বেশ মোটা ছিল ছেলেটি, কিন্তু উচ্চতার কারণে স্বাস্থ্যটা স্বাভাবিকই দেখাচ্ছিল। সবার থেকে উঁচুতে মাথা নিয়ে এদিক ওদিক লটরপটর করে বেড়াচ্ছে। লোপামুদ্রা মিত্রকেও বারবার ঘুরে ঘুরে দেখছিল।

কিছুক্ষণ পর দানবটা আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘দাদা দাদা, উনি কে?’ আমার উচ্চতা পাঁচ ফিট নয় ইঞ্চি; বাংলাদেশ বা ভারতের মানুষের গড় উচ্চতা অনুযায়ী সাধরণভাবে লম্বাই বলা যেতে পারে। এহেন আমাকেও কাছাকাছি হওয়াতে মাথা বেশ উঁচুতে তুলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হচ্ছিল। ও নির্ঘাত ছয় ফিট ছেড়েও আরও দু’তিন ইঞ্চি বেশি হয়ে থাকবে। পরে আরও বেড়েছে কিনা কে জানে! আশা করি, আবার কোনওদিন কোলকাতায় গেলে ওকে দেখবো।

‘উনি বিখ্যাত গায়িকা লোপামুদ্রা মিত্র।’ উত্তরে জানালাম আমি। আমার কথায় কোনও ভাবান্তরই হলো না ওর। অত্যন্ত স্বাভাবিক। লোপামুদ্রা মিত্রকে চিনলে তো আর আরেকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে বসতো না যে তিনি কে। কে জানে বিদেশ থেকে এসেছিল কিনা, কোলকাতার স্থানীয় কেউ লোপামুদ্রা মিত্রকে চিনবে না, তাও কি সম্ভব! নাকি আমার মতোই একজন বাংলাদেশী ছিল! হা হা হা।

যাই হোক আমার কাছ থেকে লোপামুদ্রা মিত্রের পরিচয় পেয়ে দেখলাম, ওর লটরপটর আরও বেড়ে গেল। দৈত্যাকার শরীরটা একবার এখানে তো আরেকবার ওখানে। বুঝলাম না এতো উসখুস করছে কেন! ওর উদ্দেশ্য কি! আসলে বিশালাকার শরীরের কারণে খুব চোখে পড়ে যাচ্ছিল।

একপর্যায়ে দেখলাম কয়েকজনকে ‘এই সর এই সর’ বলে বেশ সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে লোপামুদ্রা মিত্রের একদম প্রায় শরীর স্পর্শ করার মতো কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। আরে… দানবটা কি উল্টাপাল্টা কিছু করে বসবে নাকি, লোপামুদ্রা মিত্রের ঘাড়ে চড়ার মতো অবস্থা! মনে মনে প্রস্তুতি নিলাম গায়িকার কোনওরকমের অসম্মান হলে আমিও মাঠে নামবো। মরলেও পর্বতটাকে কিছুটা হলেও নড়াচড়া করিয়েই ছাড়বো। উপস্থিত এই দুতিনজন কঙ্কালসার লিলিপুট পুলিশ এর কিছুই করতে পারবে না। ওর পাঁচ কেজি ওজনের হাতির হাতের একটি থাবাই যথেষ্ট এই রূগ্ন শীর্ণকায় মাঝবয়সী পুলিশগুলোকে এই কনকনে শীতের রাতে সর্ষেফুল দেখাতে। চেহারা দেখলে মনে হয় ওরা ডায়েট কন্ট্রোল করছে। এই দুতিনজন অভুক্ত, পুষ্টিহীনতার শিকার মাঝবয়সী পুলিশ এই হাতিটাকে কিছুতেই সামলাতে পারবে না! সুতরাং আমাকে স্বেচ্ছাসেবক হয়ে হলেও এগিয়ে যেতে হবে ওরকম কোনও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির উদ্ভব হলে। আমি তৈরি।

