রবীন্দ্রনাথ রাত জেগে প্রার্থনা করতেন। তাঁর প্রার্থনা কক্ষে কারো অনুমতি ছিল না। এমনকি কবিপত্নীরও নয়। একদিন রাতের বেলা প্রার্থনার সময়ে ‘গুরুজী! গুরুজী!! বলে চিৎকার কতে করতে নজরুল রবি কক্ষে ঢুকে পড়েন। হতচকিত রবীন্দ্রনাথ বলেন কিরে অমন ষাঁড়ের মত চিৎকার করছিস কেন? (দুই কবির সম্পর্ক এমন সাবলীলই ছিল।) ‘আমি আপনাকে খুন করেছি গুরু!’ আমি আপনাকে খুন করেছি বলে নজরুল তখন বিদ্রোহী কবিতাটি দেখান। রবি ঠাকুর বলে হ্যাঁরে নুরু তুই আমাকে খুন করেছিস। নজরুলের বিভিন্ন জীবনী গ্রন্থে বিদ্রোহী কবিতার ইতিহাস এভাবে বর্ননা করা আছে। রবিন্দ্রনাথ নজরুল সম্পর্কে উচ্চ ধারনা পোষণ করতেন এবং এই নিয়ে রবীন্দ্র ভক্তরা কবির উপর নাখোশ হয়েছিলেন। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ নজরুল কে যখন বসন্ত নাটক উৎসর্গ করেন তখন কবিভক্তরা যে কি রকম চটে ছিলেন সে কাহিনী কম বেশি সবারই জানা। বসন্ত নাটকের উৎসর্গ নিয়ে জেলেও বেশ নাটকীয় ঘটনা ঘটে। এই খবরটি নিয়ে যিনি জেলে যান জেলার তাকে বেশ ভর্ৎসনা করেন এই বলে যে তিনি গিফট এবং ডেডিকেটেস এর পার্থক্য বুঝেন না। জেলার তাঁকে বার বার জিজ্ঞেস করেন, ডেডিকেটেড? ইয়ু মিন গিফট? জেলার সাহেব বিশ্বাসই করতে পারছিল না নজরুলকে উৎসর্গ করা হয়েছে। বড়জোর তাকে একটা বই উপহার দেয়া হতে পারে! জেলারকে তখন নিশ্চিত করা হয় গিফট নয় ডেডিকেটেড। বলা হয় ডেডিকেটেড টু নজরুল। হি ইজ আওয়ার গ্রেটেস্ট পোয়েট নেক্সট টু টেগোর। (এইখানে একটা বিষয় লক্ষনীয় নেক্সট টু টেগোর, আফটার টেগোর নয়) জেলার নজরুল কে গিয়ে খবর দেন এই বলে, ‘তুমি তো নোবেল পেয়ে গেলে ভায়া!’
নজরুল কি লিখেছেন কি করেছেন আমরা সবাই কম বেশি জানি। ছোটবেলা থেকে জেনে জেনে বড় হয়েছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় নজরুলকে আমরা ধারন করি কম। মাঝে মাঝে আমার মনে আমরা বড় দূর্ভাগা জাতি। নজরুলের মত ব্যক্তিত্বকে ধারন করার সাধ্য আমাদের নেই। আমাদের মাঝে খুব বড় একটা প্রবণতা দেখা যায় যে নজরুলকে ছোট করে দেখার। হেয় করার। নজরুল হেয় করতে পারা, ছোট করা নজরুলের কবিতা নিয়ে হাস্যরস করলে নিজেকে কেমন যেন বুদ্ধিজীবি স্তরে পৌঁছানো যায়। নজরুল তো আন্ডার ম্যাট্রিক ছেলে। আমাদের বড় বড় ডিগ্রী আছে। সেরা ইয়ুনিভার্সিটির পিএইচডি আছে। বিদ্যার গৌরবে তখন নজরুলে কাজকে আর চোখে লাগে না। আমি এমনও দেখেছি নজরুলে ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অথচ নজরুল সম্পর্কে তাঁর ধারনা তাচ্ছিল্য করার মত। নজরুল ইন্সটিটিউট যেহেতু সরকারী প্রতিষ্ঠান, এর প্রধানের পদটা গৌরবের ও আর্থিকভাবে লাভজনক। সুতরাং দু একটা পাবলিকেশন্স আছে, বুদ্ধিজীবী মহলে পরিচিতি আছে সরকারী আনুকল্য আছে। সেই সুবাধে নজরুলের ইন্সটিটিউটে মহাপরিচালক হয়ে গেলাম। এই সমস্ত পরিচালক মহাপরিচালকেরা নজরুল গবেষণা তো দূরে থাকুক নজরুল রচনাবলীও পড়েছে বলে আমার মনে হয় না।
নজরুলকে শুধু বিদ্রোহী কবি বলা আমার কাছে মনে হয় কবিকে খাট করা। নজরুলের একটি মাত্র পরিচয় বিদ্রোহী। কিন্তু তাঁর আর বাকী পরিচয়গুলো এর আডালে লুকিয়ে রাখাতো কবির প্রতি অবিচার। আমরা কবির রণতূর্যের কথা বলি কিন্তু বাঁকাবাশরীর কথা ভুলে যাই। নজরুলের মানবতা, সার্বজনীন ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দর্শন, সাহিত্য সবচেয়ে বেশি অনালোচিত। নজরুল ভক্তদের দেখা যায় অতি আবেগে গদগদ হয়ে সাম্রাজ্যবাদ ও ব্রিটিশ বিরোধী কিছু আলোচনা, সাম্যবাদী কবিতার দু চার লাইন আওড়ে দায়ত্বি শেষ করতে।