এরপর দেখলাম পাহাড়টা লোপামুদ্রা মিত্রের মুখের কাছে মুখ নিয়ে এলো! আরে… শালা কি পাগল হয়ে গেছে নাকি! ওর উদ্দেশ্য কি! গায়িকার মুখের কাছে মুখ নিয়ে গেছে কেন! জোর করে কি চুমুটুমু খেয়ে বসবে নাকি আবার মা’র বয়সী একজন ভদ্রমহিলার গালে! হাত মুষ্টিবদ্ধ করলাম। আমার প্রিয় গায়িকা, একটু চিৎকার দিলেই এলোপাথাড়ি মারা শুরু করবো এই দুষ্ট দৈত্যটাকে, পরে যা হয় হোক পরোয়া করি না। জানি, ওর সাথে শক্তিতে পেরে উঠবো না। ঐরাবতসম শরীরটা দিয়ে আমাকে কোনওরকম একবার চেপে ধরতে পারলেই আমার ভাবলীলা সাঙ্গ হওয়া অনিবার্য হয়ে দাঁড়াবে! যাক কি আর করা! তবু স্বান্তনা এই যে, একজন বীর হিসেবে পৃথিবীকে টাটা বাই বলে চলে যাবো।

এমতাবস্থায় দেখলাম দানবটা একেবারে গায়িকার কানের কাছে মুখ নিয়ে যেয়ে ফিসফিস করে কথা বলতে লাগলো। না, আর তো সহ্য করা যায় না! আরও এক কদম মুষ্টি বাগিয়ে এগিয়ে গেলাম। যা হয় হোক আজ এর একটা এসপার ওসপার করেই ছাড়বো। গায়ের জোরে শালা যা খুশি তাই করে বেড়াবি, আর সবাই চুপচাপ দেখে যাবো! না, তা হয় না। এর আগেও কয়েকজনকে ইচ্ছেমতো ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে গায়িকার কাছে গিয়েছিলি! আমার তখনই প্রতিবাদ করা উচিৎ ছিল। যা হোক প্রিয় গায়িকার প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় আছি। আমি আমার দিক থেকে সম্পূর্ণরুপে প্রস্তুত। আমার প্রিয় গায়িকা, সামান্য আহা উহু করলেই সর্ব শক্তিতে ঝাপিয়ে পড়বো দৈত্যটার ওপর। জানি, বড়জোর একটু নড়েচড়ে উঠবে, আর তেমন কিছুই হবে না। ওকে সুবিধামতো নাগালেই পাবো না। পরবর্তীতে নির্ঘাত আমাকে ইচ্ছেমতো তুলোধোনা করে ছাড়বে। আর এইসব পাবলিক তখন কেবল দর্শক হয়ে মজা লুটবে দূর থেকে, কেউ এগিয়ে আসবে না। এই এক ব্যাপারে দুই বাংলার মানুষের মাঝে একচুল পরিমাণও কমবেশি নেই। প্রভাবশালী, বলশালীরা যা খুশি তাই করুক, তাদের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করা যাবে না। পুলিশ নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবে। কিন্তু ততক্ষণ আমি বাঁচি কিনা কে জানে! আমার ঘাড় মটকে দিতে এই পাহাড়সম দানবটার মাত্র দুমিনিটই যথেষ্ট।

এমতাবস্থায় দেখলাম লোপামুদ্রা মিত্র ওকে খানিকটা উষ্মাভরে বললো, ‘আরে দাঁড়াও না। আগে অনুষ্ঠান থেকে ফিরে আসি, তারপর।’ হুমম মানে, অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এসে কি হবে! ঐরাবতটা কি প্রস্তাব দিয়েছে, যেটা অনুষ্ঠান থেকে ফিরে আসার পর হবে! ভাবলাম। লোপামুদ্রা মিত্র কি ওর ধর্ম মা হতে যাচ্ছে নাকি! বুঝলাম না কিছুই। তবে হাতের মুষ্ঠি খুলে দিলাম। না, সিরিয়াস কিছু নয়। পর্বতটাও একটু তফাতে চলে গেল। বিপর্যয়কর কিছুই হলো না শেষমেশ।

এ সময় আমি কৌতূহলী হয়ে দানবটার কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা ভাই, তুমি লোপামুদ্রা মিত্রের কানেকানে ফিসফাস করে কি বলছিলে?’
আমাকে চিনতে পারলো ও। মিনিট পাঁচেক আগে আমার কাছেই জানতে চেয়েছিল, লোপামুদ্রা মিত্র কে। আমার আচম্বিত প্রশ্নে ভীষণ অপ্রস্তুত হতে দেখলাম ওকে। বেশ লজ্জিতও দেখাচ্ছিল। পারলে উত্তর না দিয়ে ছুটে পালায় সেখান থেকে। আমিও মাথা উঁচুতে তুলে মুখ কঠোর করে ওর দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছি উত্তরের। জবাব না দিয়ে যাবে কোথায় বাছাধন! আমিই তোমাকে চিনিয়েছি শিল্পী লোপামুদ্রা মিত্রকে। এখন আমার কৌতূহল তুমি মেটাও, কি ফিসফাস করছিলে কানেকানে?

এদিক ওদিক তাকিয়ে চেহারায় চরম বিরক্তিভাব ফুটিয়ে তুলে পাহাড়টা আমাকে তখন উত্তরে বললো, ‘এই, কিছু না দাদা, একটা সই চেয়েছিলাম।’ এই উত্তর শুনে আমি তো একেবারে থ। থ মানে থ… এক্কেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, আরেকটু হলেই মূর্ছা যেতাম।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৯ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ৯ জন মন্তব্যকারী

  1. সুমন আহমেদ : ১৩-০৭-২০১৯ | ২১:৫২ |

    ভীষণ মজার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন অর্ক ভাই। আপনার সরস বর্ণনা বেশ উপভোগ করলাম। Smile

    GD Star Rating
    loading...
  2. মুরুব্বী : ১৩-০৭-২০১৯ | ২১:৫৮ |

    পশ্চিম বাংলার বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী লোপামুদ্রা মিত্র আমার ভীষণ পছন্দের একজন মানুষ। সেই সেদিনে আপনার অভিজ্ঞতা অন্তরদৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করলাম। Smile সুন্দর লিখেছেন।

    GD Star Rating
    loading...
  3. রিয়া রিয়া : ১৩-০৭-২০১৯ | ২২:১১ |

    নন্দনে সকাল দুপুর সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। প্রায় সময় পেলে আমিও যাই। অনেক সেলিব্রেটিদের দেখ পাওয়া যায় ওখানে। আপনার মতো আমারও এমন অভিজ্ঞতা রয়েছে। শুভেচ্ছা প্রিয় অর্ক দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
  4. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ১৩-০৭-২০১৯ | ২২:২৪ |

    হাহাহা। বক্সিং একটা লাগিয়ে দিলেই পারতেন অর্ক ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    GD Star Rating
    loading...
  5. আবু সাঈদ আহমেদ : ১৩-০৭-২০১৯ | ২২:৫৮ |

    না ভুলে যাবার মতো স্মৃতি।

    GD Star Rating
    loading...
  6. সাজিয়া আফরিন : ১৩-০৭-২০১৯ | ২৩:০৮ |

    নস্টালজিয়া। Smile

    GD Star Rating
    loading...
  7. শাকিলা তুবা : ১৩-০৭-২০১৯ | ২৩:৩০ |

    স্মরণে থাকার মতো স্মুতি। Smile

    GD Star Rating
    loading...
  8. শান্ত চৌধুরী : ১৪-০৭-২০১৯ | ০:২১ |

    শুভ কামনা সতত  ….

    GD Star Rating
    loading...
  9. রুকশানা হক : ১৪-০৭-২০১৯ | ৮:৩৯ |

    মজার স্মৃতি। লোপামুদ্রা আমার প্রিয় গায়িকাদের একজন। সুন্দর করে লিখেছেন। শুভকামনা  ।     

    GD Star Rating
    loading...