আমাদের দেখার দরকার আছে সাংবাদিক নজরুল কেমন ছিলেন? বর্তমান সাংবাদিকদের জন্য নজরুলের সাংবাদিকতা কি দর্শন নিয়ে উপস্থিত হয়। আধুনিক গণমাধ্যমের এই ডামাডোলের যুগে দেখি মেরুদন্ডহীন সাংবাদিকতায় চারিদিক সয়লাব। অতি কথন, অতি আলোচনা, মিথ্যে আর অর্ধ সত্যের এই সাংবাদিকতায় লাল হলুদ নানা রঙে রঙিন। নজরুলের মত গণমানুষের সাংবাদিক আজকের মিডিয়া জগতে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত। এর কারণকি এটাই আজকের গণ মানুষের সাথে যোগসম্পর্কহীন সাংবাদিকতা গণমানুষের নজরুলকে ধারণ করতে পারেনা? যাকে ধারণ করার শক্তি নেই তাকে উপেক্ষা করে নিজের অক্ষমতাকে ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা।
বাংলা সাহিত্য ছিল কলকাতার মধ্যবিত্তদের প্রতিচ্ছবি। কামার কুমোর ছুতোরের উপস্থিতি ছিলনা এখানে। মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের ছকে বাধা জীবনের ফ্রেম যেক বাংলা সাহিত্যের অলঙ্গনীয় গ্রামার হয়ে জেঁকে বসেছিল। নজরুল এসে প্রথা ভাঙলেন। আজকের দিনে এই কথা অনেক সাহিত্যমোদীর জানা নেই নজরুলই প্রথম কামার কুমোরের মুখের কথা অর্থাৎ আঞ্চলিক কথ্যভাষা সাহিত্যে ব্যাবহার করেছিলেন। বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে এ কিন্তু এক যুগান্তকারী ঘটনা। নজরুল পরবর্তী কোন কথা সাহিত্যেকের পক্ষে এই প্রবণতা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নি।
চলচ্চিত্রের সাথে নজরুলের যোগাযোগের কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু জানা পর্যন্তই। নজরুলের অভিনীত চলচ্চিত্র গুলো কোথায় আছে। তার পরিচালিত সুরাপিত চলচ্চিত্রগ গুলো আদৌ কোন আর্কাইভে আছে কিনা কে জানে? অন্তত কবির জন্ম মৃত্যু তিথিতে কি এই সব চলচ্চিত্র প্রদর্শিত আলোচিত হতে পারে না। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল, বিএফডিসি, নজরুল ইনস্টিটিউট এই বিষয়ে কখনো কোন উদ্যোগ নিয়েছে বলে মনে পড়ে না।
নজরুলের আলোচনা যদি আমরা দু-চারটি কবিতা আর গানের মাঝে সীমবদ্ধ করে রাখি তাহলে আমরা নিজেদেরকেই বঞ্চিত করব। নজরুল যা করেছেন, যা দিয়ে গেছেন তা আমাদের জন্যই দিয়ে গেছেন। জীবন যাপনে চিন্তা চেতনায় নজরুল আমাদের জন্য বিপুল সম্ভাবনা তৈরি করে গেছেন তা আমরা ভুলে যাই। বাতাসের মাঝে থেকে আমরা যেমন ভুলে যাই আমরা বাতাসে ঢুবে আছি। অনেকের কাছে কথাটি অতি কথন মনে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হল নজরুল ছিলেন উপেক্ষিতের ভাষা, ব্রাত্যজনের কবি। শুধুমাত্র গুটিকয়েক ব্রাহ্মনের হাতে বন্দী ভাষা ও সাহিত্যকে নজরুল মুক্তি দিয়েছিলেন। সেই মুক্তির স্বাধ আমরা আজ সকলেই ভোগ করি।
১৯২৯ সালের ১০ ডিসেম্বর কলকাতার এলবার্ট হলে বাঙালিদের পক্ষ থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে এক বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা দেয়া হয়। তখনই জাতির পক্ষ থেকে কবিকে বাঙালির জাতীয় কবি হিসেব অভিহিত করা হয়। তাতে সভাপতিত্ব করেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, অভিনন্দনপত্র পাঠ করেন ব্যারিস্টার এস ওয়াজেদ আলী, শুভেচ্ছা ভাষণ দেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এবং রায়বাহাদুর জলধর সেন। কবিকে সোনার দোয়াত-কলম উপহার দেয়া হয়। এই সংবর্ধনা সভায় প্রফুল্লচন্দ্র রায় বরেছিলেন, ‘আমার বিশ্বাস, নজরুল ইসরামের কবিতা পাঠে আমাদের ভাবী বংশধররা এক একটি অতি মানুষে পরিণত হইবে।’ আমরা অতি মানুষ হতে চাইনা। তাই নজরুলকে উপেক্ষা করি।
আমাদের সময় এসেছে মেরুদন্ড সোজা করে মানুষ হবার।
আমরা যদি না জাগি মা
কেমনে সকাল হবে?
loading...
loading...
ভীষণ ভালো লাগলো
loading...
অনেক ধন্যবাদ প্রিয় আপু।
নজরুল – রবীন্দ্র সম্পর্ক নিয়ে আপনার পোস্টটিও অসাধারণ।
loading...
‘বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’,
কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি!
কেহ বলে, ‘তুমি ভবিষ্যতে যে
ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে!
যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে-বাণী কই কবি?’
দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী!’
__প্রিয় কবির জন্মতিথিতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। কবি বেঁচে থাকুন হৃদয়ে। মননে।
loading...
ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন,
বেলা ব’য়ে যায়, খায়নি ক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।
কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়,
স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়!
কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছে কি? কালি ও চুন
কেন ওঠে না ক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?
শুভেচ্ছা নিবেন প্রিয়।
loading...
অসম্ভব ভালো লাগলো ! সুভেচ্ছে নিরন্তর !
























loading...
তোমার বুকে স্থান কোথা গো এ দূর-বিরহীর,
কাজ কি জেনে ! তল কেবা পায় অতল জলধির!
গোপন তুমি আস্ লে নেমে
কাব্যে আমার, আমার প্রেমে,
এই-সে সুখে থাক্ ব বেঁচে, কাজ কি দেখে তীর ?
দূরের পাখী—-গান গেয়ে যাই, না-ই বাঁধিলাম নীড় !
বিদায় যেদিন নেবো সেদিন নাইবা পেলাম দান,
মনে আমার কর্ বেনাক’—-সেই ত মনে স্থান !
যে-দিন আমায় ভুল্ তে গিয়ে
ক’রবে মনে, সে-দিন প্রিয়ে
ভোলার মাঝে উঠ্ ব বেঁচে, সেই ত আমার প্রাণ !
নাই বা পেলাম্ চেয়ে গেলাম, গেয়ে গেলাম গান !
নজরুল দিবসে নিজের উপলব্দিটা আপনাদের সাথে ভাগাভাগি করে নিলাম মাত্র। আপনার ভাল লাগায় আপ্লুত ।
অনেক ভালবাসা জানবেন।
loading...
* এমন তথ্য সমৃদ্ধ রচনা জ্ঞান পিপাসুদের তৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম হবে…
loading...
নজরুল দিবসে কবিকে নিয়ে আমার উপলব্দিগুলো আপনাদের সাথে ভাগাভাগি করে নিলাম।
সত্যি বলতে কি, চারিদিকে হতাশাজনক অবস্থা। আজকে বিভিন্ন টিভি ও পত্রিকাতে নজরুলের যে কভারেজ দেখেছি তাতে হতাশ হয়েছি। টিভি চ্যানেলগুলো নামকা ওয়াস্তে কিছু অনুষ্ঠান করে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
নজরুলের প্রতি আমাদের এই আচরণ আমাদের নিজেদেরকেই ক্ষতিগ্রস্থ করবে।
loading...
প্রাণবন্ত আলোচনা।
নজরুল শুধু কবিই নয় একজন উচ্চমার্গের সাধকও বটে। তাঁর বেশ কয়েকটি কবিতার চরণে তা ফুটে উঠেছে। যেমনঃ
কেন খুঁজে ফের দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি কংকালে
হাসিছেন তিনি অমৃত হিয়ার নিভৃত অন্তরালে।
বন্ধু বলিনি ঝুট!
এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজ-মুকুট।
গভীর ভাবে চিন্তুা করলে দেখা যায় – তিনি দার্শনিক কবিও বটে।
ধন্যবাদ আনুভাই এরুপ একটি লেখা উপহার দেয়ার জন্য।
loading...
অবশ্যই নজরুল দার্শনিক, এতে কোন সন্দেহ নাই।
কিন্তু নজরুলকে আমরা ধারন করি না। নজরুল চর্চা আমাদের মাঝে নাই। আজকে নজরুল কে নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে যে আয়োজন দেখলাম, তার দারিদ্র্য আমাকে ব্যাথিত করেছে।
আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে?
loading...
‘যদি আর বাঁশি না বাজে, আমি কবি বলে বলছিনে, আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি, আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন, আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি, প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সেই প্রেম পেলাম না বলে এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব ও অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।।’
loading...
তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু, আর আমি জাগিব না,
কোলাহল করি’ সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না |
. ——- নিশ্চল নিশ্চুপ
আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধূর ধূপ !——
loading...